ইউরোপ নয় কক্সবাজার রেলস্টেশন
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : দৃষ্টিনন্দন রেলস্টেশনের ছবিটি নিয়ে তোলপাড় চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এর মধ্যেই মানুষকে আন্দোলিত করেছে ছবিটি। অনেকের জিজ্ঞাসু মন প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে- এটা কি ইউরোপ-আমেরিকার কোনো চকচকে-ঝকঝকে রেলস্টেশন? উত্তরের জন্য আর অপেক্ষা নয়- আমাদের প্রতিনিধি আয়ুবুল ইসলাম জানান, এই আইকনিক রেলস্টেশনটি দেশের পর্যটন নগরী কক্সবাজারের। চট্টগ্রাম থেকে বন-পাহাড় ছুঁয়ে ট্রেন এসে থামবে ঝিনুকের আদলে গড়া সুরম্য এই স্টেশনে।
অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধার প্রায় সবই থাকছে স্টেশনটিতে। স্টেশনটিতে থাকছে লকার বা লাগেজ রাখার ব্যবস্থা। রাতের ট্রেন ধরে সকালে কক্সবাজারে গিয়ে পর্যটকরা লাগেজ, মালামাল স্টেশনে রাখতে পারবেন। এর জন্য অবশ্য ভাড়া দিতে হবে। সারা দিন সমুদ্রসৈকত বা দর্শনীয় স্থান ঘুরে রাতের ট্রেনে আবার ফিরে যেতে পারবেন। রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, রেলস্টেশনটির নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যে এই রেলপথ চালু হলে পর্যটকরা চাইলে হোটেল ভাড়া না করেই কক্সবাজার ভ্রমণ করে ফিরে আসতে পারবেন। এরই মধ্যে ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে প্রকল্পের কাজ।
পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সঙ্গে সারা দেশের রেল সংযোগ কোনো কল্পকথা নয়, এখন বাস্তবের পথে। দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্প। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, চলতি বছরের জুন থেকে অক্টোবরের মধ্যেই রেলে চেপে কক্সবাজার ভ্রমণে যেতে পারবেন পর্যটকরা। রেল যোগাযোগ চালু হলে পর্যটকদের যাতায়াত সহজ হওয়ার পাশাপাশি স্বল্প সময়ে ও কম খরচে কৃষিপণ্য, মাছ, লবণ পরিবহন করা যাবে। এতে কক্সবাজারের পর্যটনসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে জানান স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরই মধ্যে দোহাজারী-কক্সবাজার ১০০ কিলোমিটার রেলপথের ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরেই কক্সবাজারে রেল চলাচলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। রেলপথ সচল হলে ঘুরে যাবে কক্সবাজার অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চাকা। সম্প্রতি কক্সবাজারে রেল প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন শেষে রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘চলতি বছরের জুন থেকে অক্টোবরের শেষ নাগাদ দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন চালু হবে। একসময় এটি স্বপ্ন ছিল, এখন সেটা বাস্তবায়নের পথে। কক্সবাজারের জন্য ট্যুরিস্ট কোচের আদলে উন্নতমানের কোচ দিয়ে ট্রেন চালানো হবে। এ জন্য নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ৫৪টি কোচ কেনা হবে, যেগুলোর জানালা সুপ্রশস্ত। মানুষ অনায়াসে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সুযোগ পাবে।’ স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইমুম সরোয়ার কমল বলেন, ‘চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার এবং রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ হচ্ছে। মিয়ানমার সরকারের সম্মতি না থাকায় আপাতত রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটার রেললাইনের কাজ হচ্ছে না।’ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ১০০ কিলোমিটার রেলপথে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ঈদগাঁও, রামু, কক্সবাজার সদরসহ স্টেশন থাকছে আটটি। এ জন্য সাঙ্গু, মাতামুহুরি ও বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি বড় সেতু। এ ছাড়া রেলপথে তৈরি হয়েছে ৪৩টি ছোট সেতু, ২০১টি কালভার্ট ও ১৪৪টি লেভেল ক্রসিং। সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া এলাকায় তৈরি হচ্ছে একটি ফ্লাইওভার, রামু ও কক্সবাজার এলাকায় দুটি হাইওয়ে ক্রসিং। হাতি ও বন্যপ্রাণীর চলাচলে একটি ওভারপাস ও তিনটি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হচ্ছে। সরেজমিন দেখা গেছে, কক্সবাজার সদর থেকে ৭ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন আইকনিক রেলস্টেশন। স্টেশনটিকে সৈকতের ঝিনুকের আদলে তৈরি করা হচ্ছে। স্টেশন ভবনটির আয়তন ১ লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয় তলা ভবনটির বিভিন্ন অংশে অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। নির্মাণাধীন আইকনিক ভবন ঘেঁষে ৬৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থের তিনটি প্ল্যাটফরম তৈরি হচ্ছে। এর পাশেই রেলওয়ের আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে আটটি ভবনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। স্টেশনটিতে আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি ক্যান্টিন, লকার, গাড়ি পার্কিং ইত্যাদির ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এই স্টেশন দিয়ে দিনে ৪৬ হাজার মানুষ আসা-যাওয়া করতে পারবেন। দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক মফিজুর রহমানের মতে, ১০০ কিলোমিটার রেললাইনে এরই মধ্যে ৫০ কিলোমিটারের বেশি এখন দৃশ্যমান। বেশির ভাগ ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ শেষ হয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। প্রকল্পের মেয়াদ আছে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। তবে আমরা চেষ্টা করছি এ বছরের জুন-অক্টোবরের মধ্যে কাজ শেষ করতে।
প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী জি এম আলমগীর বলেন, ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড দুই ভাগে কাজ করছে। নিখুঁতভাবে দ্রুত কাজ করছি আমরা। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, প্রধানমন্ত্রী ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের প্রায় সাত বছর পর ২০১৮ সালে ডুয়েল গেজ ও সিঙ্গেল ট্র্যাক রেললাইন প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৬ সালে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের রামু পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এর অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার।