সিলেট অঞ্চলে গ্যাসের বড় মজুদ আবিষ্কারের জোরালো সম্ভাবনা

0

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : দেশে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সিলেট অঞ্চলে জোরালোভাবে জরিপকাজ চলছে। সিলেট গ্যাসফিল্ড লিমিটেডের (এসজিএফসিএল) আওতাধীন স্থলভাগে গ্যাস ব্লক ১৩ ও ১৪-এর পাঁচটি এলাকায় এরই মধ্যে থ্রিডি সিসমিক সার্ভে শুরু করেছে চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (সিএনপিসি) অধীন অনুসন্ধান ও জরিপকারী প্রতিষ্ঠান ব্যুরো অব জিওফিজিক্যাল প্রসপেক্টিং (বিজিপি)। এসব এলাকায় প্রায় তিন ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস পাওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে বলে দেশী-বিদেশী তিনটি জ্বালানি তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও জরিপকারী প্রতিষ্ঠানের তথ্য-উপাত্তে উঠে এসেছে।

এসজিএফসিএলের পক্ষ থেকে ২ মার্চ গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদ এলাকা নিয়ে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। জ্বালানি বিভাগের সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার প্রতিবেদনটি উপস্থাপনের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। প্রতিবেদনে এসজিএফসিএলের আওতাধীন গ্যাস মজুদ, উত্তোলন এবং সিলেট ও মৌলভীবাজারের পাঁচটি গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদ এলাকার তথ্য উঠে আসে।

এতে দেখানো হয়, ব্লক ১৩ ও ১৪-এর আওতাভুক্ত মৌলভীবাজার জেলার হারারগজ, বাতচিয়া ও ডুপিটিলা এবং সিলেট দক্ষিণ ও জকিগঞ্জ এলাকায় ২ হাজার ৮১৩ বিসিএফ গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদ রয়েছে। দেশী জ্বালানি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্স, মার্কিন কোম্পানি শ্লুমবার্জারস ও অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক ওয়েলড্রিল সম্ভাব্য গ্যাস মজুদের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময় সমীক্ষা চালায়।

এর মধ্যে মৌলভীবাজারের হারারগঞ্জে ৪৯২ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ), একই জেলার বাতচিয়ায় ৫৭৭ বিসিএফ, ডুপিটিলায় ৬৭৯ বিসিএফ, সিলেটের জকিগঞ্জ/আটগ্রামে ৮৮৬ বিসিএফ ও সিলেট দক্ষিণে ১৭৯ বিসিএফ সম্ভাব্য গ্যাস মজুদ রয়েছে।

জোরালো গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় এরই মধ্যে এসব এলাকায় থ্রিডি সিসমিক সার্ভে শুরু করেছে চীনা কোম্পানি বিজিপি। জরিপের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ শেষে কোম্পানিটির আগামী আগস্ট নাগাদ এসজিএফসিএলের কাছে ফলাফল উপস্থাপন করার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে এ দুটি ব্লকে থ্রিডি সিসমিক সার্ভের ৩০ শতাংশ কাজ শেষ করেছে চীনা অনুসন্ধানকারী দলটি।

গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদ এলাকাগুলো চিহ্নিত করতে শুরুতে টুডি এবং পরে থ্রিডি সিসমিক সার্ভে করা হয়। এরপর সেসব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে কূপ খনন এলাকা চিহ্নিত করা হয়। সম্ভাবনা খুব জোরালো হলেই কূপ খননের উদ্যোগ নেয়া হয়।

স্থলভাগের ১৩ ও ১৪ নম্বর ব্লকে এখন থ্রিডি সিসমিক সার্ভে চলছে। ওই অঞ্চল ও সংলগ্ন এলাকায় বেশকিছু গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানার অবস্থানও ১৩ ও ১৪ নম্বর ব্লকের কাছে। ফলে সেখানেও গ্যাস পাওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন ভূতাত্ত্বিকরা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক গঠনে দেশে আরো অনেক বেশি গ্যাসের মজুদ তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। বিশেষ করে যেখানে বড় বড় গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে তার আশপাশে আরো অনেক মজুদ থাকার সম্ভাবনা প্রবল। পৃথিবীর সব ডেল্টা এরিয়ায় গ্যাস আছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হবে না। বৈজ্ঞানিক সূত্র অনুযায়ী, এখানে গ্যাসের সম্ভাবনা খুবই ভালো। সে সম্ভাবনাকে বাস্তবায়নের জন্য আমাদের যে পরিমাণে অনুসন্ধান করা দরকার, আমরা কখনই সেটা করিনি।’

