সুবর্ণচরে গড়ে উঠেছে অ্যাগ্রো-ইকোট্যুরিজম
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : প্রবেশ মুখে সুন্দর একটি গেট। গেট দিয়ে এগিয়ে গেলে রাস্তার দুই পাশে সারি সারি নারিকেল গাছ। রয়েছে লেক। লেকের ওপর হাঁসের খামার। খামারের ঠিক মাঝখানে দ্বোতলা দু’টি বিল্ডিং। একটি প্রকল্প পরিচালক ও খামার সংশ্লিষ্টদের জন্য। অন্যটি রেস্ট হাউজ।
নোয়াখালী জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সুবর্ণচর ডাল ও তৈলবীজ বর্ধন খামার এটি। ডাল ও তৈলবীজ উৎপাদন এবং তা নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের কৃষকদের মধ্যে সরবরাহের লক্ষ্যে এই খামারটি একটি প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হলেও এটি এখন আদর্শ সমন্বিত কৃষি খামারে রূপ নিয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ খামারে গিয়ে উপভোগ করছেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের টানছে এই সমন্বিত খামারটি। বিএডিসির সুবর্ণচর খামারটি সমন্বিত খামার ব্যবস্থার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গহিন বন থেকে যেভাবে সমন্বিত খামার
নোয়াখালী বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর অন্যতম। এখানে অনেক চর রয়েছে। হাতিয়াকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হিসেবে বিবেচনায় নিলে সুবর্ণচর নোয়াখালীর সর্ব দক্ষিণের উপজেলা। এক সময় গহিন অরণ ছিল এই এলাকা। ছিল ডাকাতের উৎপাত। ১৯৫৯ সালে সাগরের পলি পড়ে সুবর্ণচর উপজেলার সৃষ্টি। সুবর্ণচরের কৃষক ধান ও অন্যান্য ফসলের উন্নত জাতের বীজের অভাবে যথেষ্ট পরিমাণ ফসল উৎপাদন করতে পারছিল না। এ পরিস্থিতিতে সুবর্ণচরের ফসল আবাদ কৃষকের জন্য অলাভজনক ছিল। উপরন্তু দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরী প্রভাবে বন্যা-খরা, সাইক্লোন ও জমির লবণাক্ততা বেড়ে গিয়ে বেশির ভাগ জমি চাষাবাদের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল। সম্প্রতি জলবায়ুর পরিবর্তন দক্ষিণাঞ্চলের কৃষির জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা বিবেচনায় ২০১১ সালের ০২ অক্টোবর তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এডিপি সভায় নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় একটি বীজ বর্ধন খামার স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রথম পর্যায়ে ২০১৩-২০১৮ মেয়াদে সমাপ্ত ‘নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় ডাল ও তৈল বীজ বর্ধন খামার এবং বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে ১২৬.৭৪ একর আয়তন বিশিষ্ট একটি খামার ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। চলমান প্রকল্প : ১ম পর্যায়ে ১২৬.৭৪ একর জমিতে স্থাপিত বীজ বর্ধন খামারটিকে আরো ৫০ একর সম্প্রসারণ এবং আধুনিকীকরণের নিমিত্তে এপ্রিল-২০১৯ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ মেয়াদে ‘নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় ডাল ও তৈল বীজ বর্ধন খামার আধুনিকীকরণ এবং চুক্তিবদ্ধ চাষিদের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পটির কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়, জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের চর এলাকার চাষিদের নিকট গুণগত মানসম্পন্ন ডাল ও তৈলবীজ উৎপাদন ও সরবরাহ; চর এলাকার প্রতি একর জমিতে ডাল ও তৈল ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টিমান উন্নয়ন করা : পরিবেশবান্ধব চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করে খামার ও এর পাশের এলাকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা; খামার ও প্রকল্প এলাকায় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষক ও চুক্তিবদ্ধ চাষিদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা; হাঁসমুরগি ও প্রাণী পালন : সুবর্ণচর অঞ্চলে হাঁস, মুরগি ও মহিষ পালন খুবই জনপ্রিয়। সুবর্ণচরের ব্র্যান্ডিং হলো মহিষ। জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, ভূমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধির জন্য জৈব সার ও ভার্মিকম্পোস্ট সার তৈরির জন্য মহিষ পালন করা হয়। গবাদিপশু ও হাঁসমুরগির বর্জ্য জমিতে প্রয়োগের মাধ্যমে মাটিতে বিদ্যমান লবণাক্ততা দূর করা হচ্ছে।
