পেঁয়াজে ভারতনির্ভরতা কাটিয়ে উঠছে বাংলাদেশ
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : পেঁয়াজের আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি গত কয়েক বছরে ভোক্তাদের জন্য বড় বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠেছিল। প্রায় আড়াই বছর আগে প্রকাশিত ‘প্রমোটিং অ্যাগ্রিফুড সেক্টর ট্রান্সফরমেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকেও পর্যবেক্ষণ দিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশে কৃষিপণ্যগুলোর মধ্যে পেঁয়াজের বাজারেই অস্থিতিশীলতা দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। এর পেছনের কারণ হিসেবে বরাবরই পণ্যটির চাহিদা পূরণে ভারতনির্ভরতাকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করেছেন বাজার পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা। স্থানীয় উৎপাদন চাহিদা পূরণে অপর্যাপ্ত হওয়ায় প্রতিবেশী দেশটি থেকে নিয়মিতভাবেই বছরে ৮-১০ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হতো। এর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে পণ্যটির মূল্যে বড় প্রভাবক হয়ে উঠেছিল ভারতে অনাবৃষ্টি-অতিবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দেশটির সরকারের পেঁয়াজ বাণিজ্য-সংক্রান্ত নীতিগত সিদ্ধান্ত। সুযোগসন্ধানীদের জন্যও পণ্যটির বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির সুযোগ করে দিয়েছিল একক উৎসে নির্ভরতা।
ভারত সরকার ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে পেঁয়াজ রফতানি সাময়িকভাবে বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। এর প্রভাবে বাংলাদেশে পণ্যটির মূল্য দাঁড়ায় রেকর্ড সর্বোচ্চে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে পরের বছরও। সে সময় সৃষ্ট বাজার অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণে আমদানি উৎসে বৈচিত্র্য আনার পাশাপাশি দেশেও পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আবাদ সম্প্রসারণে নানামুখী পদক্ষেপের পাশাপাশি ভর্তুকি-প্রণোদনা ছাড়াও কৃষকের মধ্যে সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ শুরু হয়। এরই মধ্যে এসব পদক্ষেপের সুফলও মিলতে শুরু করেছে।
দেশে গত তিন বছরে পেঁয়াজ উৎপাদন বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ লাখ টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে পণ্যটি উৎপাদন হয়েছে ৩৬ লাখ ৪১ হাজার টন। একই সঙ্গে বেড়েছে পণ্যটির আবাদি জমির পরিমাণ ও উৎপাদনশীলতা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে ২ লাখ ১২ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার হেক্টরে। এ সময়ের মধ্যে কৃষিপণ্যটির উৎপাদনশীলতা হেক্টরপ্রতি ১১ টন থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ টনে।
স্থানীয় উৎপাদন পর্যাপ্ত হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিতিশীলতার ছাপ দেশে পেঁয়াজের বাজারে দেখা যাচ্ছে না। কোনো কোনো দেশে পণ্যটির দাম এখন স্বাভাবিকের কয়েক গুণে দাঁড়ালেও বাংলাদেশে তা কমছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের বাজারে দেশী পেঁয়াজ প্রতি কেজি ২৫-৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০-৪০ টাকায়। এক মাস আগেও দেশী পেঁয়াজ ৩০-৪০ ও আমদানীকৃত পেঁয়াজ ৪০-৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গত বছরের এ সময়ে পেঁয়াজের দাম ছিল ৪৫-৫৫ টাকা।
