বাংলাদেশ-ফ্রান্স দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নতুন মাত্রায়

0

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর সোমবার যৌথ বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনা ও ম্যাক্রোঁর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তার আগে দুই নেতা একান্ত বৈঠকেও মিলিত হন। দুই নেতার উপস্থিতিতে ঢাকা ও প্যারিসের মধ্যে দুটি চুক্তিও সই হয়েছে। সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ফরাসি প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছলে শেখ হাসিনা টাইগার গেটে ফুলের তোড়া দিয়ে তাকে স্বাগত জানান। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ত্যাগের আগে ম্যাক্রোঁ পরিদর্শক বইতে স্বাক্ষর করেন।

শেখ হাসিনা তার বিবৃতিতে বলেন, আজ ফ্রান্স ও বাংলাদেশের মধ্যে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি ঐতিহাসিক দিন যা পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে বিকশিত হচ্ছে। আমার পিতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে যে বন্ধুত্বপূর্ণ বন্ধনের সূচনা করেছিলেন তা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে দ্বিপাক্ষিক সমগ্র বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। ফ্রান্স বাংলাদেশের সার্বভৌম নীতি, স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সমর্থন প্রকাশ করেছে, বিশেষ করে চলমান ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে। আমরা উভয়েই আশা করি বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে এই নতুন কৌশলগত পদক্ষেপ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

তিনি আরও বলেন, গত দেড় দশকে বাংলাদেশে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা, উন্নয়ন ও সুশাসনের ওপর ভিত্তি করে এই নতুন সম্পর্কের ভিত রচিত হয়। ফ্রান্স সরকার জনগণের মৌলিক ও মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বশীল ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে।
সরকারপ্রধান আরও বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির দর্শনীয় ও ধারাবাহিক অগ্রগতিতে ফরাসি সরকারের আস্থা ও প্রশংসা ব্যক্ত হয়েছে। তিনি বলেন, জিএসপি প্লাস প্রকল্পের অধীনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য সুবিধা বাংলাদেশের জন্য অব্যাহত রেখে ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে ফ্রান্স।

দ্বিপাক্ষিক বৈঠক সম্পর্কে তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অগ্রগতির লক্ষ্যে আমরা বিশদ আলোচনা করেছি এবং কিছু বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি। বাংলাদেশের বিশ্বস্ত উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে শেখ হাসিনা বলেন, অবকাঠামো উন্নয়নে ফ্রান্স আমাদের অব্যাহত সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। তারা বাংলাদেশের কৌশলগত নিরাপত্তা অবকাঠামো নির্মাণে উন্নত ও বিশেষায়িত প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানেও আগ্রহ দেখিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নেতৃস্থানীয় এবং দায়িত্বশীল আবাসিক শক্তি হিসাবে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কাজ করবে।

সরকারপ্রধান উল্লেখ করেন, আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় ফ্রান্সের নেতৃত্বকে স্বাগত জানাই এবং একটি টেকসই তহবিল গঠনের জন্য প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর আহ্বানের প্রশংসা করি। এছাড়া বৈঠকে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বিনিময় নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে কার্যকর আলোচনা হয়েছে বলেও জানান শেখ হাসিনা। বৈঠকের শুরুতেই শেখ হাসিনা প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ এবং তার প্রতিনিধিদলের সম্মানিত সদস্যদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানান। প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে ফ্রান্সের সরকার ও ফ্রান্সের জনগণের প্রতি শুভেচ্ছা জানান এবং দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের আরও সমৃদ্ধি কামনা করেন।

ঢাকা ও প্যারিসের মধ্যে ২টি চুক্তি স্বাক্ষর : ঢাকা ও প্যারিসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইট এবং বাংলাদেশের নগর অবকাঠামো উন্নয়ন বিষয়ে দুটি চুক্তি সই করেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (পিএমও) করবী হলে শেখ হাসিনা ও ম্যাক্রোঁর উপস্থিতিতে দুই চুক্তি সই করে বিনিময় করা হয়েছে।

চুক্তি দুটির একটি হলো-‘ইমপ্রুভিং আরবান গভর্নেন্স অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রোগ্রাম’ বিষয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং ফ্রান্সের ফ্রান্স ডেভেলপমেন্ট সংস্থার (এএফডি) মধ্যে ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি অ্যাগ্রিমেন্ট। আরেকটি হলো-বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) এবং বঙ্গবন্ধু-২ আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম সম্পর্কিত ফ্রান্সের এয়ারবাস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেস এসএএসের মধ্যে সহযোগিতার বিষয়ে লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) চুক্তি।

ইআরডি সচিব শরিফা খান ও এজেন্স ফ্রান্সেইস দো ডেভেলপমেন্ট (এএফডি)’র কান্ট্রি ডিরেক্টর বোনুই শসেত নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রথম চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। দ্বিতীয় চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বিএসসিএল চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ ও স্পেস সিস্টেম, এয়ারবাসের সেলস ও মার্কেটিং বিভাগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট স্টিফেন ভেসভাল। দেশের প্রথম জিওস্টেশনারি কমিউনিকেশনস অ্যান্ড ব্রডকাস্টিং স্যাটেলাইট, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১, ফরাসি কোম্পানি থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের নির্মিত। এটি ২০১৮ সালের ১২ মে উৎক্ষেপণ করা হয়।

এর আগে সকালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে তিনি রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন। এটি বাংলাদেশে ম্যাক্রোঁর প্রথম ও কোনো ফরাসি প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় সফর। এর আগে ১৯৯০ সালের ২০ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট মিতেরো বাংলাদেশ সফর করেছিলেন।

বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে মোট বাণিজ্য ২১০ মিলিয়ন ইউরো থেকে বর্তমানে ৪.৯ বিলিয়ন ইউরোতে উন্নীত হয়েছে এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে ফ্রান্স হচ্ছে ৫ম দেশ। ফরাসি কোম্পানিগুলো এখন প্রকৌশল, জ্বালানি, মহাকাশ ও পানিসহ বিভিন্ন খাতে সম্পৃক্ত। ভারতের নয়াদিল্লিতে জি-২০ সম্মেলনে যোগদানের পর ম্যাক্রোঁ দুই দিনের এক সরকারি সফরে রোববার সন্ধ্যায় ঢাকায় পৌঁছেন।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট রোববার রাত ৮টা ১০ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগত জানান। সেখানে তাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এ সময় উভয় দেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। ফরাসি প্রেসিডেন্টকে গার্ড অব অর্নার ও ২১টি তোপধ্বনির মাধ্যমে স্বাগত জানানো হয়।

বিমানবন্দর থেকে ম্যাক্রোঁ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যান। সেখানে তিনি তার সম্মানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আয়োজিত একটি আনুষ্ঠানিক নৈশ্যভোজে অংশ নেন। পরে ফরাসি প্রেসিডেন্ট স্থানীয় ব্যান্ডদল জলের গানের সংগীত আয়োজন উপভোগ করতে ধানমন্ডি লেকে যান। এ সময় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন। সোমবার বিকালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ঢাকা ত্যাগ করেন।

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.