ব্রিকসে ভর করে আফ্রিকায় খুলবে সম্পর্কের দুয়ার
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত ব্রিকস জোট। এই মুহূর্তে ব্রিকসের সদস্য পদ পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছে বাংলাদেশ। বরং ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দেয়াকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ আফ্রিকা মহাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন দুয়ার খোলার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ মনে করছে, ব্রিকসের সদস্য পদ পাওয়া নিয়ে এত তাড়াহুড়ো নেই। এই সম্মেলনকে কাজে লাগিয়ে আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক হলে বাংলাদেশেরই লাভ হবে। গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্রিকস সম্মেলনে যোগদানের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানাতে আসা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বিষয়গুলোকে এভাবেই ব্যাখা করেন। তিনি বলেন, আমরা এবার আফ্রিকাতে সম্পর্ক বাড়াতে চাই, যেখানে ব্রিকসের মাধ্যমে যেতে সুবিধা হবে। আফ্রিকায় আমাদের (ভালো) সুযোগ রয়েছে, বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্যে। আমাদের বিশ্বাস এতে আমাদের সম্পর্কের উন্নতি ঘটবে। সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম এবং পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, বিশ্ব অর্থনীতির এক চতুর্থাংশের নিয়ন্ত্রণকারী পাঁচটি দেশের জোট ব্রিকসের সম্মেলন শুরু হচ্ছে আগামী ২২ আগস্ট। এতে যোগ দিতে আগামীকাল মঙ্গলবার দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার আমন্ত্রণে এই সফরে যাচ্ছেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, ব্রাজিলের লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্মেলনে অংশ নেবেন। রয়টার্স জানিয়েছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন এ বৈঠকে যোগ দিচ্ছেন না। বাংলাদেশ এই জোটে সদস্য হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। জোটের সদস্য না হলেও বাংলাদেশ এরমধ্যে ব্রিকসের অধীনে থাকা নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সদস্য হয়েছে। সম্মেলনের ফাঁকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব রাষ্ট্রদূত শমসের মবিন চৌধুরী গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, ব্রিকস সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি ব্রিকস সম্মেলনে গিয়ে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। এতে আফ্রিকায় বাংলাদেশের নতুন বাজার চালু হতে পারে। তবে তিনি ব্রিকসের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, জোটের দুই সদস্য ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা আইএমএফ থেকে লোন নিয়ে চলে। এরফলে এই জোট ভবিষ্যতে কতটুকু কার্যকর থাকবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তবে ব্রিকসের ব্যাংকের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় বাংলাদেশ লাভবান হবে বলে মনে করেন তিনি।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক গতকাল একটি সেমিনারে বলেন, আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসে যোগদানের জন্য এখনই সঠিক সময় বাংলাদেশের। তবে ওই অর্থনৈতিক জোটে যোগ দেয়ার বিষয়টি যতটা না ভূ-অর্থনৈতিক, তার থেকে বেশি ভূ-রাজনৈতিক। জোটে বাংলাদেশের যোগদানের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার বিবেচনায় এখানে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ আছে। প্রথমটি হচ্ছে, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। ২০২৬-এর পর বাংলাদেশ কীভাবে পরিবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলা করে, সেটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা এবং তৃতীয়টি হলো বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। তিনি বলেন, আমাদের নীতি হচ্ছে ভারসাম্য রক্ষা করা। কিন্তু তার মানে এই নয়- এটি সবসময় সমান ভারসাম্যে থাকে। কিছু সময়ে আমরা একদিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়ি এবং যখন সময় আসে তখন আবার ভারসাম্য অবস্থায় ফিরে আসি। বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ঝুঁকে পড়ার পর আবার ভারসাম্য অবস্থায় ফিরে আসা।
এদিকে, সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থানকালে প্রধানমন্ত্রী ব্যস্ত সময় পার করবেন। ২৩ আগস্ট তিনি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) কর্তৃক