এসজিএফসিএল সূত্র জানিয়েছে, গ্যাস উন্নয়ন তহবিল ও সংস্থাটির নিজস্ব অর্থায়নে এ এলাকায় জরিপকাজ শুরু হয় ২০২১ সালে। এজন্য গৃহীত প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর আওতায় দুটি ব্লকের সিলেট গ্যাসফিল্ড এলাকার ৮৬৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় থ্রিডি সিসমিক সার্ভে করা হবে। আগামী বছরের জুনে প্রকল্পের কাজ চূড়ান্তভাবে শেষ হওয়ার কথা। এর মাধ্যমে হাইড্রোকার্বন রিজার্ভ ও রিসোর্স এস্টিমেট এবং নতুন কূপ খননের লোকেশন চিহ্নিত করা হবে বলে জানায় এসজিএফসিএল।

সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চীনা কোম্পানি জরিপকাজ পরিচালনা করছে। আমরা প্রত্যাশা করছি সেখানে গ্যাস রয়েছে। সে সম্ভাবনা থেকেই আরো গভীরে দেখার জন্য থ্রিডি সিসমিক সার্ভে করা হচ্ছে। তবে এ প্রকল্পের অগ্রগতি সন্তোষজনক। জরিপকাজের বিশ্লেষণ হাতে পেলে বিস্তারিত জানা যাবে। আগামী আগস্টের দিকে জরিপকাজের ফলাফল এসজিএফসিএল হাতে পাবে, তারপর বলা যাবে।’

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্লক ১৩ নম্বরের বাতচিয়া কমলগঞ্জ উপজেলার পাঁচ ইউনিয়ন ও কুলাউড়া উপজেলার দুটি ইউনিয়ন মিলিয়ে ১২০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় সার্ভে, ড্রিলিং ও তেল-গ্যাস মজুদ বিষয়ে রেকর্ডিং কাজ শেষ করা গেছে। একই প্রক্রিয়ায় তিনটি ধাপে কাজ শেষ হয়েছে ব্লক ১৪ নম্বরের হারারগজের আওতাভুক্ত কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের ৩৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকায়।

জ্বালানি বিভাগসংশ্লিষ্ট দুজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানে সরকার নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। অনেকগুলো প্রকল্পের কাজ চলছে। সিলেট অঞ্চলে গ্যাস মজুদের সমীক্ষা নিয়েও থ্রিডি সিসমিক প্রকল্পের কাজ চলছে। তবে গ্যাস আছে কিনা তা এখনই বলা যাবে না। কারণ থ্রিডি সিসমিকের পর গ্যাস কূপ খননের জায়গাগুলো চিহ্নিত করা হবে। এরপর সেখানে কূপ খনন করে চাপ ও মজুদের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া সাপেক্ষে বলা যাবে গ্যাস রয়েছে।

তবে যে পাঁচটি এলাকায় গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদ ক্ষেত্র চিহ্নিত হয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে আগেও গ্যাসের মজুদ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সিলেটের জকিগঞ্জে ২০২১ সালের আগস্টে দেশের ২৮তম গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। রাষ্ট্রীয় জ্বালানি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্স সেখানে ওই গ্যাসক্ষেত্রে ৬৮ বিসিএফ গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার করে।

ব্লক ১৩ ও ১৪ভুক্ত এলাকাগুলোর পাশেই রয়েছে রশিদপুর, বিয়ানীবাজার, জালালাবাদ ও পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র ছাতক। এর মধ্যে ছাতকে বিপুল পরিমাণ গ্যাস থাকলেও কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর সঙ্গে মামলা জটিলতার কারণে আজও তা উত্তোলন সম্ভব হয়নি।

দেশে গ্যাসের মজুদ নিয়ে ২০১০ সালে একটি সমীক্ষা চালায় মার্কিন প্রতিষ্ঠান গুস্তাভসন অ্যাসোসিয়েটস। তাদের পর্যবেক্ষণে দেশে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ। দেশে এমন অনাবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় গ্যাস সম্পদের সম্ভাব্য মজুদের পরিমাণ ৩৮ টিসিএফের কিছু বেশি। ৫০ শতাংশ সম্ভাবনার গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় সম্ভাব্য মজুদ প্রায় ৬৩ দশমিক ১৯ টিসিএফ। ওই সমীক্ষার পর সময় পেরিয়েছে এক দশকেরও বেশি।

বাংলাদেশে অনাবিষ্কৃত গ্যাসের মজুদ নিয়ে নরওয়ের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডিরেক্টরেটের (এনপিডি) সমীক্ষায় জানানো হয়, বাংলাদেশে অনাবিষ্কৃত গ্যাসের মজুদ রয়েছে ৪২ টিসিএফ। সম্প্রতি বাংলাদেশে ইউরোপীয় জ্বালানি তেল-গ্যাসবিষয়ক পরামর্শক সংস্থা র্যাম্বল জানিয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৩৪ টিসিএফ অনাবিষ্কৃত গ্যাস রয়েছে।

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.