মাটির লবণাক্ততা দূরীকরণ : লবণাক্ততার কারণেই চরাঞ্চলের ফসল আবাদে সফলতা আসে না। রবি মৌসুমে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে যায়। কোনো কোনো সময় লবণাক্ততার মাত্রা ৩০-৪০ ডিএস/মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। আবার বর্ষাকালে কোনো লবণাক্ততা থাকে না। উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জমির লবণাক্ততা কমিয়ে ফসল আবাদের উপযোগী করা যায়। খামারের জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ জৈব সার প্রয়োগ, লিচিং ও ওয়াশ এওয়ে পদ্ধতি, লবণাক্ত সহিষ্ণু জাত নির্বাচন, রাসায়নিক সার ব্যবহার এবং শুষ্ক মৌসুমে জমি পতিত না রেখে লবণাক্ততা কমিয়ে আনা হচ্ছে।
কী নেই খামারে? এখানে ফসল উৎপাদন, প্রাণী পালন, মৎস্যচাষ ও বনায়নের অপূর্ব সমন্বয়ে একটি নান্দনিক সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য বিভিন্ন উচ্চ ফলনশীল জাতের ডাল, তৈল এবং অন্যান্য ফসলের বীজ উৎপাদন হলেও এখানে বিভিন্ন উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের উন্নত জাতের উচ্চ ফলনশীল ফুল ও ফলের চারা রোপণের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ জার্মপ্লাজম সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। এখানে ৬৫০টি নারিকেল, ২০০০টি সুপারি, ৫০০টি তাল, ১০০টি খেজুর, ২০০টি পেয়ারা, ২৫টি বিলাতি গাব, ১৫০টি লেবু, ১০০টি মাল্টা, ১০টি কমলা, ৫টি আপেল, ২০০টি আম, ৪০০টি পেঁপে, ৫০টি জাম্বুরা, ২৫টি আমড়া, ১০০টি কাঁঠাল, ২০০টি কলা, ৫০টি বলসুন্দরী কুল, ২৫টি কাজু বাদাম, ২০টি কাঠবাদাম, ১০টি রাম্বুটান, ১০টি সফেদা, ১০টি জামরুল, ১০টি জলপাই, ১০টি ঢেউয়া, ১০০টি ঝাউ, ২০০টি মেহগনি, ১০টি বট, ৫টি জাতের ১৫০টি বাঁশ, ৩০টি কৃষ্ণচূড়া, ৫০টি সোনালু, ৫০টি জারুল, বেল, তেঁতুল, হরীতকী, আমলকি, সজনে, থাই শরিফা ইত্যাদি গাছের বাগান সৃজন করা হয়েছে; যা দেখে প্রতিকূল পরিবেশে ফলের আবাদে কৃষকরা আকৃষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়াও জবা (লাল, হলুদ, সাদা, গোলাপি), গোলাপ, গন্ধরাজ, শিউলি, বকুল, কামিনী, জুঁই, এলামুন্ডা, দোপাটি, মরিচফুল, বাসর লতা, কুঞ্জলতা, অপরাজিতা, নীলকণ্ঠ, সাদাকণ্ঠ, স্থলপদ্ম, জলপদ্ম, মাদবীলতা, হাসনাহেনা, বেলী, কাঠগোলাপ, মেক্সিকান পিটুনিয়া, মেক্সিকান রোজ, কলাবতী, রক্তকরবী, বকফুলসহ বাহারী ফুলের গাছপালা রয়েছে। এখানকার সংরক্ষিত বনে স্থানীয় পশুপাখি ও পরিযায়ী পাখির অভয়ারণ্য রয়েছে।
রাতে শিয়ালের ডাক : সূর্য ডোবার পর নেমে আসে নিরবতা। যদি হয় জোসনার রাত, তাহলে তো কথাই নাই। খামারের ঠিক মাঝখানে রেস্ট হাউজ থেকে সন্ধ্যার পর থেকেই শোনা যাবে শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক। জানালা খুললেই দেখা মিলবে শিয়ালের দল। প্রকল্প পরিচালক মো: আজিম উদ্দিন বলেন, শীতকালে দেশী ও পরিজায়ী পাখির কলকাকলিতে প্রকল্পের খামার এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা মুখরিত থাকে। এখানে কৃষি প্রযুক্তির পাশপাশি অ্যাগ্রো-ইকোট্যুরিজমের পরিবেশ গড়ে উঠেছে। প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক এবং নানা শ্রেণী ও পেশার লোকজন বেড়াতে আসেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, পদস্থ কর্মকর্তা, মন্ত্রী, সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কাছে এলাকার কৃষি প্রযুক্তি বিস্তারের পাশাপাশি একটি বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে দিন দিন এটি জনপ্রিয় হচ্ছে। বিশেষ করে এখানকার মহিষ, ভেড়া, হাঁস-মুরগির খামারের পাশাপাশি নানা জাত ও প্রজাতির বিভিন্ন রঙ্গের ফুল-ফল খামারটিকে একটি বৈচিত্র্যময় কৃষিপ্রযুক্তির কেন্দ্রে পরিণত করেছে।