যৌথভাবে আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড বিজনেস সামিটে’ যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন প্রধানমন্ত্রী। ওইদিন সরকার প্রধান আফ্রিকার দেশগুলোতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতদের অংশগ্রহণে আয়োজিত আঞ্চলিক দূত সম্মেলনে অংশ নেবেন। একইদিন প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ব্রিকস সদস্য রাষ্ট্রগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন জানিয়ে মোমেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতিসহ ব্রিকস সদস্য দেশগুলোর সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের কথা রয়েছে। ওইদিন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী ব্রিকসের বর্তমান চেয়ার এবং দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি আয়োজিত রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় যোগ দেবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, আগামী ২৪ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী ‘ব্রিকস আফ্রিকা আউটরিচ অ্যান্ড দ্য ব্রিকস প্লাস ডায়ালগ’-এ অংশ নেবেন। এ ডায়ালগে ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দেবেন। ওইদিন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থানকালে প্রধানমন্ত্রীর অন্যান্য কার্যক্রম সম্পর্কে ড. মোমেন বলেন, সফর চলাকালে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এ সফরের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় হবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হবে। আফ্রিকা অঞ্চলে আমাদের পরিধি বেড়েছে। তবে এটার সুবিধা পেতে একটু সময় লাগবে। এর মধ্যে কেনিয়া রুয়ান্ডাতে দুটি ওষুধ কারখানা তৈরি করেছে বাংলাদেশ। এতে মহাদেশটির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বাড়ছে। তানজানিয়া, সোয়াতিনিয়াতেও কন্ট্রাক্ট ফার্মে কাজ করছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, এ মুহূর্তে ব্রিকস নতুন সদস্য করবে কিনা জানি না। তবে আমরা এর মধ্যে ব্যাংকে যোগদান করেছি, আমরা কয়েকটি প্রকল্পে অর্থ সহায়তা পেয়েছি। আমরা এবার আফ্রিকাতে সম্পর্ক বাড়াতে চাই, যেখানে ব্রিকসের মাধ্যমে যেতে সুবিধা হবে। আফ্রিকায় আমাদের (ভালো) সুযোগ রয়েছে, বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্যে। আমাদের বিশ্বাস এতে করে আমাদের সম্পর্কে উন্নতি ঘটবে। সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠক করবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী যখন জোহানেসবার্গে থাকবেন, রাষ্ট্রপ্রধানদের সাক্ষাতগুলো শেষ মুহূর্তে হয়। তবে অবশ্যই অনেক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে। দ্বিপক্ষীয়ভাবে হবে। আর ব্রিকসে যোগদানে বাংলাদেশের সর্বশেষ অবস্থা কী- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনারা জানেন, যখন জেনেভাতে প্রধানমন্ত্রী গিয়েছিলেন, তখন দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত তার সঙ্গে দেখা করে তাকে দাওয়াত দেন। তখন তিনি বলেছিলেন, তারা ব্রিকসের সদস্য সংখ্যা বাড়াতে চান। এখন তারা পাঁচজন, এটা বাড়াতে চান। বাংলাদেশকেও তাদের সদস্য করার চিন্তাভাবনা করছেন। তবে চূড়ান্ত হয়নি। এখন শুনতে পেয়েছি তারা এ মুহূর্তে নতুন সদস্য নেবেন কিনা- তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ তারা একটা পদ্ধতি তৈরি করবেন- কী প্রেক্ষাপটে নেবেন, কী কী হবে…। এটা কোনো ব্যাপার না। আমরা কোনো তাড়াহুড়ো করব না। এর মধ্যে আমরা ব্রিকস ব্যাংকে যোগদান করেছি। তাদের প্রায় পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার রিজার্ভ আছে। এখন যারা আমাদের উন্নয়ন অংশীদার, তাদের অনেকেই ইদানীং খুব একটা সাহায্যে আসছে না। আর সামনে আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)। যখন আমরা এসডিজি অ্যাপ্রæভ করি, তখন কথা ছিল, এসডিজির জন্য প্রতি বছর সাড়ে তিন ট্রিলিয়ন থেকে ১১ ট্রিলিয়ন পর্যন্ত লাগবে। কিন্তু সেই টাকাটা কেউ দিচ্ছে না।
এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, সরকার দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত উভয় দেশেই বেশ কয়েকটি বৈঠক করার পরিকল্পনা করছে। যেহেতু আমাদের দক্ষিণ আফ্রিকায় সীমিত সময় থাকবে, আমরা সেই সভাগুলো (সরকার ও রাজ্যের প্রধানদের সঙ্গে) করার চেষ্টা করব যেগুলো সম্ভব এবং বাকিগুলো নয়া দিল্লিতে হতে পারে।
এদিকে, নাম উল্লেখ না করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মোদি জোহানেসবার্গে উপস্থিত কয়েকজন নেতার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। আগামী সেপ্টেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠিতব্য জি-২০ সম্মেলনেও যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৯-১০ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে ১৮তম জি-২০ সম্মেলন হবে।