দেশের বৃহত্তম পাইকারি ভোগ্যপণ্য বাজার খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরাও বলছেন, কয়েক বছর ধরে নির্দিষ্ট কিছু সময়ে পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যাওয়ায় দেশে ধারাবাহিকভাবে পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে এখন উৎপাদনকারী জেলাগুলো থেকে পর্যাপ্ত সরবরাহ আসছে। ফলে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি অনেকটাই কমেছে। আগে দেশী পেঁয়াজের দাম কম ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশীয় পেঁয়াজেও ভালো দাম পাচ্ছেন কৃষক। তবে উৎপাদনের ভরা মৌসুমে চাহিদার তুলনায় বাড়তি সরবরাহের কারণে এখন দেশী পেঁয়াজের দাম কিছুটা কম। আসন্ন রমজান মাস ও কোরবানির ঈদেও দেশে পেঁয়াজের সরবরাহ সংকটের সম্ভাবনা অনেক কমেছে।
খাতুনগঞ্জের হামিদউল্লাহ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গুণগত মানের বিচারে দেশী পেঁয়াজ অনেক ভালো। তবে দেশীয় পেঁয়াজের বেশকিছু জাত দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করা যায় না। এ কারণে দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ উৎপাদন সত্ত্বেও কিছু আমদানি করতে হয়। তবে উৎপাদনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে দেশে পেঁয়াজের সংকট বা অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হবে না।’
স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধিই পেঁয়াজে ভারতনির্ভরতা কমিয়েছে বলে মনে করছেন আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা। দেশে ভারত থেকে আমদানীকৃত পেঁয়াজের বড় একটি অংশ আসে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে। সেখানকার ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দুই-তিন বছর আগেও এখান দিয়ে প্রতিদিন পেঁয়াজবাহী ট্রাক প্রবেশ করত গড়ে ৫০-৬০টি। এখন তা মাত্র ৮-১০টিতে নেমে এসেছে।
হিলি স্থলবন্দরের পেঁয়াজ আমদানিকারক ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরেই বন্দর দিয়ে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি নিম্নমুখী রয়েছে। ২০১৯ সালে ভারত পণ্যটি রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর দেশে পেঁয়াজের দাম এক লাফে কেজিপ্রতি ২৫০-৩০০ টাকায় উঠে যায়। এরপর সরকারও উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের প্রণোদনাসহ নানা ভর্তুকি দিতে থাকে। এর ফলে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে পেঁয়াজের স্থানীয় আবাদ-উৎপাদন-সরবরাহ বেড়েছে। বাজারে স্থানীয় সরবরাহ ভালো থাকার কারণেই ভারত থেকে দেশে পেঁয়াজ আমদানির পরিমাণ কমছে।’
এখানকার আরেক পেঁয়াজ আমদানিকারক ব্যবসায়ী তোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন হয়েছে। সরবরাহও বেশি। অন্যদিকে ভারতে পেঁয়াজের দাম কিছুটা বেশি। ফলে এ মুহূর্তে আমদানির চাহিদাও কম। এর মধ্যেই আবার বাজারে নতুন জাতের স্থানীয় পেঁয়াজ উঠতে শুরু করেছে। ফলে আসন্ন রমজানেও বাজারে স্থানীয় পেঁয়াজ সরবরাহে ঘাটতি হবে না। আগে যেখানে শুধু হিলি স্থলবন্দর দিয়েই ভারত থেকে গড়ে পেঁয়াজবাহী ট্রাক ঢুকত ৫০-৬০টি, সেখানে এখন তা ৮-১০ ট্রাকে নেমে এসেছে। মাঝে তা আরো কমে তিন-পাঁচ ট্রাকে নেমে এসেছিল। বর্তমানে আসন্ন রমজানকে কেন্দ্র করেই আমদানি কিছুটা বেড়েছে। আবার চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বাড়ায় বাজারে এখন পেঁয়াজের দামও কমতির দিকে।’
এছাড়া পেঁয়াজের ফসলোত্তর ক্ষতি (উৎপাদনের পর সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পর্যায়ে) অনেক বেশি হওয়ায় এখনো কিছু পরিমাণে পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। তবে তা তুলনামূলক কম। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২২ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ৮ কোটি ডলারের।
