ডলারে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সুবিধা রফতানিমুখী উৎপাদন শিল্পে
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : দেশে ক্রমাগতভাবে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ডলার সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে উৎপাদনমুখী শিল্পগুলো। ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন কার্যক্রম। আবার বিদেশী ঋণ নিয়ে নতুন শিল্প প্রকল্প স্থাপন পরিকল্পনাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নতুন আয়কর আইনের কারণে। কেননা এ ঋণের সুদের ওপর অনধিক ৩০ শতাংশ হারে করারোপের বিধান রাখা হয়েছে আইনটির ১১৯ নম্বর ধারায়। এ পরিস্থিতিতে দেশের রফতানিমুখী উৎপাদন শিল্পের জন্য ডলারে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেয়ার ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণ পরিশোধের মেয়াদ গ্রেস পিরিয়ডসহ সর্বোচ্চ ১০ বছর।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন স্কিম অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন সুবিধার (বিবি-এলটিএফএফ) আওতায় একক ঋণগ্রহীতা একটি ব্যাংক থেকে ৫০ লাখ এবং একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন সর্বোচ্চ ১ কোটি ডলার। আর এ ঋণ পরিশোধের সময় পাওয়া যাবে ১০ বছর পর্যন্ত। তবে এ তহবিলের বিপরীতে গ্রাহক পর্যায়ে সুদহার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রদত্ত হারের সঙ্গে ব্যাংকগুলো তাদের ঋণ-খরচ, পরিচালনা ব্যয় বিবেচনা করে নিজস্ব ঋণের সুদহার নির্ধারণ করবে। এক্ষেত্রে একটি যুক্তিসংগত ঝুঁকি সামঞ্জস্যপূর্ণ স্প্রেড ও লাভের মার্জিন রাখবে, যা হবে ১-২ শতাংশের মধ্যে।
জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এটা বেশ ভালো একটা উদ্যোগ। বিশেষ করে বর্তমান সময় বিবেচনায় নিয়ে রফতানিমুখী উদ্যোক্তাদের জন্য স্কিমটি বেশ উপকারে আসবে। বিদ্যমান ও নতুন রফতানিকারক স্বল্প সুদে এ স্কিম থেকে ঋণ নিতে পারবেন বলে আশা করছি।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকসংশ্লিষ্টদের দাবি, বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় আগের ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর সাপোর্ট প্রজেক্টের (এফএসএসপি) আওতায় দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন সুবিধা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। যেসব প্রকল্পে ঋণ ছাড় করা হয়েছিল, সেগুলোর প্রায় সবই পরিশোধ হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে আগের তহবিল থেকেই এখন বেসরকারি খাতে প্রধানত রফতানিমুখী উৎপাদন শিল্পগুলোকে এলটিএফএফ চলমান রাখতেই নতুন এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিষয়টি জানিয়ে ১৬ জুলাই দেশের সব তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বরাবর প্রজ্ঞাপন আকারে চিঠিও দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, দেশে ফরেন এক্সচেঞ্জের অনুমোদিত ডিলারদের (এডি) পুনঃঅর্থায়নের জন্য বিবি-এলটিএফএফ দেয়া হবে ডলারে। ব্যাংকের এডি শাখার মাধ্যমে রফতানিকারক ও বেসরকারি খাতের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এ সুবিধা পাবে।
বিবি-এলটিএফএফ পরিচালন নির্দেশিকা অনুযায়ী ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে যে ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের ঋণ দিয়েছে, সে ঋণগুলোও পুনঃঅর্থায়নের জন্য বিবি-এলটিএফএফ পাওয়ার যোগ্য হবে। এ অর্থায়ন সুবিধায় অংশ নেয়ার জন্য আগ্রহী ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক খাত সহায়তা ও কৌশলগত পরিকল্পনা বিভাগে (এফএসএসএসপিডি) আবেদন করতে হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রফতানিমুখী শিল্পকে আমরা উৎসাহিত করতে চাচ্ছি। এসব শিল্পের আয় হয় ডলারে। আমরা যদি দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নটাও ডলারে করতে পারি তাহলে মুদ্রা বিনিময় হারের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকা যায়। তাই এ ধরনের একটা তহবিল সুবিধা সংশ্লিষ্ট শিল্পগুলোকে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’ দেশে এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন সুবিধা নেই জানিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, ‘বর্তমানে যে সুবিধাগুলো আছে সেগুলোর মেয়াদ সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের, যেগুলোর অর্থ পরিশোধে আট-দশ বছর লেগে যায়। বেশ কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একটা উদ্যোগ ছিল, যার আওতায় এরই মধ্যে সফল বেশকিছু প্রকল্প গড়ে উঠেছে। সেই সাফল্যের ভিত্তিতে এখন নতুনভাবে অর্থায়ন সুবিধা চালু করা হয়েছে। এ ঋণের ব্যাপক চাহিদাও রয়েছে। এ কর্মসূচির লক্ষ্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রকৃত উৎপাদনকে উৎসাহিত করে রফতানিমুখী শিল্প খাতের সম্প্রসারণ নিশ্চিত করা।’
জানা গেছে, এফএসএসপির আওতায় বিশ্বব্যাংক থেকে ২৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার পেয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই প্রকল্প থেকে নেয়া ঋণ এরই মধ্যে পরিশোধ হচ্ছে। অনেক প্রকল্পের অর্থ পুরোপুরি পরিশোধও হয়েছে। ডলারে ঋণ নিয়ে গড়ে ওঠা সফল প্রকল্পের একটি সোনারগাঁয় এসিআই হেলথ। প্রকল্পটিতে উৎপাদিত ওষুধপণ্য রফতানিও হচ্ছে। এ ধরনের সফলতার ধারাবাহিকতা ধরে রেখে রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাড়াতেই চালু করা হয়েছে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের নতুন স্কিম বিবি-এলটিএফএফ।
দেশের বিদ্যমান রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোও বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগকে বেশ ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। তারা মনে করে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগটি প্রকৃত অর্থেই রফতানিকারকদের উপকারে আসবে। পাশাপাশি রফতানিমুখী শিল্পে নতুন উদ্যোগকেও ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করবে।
জানতে চাইলে রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যদি ১০ বছর মেয়াদি অর্থায়ন ডলারে দেয় তা বেশ উৎসাহব্যঞ্জক। বিশেষ করে নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য এটা ভালো উদ্যোগ। পাশাপাশি বিদ্যমান রফতানিমুখী শিল্পগুলো যদি সক্ষমতা বাড়াতে চায় তাদের জন্যও বেশ উপকারে আসবে এ স্কিম।’ বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনেরও নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। বিবি-এলটিএফএফ স্কিমকে সাধুবাদ জানিয়ে এ ব্যবসায়ী নেতা আরো বলেন, ‘বর্তমানে বিশ্বব্যাপী একটা সংকট চলছে। আর এমন একটা সময়ে বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত সময়োপযোগী উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন স্কিমটি নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ দেখিয়েছে পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ। এরই মধ্যে সংগঠনটি তাদের সদস্যদের এ সুবিধা নেয়ার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে চিঠি দিয়েছে। বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান স্বাক্ষরিত ১৬ জুলাইয়ের ওই চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলারের মাধ্যমে উৎপাদন খাতে, বিশেষত রফতানিমুখী শিল্পের জন্য ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। ওই তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির সুযোগ রয়েছে। আমরা আশা করি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটকালীন ওই তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে তৈরি পোশাক রফতানিকারকরা উপকৃত হবেন।