বদলে যাচ্ছে আট বিমানবন্দর
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে বদলে যাচ্ছে দেশের আট বিমানবন্দর। বিমানবন্দরের উন্নয়নে সরকার প্রায় ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ব্যয় করছে। বিমানবন্দর উন্নয়নের এই নতুন সুবিধাগুলো চলতি বছরের অক্টোবর থেকে পর্যায়ক্রমে চালু হবে। এসব কার্যক্রমের ফলে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক রুটে সেবার মানোন্নয়ন ও উড়োজাহাজ ও যাত্রী ধারণ সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বর্তমান সরকার এভিয়েশন খাতের উন্নয়নে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পগুলো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ জন্য তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও পাঁচটি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরে কাজ চলমান রয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের কাজ ৮৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। কক্সবাজার বিমানবন্দরের উন্নয়ন, সিলেট বিমানবন্দরের রানওয়ে ও ট্যাক্সিওয়ে এবং বেবিচকের সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ কমপক্ষে সাতটি প্রকল্পের কাজ চলতি বছরের শেষ নাগাদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাজশাহী, যশোর, সৈয়দপুর, কক্সবাজার, বরিশালে রানওয়ে শক্তিশালীকরণ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। রানওয়ে বড় হলে বড় উড়োজাহাজ অনায়াসে ওঠানামা করতে পারবে। রাজশাহীতে আরেকটি টার্মিনাল বিল্ডিং করা হবে। এ জন্য দরপত্র আহ্বান করা হবে এবং কনসালটেন্ট নিয়োগ করা হবে। সিলেটে নতুন টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের কাজ চলছে। এ কাজগুলো শেষ হলে যাত্রীসেবার মান বাড়বে।’ চলমান উন্নয়ন কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ, কক্সবাজারে দেশের দীর্ঘতম রানওয়ে স্থাপন, ছয়টি বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ, কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রাথমিক সুযোগ-সুবিধার উন্নয়ন। মেগা প্রকল্প তৃতীয় টার্মিনালের কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। আগামী অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই টার্মিনাল উদ্বোধন করবেন। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে বর্তমানে যে দুটি টার্মিনাল রয়েছে, তার যাত্রী ধারণক্ষমতা বছরে প্রায় ৭০ লাখ। তৃতীয় টার্মিনাল তৈরি হলে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ২ কোটির কাছাকাছি। ভবনের ভিতরে থাকবে পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য ও অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তির ছোঁয়া।
বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে মেট্রোরেল। তৈরি হবে পৃথক একটি স্টেশনও। টার্মিনালের ভিতরের ভবনটির নকশা তৈরি করেছেন বিখ্যাত স্থপতি রোহানি বাহারিন। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এই প্রকল্প ব্যয় নির্ধারিত হয়েছে ২১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা। মোট খরচের মধ্যে সরকার দেবে ৫ হাজার ২৫৮ কোটি এবং ঋণ হিসেবে জাপানের সংস্থা জাইকা দেবে ১৬ হাজার ১৪১ কোটি টাকা।
মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম থেকে জানান, উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমানবন্দর ‘চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’। আধুনিকায়নের জন্য নেওয়া প্রকল্পগুলোর সুফল পেতে শুরু করেছেন যাত্রীরা। বিমানবন্দরের রাজস্ব আয় এক বছরেই হয়েছে দ্বিগুণ। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক উইং কমান্ডার তাসলিম আহমেদ বলেন, ‘শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে ও ট্যাক্সিওয়ের কাজ চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হবে। সেবার মান উন্নত এবং আধুনিক হওয়ায় যাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ফলে গত অর্থবছরে রেকর্ড ২০০ কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব আয় করেছে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।’ জানা যায়, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিমানবন্দরের রানওয়ে ওভারলেকরণ প্রকল্পের কাজের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৯৫ শতাংশ। ৫৪০ কোটি টাকায় এ প্রকল্প চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। বিমানবন্দরের প্যাসেঞ্জার ও কার্গো সিকিউরিটি সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণের জন্য প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে বেবিচক। এরই বিস্তারিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, ড্রয়িং ডিজাইন, ব্যয় প্রাক্কলন ও মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তুতসহ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট থেকে জানান, কাজ শুরুর পর জানা গেল নকশায় ভুল। আর এই ভুল নকশায় কাজ করলে একসময় ভেঙে ফেলতে হবে নবনির্মিত টার্মিনাল ভবন। তাই থমকে দাঁড়ায় সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ মেগা প্রকল্পের কাজ। সময় বাড়িয়েও তিন বছরে প্রকল্পের সিকিভাগ কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নকশা সংশোধন করে কাজ শেষ করতে প্রকল্পের মেয়াদ আরও অন্তত দুই বছর বাড়াতে হবে। আর এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাড়বে সিলেটের সরাসরি ফ্লাইট। সূত্র জানায়, ওসমানী বিমানবন্দর সম্প্রসারণ মেগা প্রকল্পটি সরকারের অনুমোদন পায় ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর। ২০২০ সালের ১ অক্টোবর ভার্চুয়াল কনফারেন্সের মাধ্যমে এই প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চলতি বছরের মে মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর বেবিচক প্রকল্পের মেয়াদ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করে। কিন্তু এর মধ্যে শেষ হয়েছে মাত্র ২২ শতাংশ কাজ।
ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক শাহ জুলফিকার হায়দার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, নকশায় ত্রুটি ধরা পড়ায় ওসমানী বিমানবন্দর সম্প্রসারণ কাজে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। সংশোধিত নকশার ড্রাফট জমা হয়েছে। এটি যাচাই-বাছাই চলছে। কিছু সংশোধন আছে, এরপর চূড়ান্ত হবে। নকশা চূড়ান্ত হতে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের প্রায় ২২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। তবে প্রকল্পের মেয়াদ আরও অন্তত দুই বছর বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে। কক্সবাজার প্রতিনিধি আয়ুবুল ইসলাম বলেন, কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে নির্মাণের ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। লাইটিংসহ কিছু কাজ বাকি রয়েছে। শেষের পথে ডমেস্টিক টার্মিনাল নির্মাণও। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পর্যটন নগরী কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকার বেশি খরচ পড়ছে। প্রথমবারের মতো দেশে সমুদ্রবক্ষের ওপর ১ হাজার ৭০০ ফুট রানওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। মহেশখালী চ্যানেলের দিকে এ বিমানবন্দর সম্প্রসারণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য হবে ১০ হাজার ৭০০ ফুট। এরপরের অবস্থান হবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের; যার দৈর্ঘ্য ১০ হাজার ৫০০ ফুট। কক্সবাজার বিমানবন্দর রানওয়ে সমুদ্রে সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক মো. ইউনুস ভূঁইয়া বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের অবশিষ্ট কাজ শেষ করা হবে। তখন দেশের সর্ববৃহৎ রানওয়ের এই কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দিবারাত্রি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ওঠানামা সম্ভব হবে। নতুন রানওয়ের পুরোটা অংশ থাকছে সাগরজলের ওপর। কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক গোলাম মোর্তজা বলেন, সমুদ্রজলের ওপর নতুন রানওয়ের নির্মাণকাজ শেষ হলে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ সহজেই ওঠানামার সুযোগ পাবে। সৈয়দপুর প্রতিনিধি জিকরুল হক জানান, সৈয়দপুর বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনের আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পের কাজ শেষের পথে। আধুনিকায়ন শেষে এই টার্মিনালের যাত্রী ধারণক্ষমতা ৩১০ জন থেকে বেড়ে ৬৭০ হবে। এ ছাড়াও, কিছু অটোমেশন সুবিধাসহ একটি কার্গো ভবন, অ্যাপ্রোনসহ অপারেশন ভবন, ট্যাক্সিওয়ে ও একটি নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার নির্মাণ করা হবে। বিমানবন্দর ব্যবস্থাপক সুপ্লব কুমার ঘোষ বলেন, যাত্রী সেবার মান বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেবার মান বাড়লে বিমানবন্দরের সমৃদ্ধি ঘটবে। ৩৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে বরিশাল বিমানবন্দরের রানওয়ে ৬ হাজার থেকে সাড়ে ৭ হাজার ফুটে উন্নীত করা হচ্ছে। রানওয়ের প্রস্থ ১০০ ফুট থেকে বাড়িয়ে ১৫০ ফুট করা হচ্ছে। ৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহী টার্মিনাল ভবন সম্প্রসারণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর ফলে বিমানবন্দরটির যাত্রী ধারণক্ষমতা ২৬০ থেকে বেড়ে ৮৫০ হবে। যশোর টার্মিনাল ভবন সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে যাত্রী সক্ষমতা ৩০০ থেকে বাড়িয়ে ৬০০ করা হবে। এ প্রকল্পের ৯৯ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এ ছাড়াও যশোর ও রাজশাহী বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ অবতরণ ও উড্ডয়ন সহজ করতে ৫৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।