তবে স্থানীয় পর্যায়ের পর্যাপ্ত সরবরাহই দেশের বাজারে পণ্যটির মূল্যকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্থানীয় সরবরাহ পর্যাপ্ত হওয়ায় কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণে সামনের দিনগুলোয় পণ্যটি আমদানি বন্ধ করে দেয়াই উচিত হবে বলে অভিমত তাদের।
সাবেক কৃষি সচিব ও বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নাসিরুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পেঁয়াজের মতো কৃষিপণ্য আমদানি না করাই ভালো। আমাদের কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের দাম বেশি হলেও তা দিয়েই খাওয়া উচিত। সরকারের উচিত যেসব পণ্য দেশে ভালো উৎপাদন হয় তার আমদানি একেবারেই বন্ধ করে দেয়া। কৃষকের উৎপাদন খরচ অনুযায়ী তাকে টাকা দিতে হবে। এর চেয়ে কম দামে খেতে চাইলে বাজার অস্থিতিশীল হবেই। যেসব পণ্য আমাদের দেশে হয় না যেমন গম, মসুর ডাল—এগুলো আমদানি হোক। এগুলোয় কখনই আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারব না। কিন্তু যেসব পণ্য কৃষক উৎপাদন করেন তা দেশেই উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায় জোর দিতে হবে।’
দেশে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয় পাবনা জেলায়। চলতি মৌসুমে এখানে মোট ৫৩ হাজার ৩২০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সর্বশেষ মৌসুমে আবাদকৃত কন্দ বা মূলকাটা পেঁয়াজের ৯০ শতাংশের কর্তন শেষ হয়েছে। জেলায় ৮ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করা হয়েছিল। উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ৩৫৫ টন। ভারত থেকে আমদানি কমায় এবার তুলনামূলক ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে বলে জানালেন স্থানীয় কৃষকরা।
পেঁয়াজ উৎপাদনে এগিয়ে থাকা জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম রাজবাড়ী। এ বছর জেলাটিতে মোট ৩৪ হাজার ৯১০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘রাজবাড়ীতে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা সবসময় পেঁয়াজচাষীদের খোঁজখবর নিয়েছেন। এজন্য কৃষকদের আবাদে পরামর্শ দেয়ার পাশাপাশি প্রণোদনা হিসেবে সার, বীজ ও কীটনাশক দেয়া হচ্ছে। এ বছরও জেলায় ৬৫০ জন কৃষককে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে।’
কৃষিসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশী পেঁয়াজের সংরক্ষণযোগ্যতা আমদানীকৃত পেঁয়াজের চেয়ে বেশি। আমদানি হওয়া পেঁয়াজের সংরক্ষণযোগ্যতা নেই বললেই চলে। দেশে উৎপাদিত প্রায় ৬০ শতাংশ পেঁয়াজের সংরক্ষণযোগ্যতা অনেক ভালো। এগুলোর ফলন সবসময় একই থাকে। বাকি পেঁয়াজ হলো গ্রীষ্মকালীন ও মুড়িকাটা পেঁয়াজ।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেন, ‘পেঁয়াজের আমদানিনির্ভরতা বেশি থাকায় একসময় বাজারে অস্থিতিশীলতা থাকত। কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লেও দেশের বাজারে এর প্রভাব একেবারেই নেই। কৃষকরা আমাদের সবসময় অনুরোধ করে আসছেন যেন আমরা আমদানি না করি। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের উৎপাদন মৌসুমে যে ঘাটতি দেখা দিত, তা এখন হচ্ছে না। কৃষকরা এখন অনেক বেশি উৎপাদন করছেন। আশা করি ভবিষ্যতে কখনই পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হবে না। এজন্য তাদের বিভিন্ন প্রণোদনাও দেয়া হচ্ছে।’
পেঁয়াজের ক্ষতি কমিয়ে আনতে কৃষকদের সংরক্ষণ পদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘উৎপাদন ও সংরক্ষণে অনেক পেঁয়াজ নষ্ট হয়। আবার পেঁয়াজ সংরক্ষণ করলে শুকিয়ে এর ওজন কমে যায়। আমরা বিভিন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষকদের সংরক্ষণের উপায়গুলো নিয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।’