চাল আমদানি ছাড়াই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার পরিকল্পনা সরকারের
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : সারা বিশ্বেই চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। চাল রফতানির বৃহত্তম উৎস ভারত ও মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ চাল রফতানিতে এরই মধ্যে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। তবে দেশের চালের বাজার অনেকটা স্থিতিশীল। গত অর্থবছরে সাড়ে ১০ লাখ টন চাল আমদানি করা হলেও এবার এখনো কোনো আমদানি করা হয়নি। সরকারিভাবে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চাল আমদানি না করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিগত মৌসুমগুলোয় উৎপাদন ভালো হওয়ায় আগামী আমন মৌসুমের সংগ্রহ পর্যন্ত চাল আমদানির প্রয়োজন নেই। এর পাশাপাশি ডলার সংকটের কারণেও চাল আমদানি না করে খাদ্য পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেয়া যায়, সেদিকেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট (এফপিএমইউ) সূত্রে জানা যায়, গত অর্থবছরে প্রায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার টন চাল আমদানি হয়। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে ১ লাখ ৪০ হাজার টন চাল আমদানি হয়। এর পুরোটাই আনা হয়েছিল বেসরকারিভাবে। এরপর অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে আমদানি হয় ৫ লাখ ২৭ হাজার টন। এর মধ্যে সরকারিভাবে ৩ লাখ ৬৬ হাজার টন আর বেসরকারিভাবে আমদানি হয় ১ লাখ ৬১ হাজার টন। জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে আমদানীকৃত ৩ লাখ ৮১ হাজার টনের মধ্যে সরকারিভাবে ২ লাখ ৬৮ হাজার টন এবং ১ লাখ ১৩ হাজার টন চাল বেসরকারিভাবে আনা হয়। ওই অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) বেসরকারিভাবে আমদানি হয় আট হাজার টন চাল।
এরপর চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত কোনো চাল আমদানি হয়নি। মজুদ পর্যাপ্ত থাকায় আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ খাদ্যপণ্যটি আমদানি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ নিয়ে গত রোববার খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির এক সভায় জানানো হয়, আমন মৌসুমের চাল বাজারে আসা পর্যন্ত কোনো সংকটের আশঙ্কা নেই।
সভায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে সরকারি গুদামে ১৬ লাখ ২ হাজার টন চাল মজুদ রয়েছে। এর পাশাপাশি চলতি আমন মৌসুমে দুই লাখ টন ধান ও পাঁচ লাখ টন চাল সংগ্রহ করা হবে। ফলে গুদামের সক্ষমতাও খুব বেশি নেই। চালের মজুদ ও উৎপাদন পরিস্থিতি বিবেচনায় আমন সংগ্রহের আগ পর্যন্ত চাল আমদানি না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে গম আমদানি করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. শাখাওয়াত হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের যে পরিমাণ চাল উৎপাদন হয়েছে তাতে আমদানি করতে হবে না। তবে আমনে যদি আবার কোনো সমস্যা হয়ে যায় তাহলে হয়তো আমদানি করতে হবে। আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমনের ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রম চলবে। ওই সময় পর্যন্ত পর্যাপ্ত চাল রয়েছে।’
আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম এখন বাড়তির দিকে থাকলেও দেশে তা অনেকটাই স্থিতিশীল। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে মোটা চাল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকায়। আর প্রতি কেজি মাঝারি চাল ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় এবং সরু চাল কেজিপ্রতি ৬০-৭২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের এ সময়ে মোটা চালের দাম ছিল প্রতি কেজি ৪৮-৫২ টাকা। এছাড়া কেজিপ্রতি ৫২-৫৬ টাকায় মাঝারি চাল এবং ৬৪-৭৫ টাকায় সরু চাল বিক্রি হয়েছিল। সে অনুযায়ী বাজারে চালের দাম গত বছরের তুলনায় বিভিন্ন আকারের চালের দাম কিছুটা কমেছে।
বর্তমানে চাল ছাড়া প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম ব্যাপক হারে বাড়ছে। বেড়েছে মানুষের সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয়ভার। এ পরিস্থিতিতে মানুষের সহযোগিতার প্রয়োজন বেশি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে চলতি অর্থবছরে ১ জুলাই থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারিভাবে খাদ্যশস্য বিতরণ কমেছে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৪ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারিভাবে চাল বিতরণ করা হয়েছিল ৮ লাখ ৮৭ হাজার ৭৪৩ টন। এর মধ্যে ওএমএসের আওতায় ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৩৬ টন, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ২ লাখ ৭৪ হাজার ২৭২ টন, ভিজিএফের আওতায় ১ লাখ ১০ হাজার ১৫৮ টন ও ভিজিডির আওতায় ১ লাখ ২২ হাজার ৬৪১ টন চাল বিতরণ করা হয়।
চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত অর্থাৎ একই সময়ে সরকারিভাবে মোট চাল বিতরণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৭৫ হাজার ৪৪ টন। এর মধ্যে ওএমএসের আওতায় ১ লাখ ৮৪ হাজার ৩৭৩ টন, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ২ লাখ ৯২ হাজার ১৬৬ টন ও ভিজিএফের আওতায় ১৮ হাজার ৭৪০ টন চাল বিতরণ হয়েছে। অর্থাৎ গত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় এবার ২ লাখ ১২ হাজার ৬৯৯ টন কম চাল বিতরণ করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সাধারণত আমদানির ভিত্তিতে এসব সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে সরকার। বিদ্যমান মজুদ ধরে রাখার পাশাপাশি চলমান ডলার সংকটের কারণে এখন সহায়তা কমানো হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আব্দুল লতিফ মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমদানি না করার পেছনে ডলার সংকটও একটি বড় কারণ। হয়তো এ কারণে সরকারিভাবে চাল বিতরণও কমিয়ে আনা হয়েছে। আবার বিগত সময়ের তুলনায় চালের উৎপাদন বেড়েছে। বড় কোনো দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয়নি। তবে উৎপাদনের তথ্য সঠিকভাবে নিরূপণ করতে হবে। তা না হলে কিন্তু ভয়াবহ সমস্যার মধ্যে পড়তে হবে। সরকার মূলত কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে এবং বাজার স্থিতিশীল রাখতে চাল মজুদ রাখে।’
আমন মৌসুমেও চালের ভালো উৎপাদনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘এ মাসে যে বৃষ্টি হয়েছে তা আমনের ফলনে ভালো ভূমিকা রাখবে। এতে উৎপাদন বাড়বে। এখন পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা যদি সঠিক হয়, তাহলে বলা যায় আপাতত চাল আমদানি করার প্রয়োজন নেই।’
অন্যান্য বছরের চেয়ে গত কয়েক মৌসুমে দেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪ কোটি ১৭ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে আউশ মৌসুমে ২৯ লাখ ১ হাজার টন, আমন মৌসুমে ১ কোটি ৭০ লাখ টন এবং বোরো মৌসুমে ২ কোটি ১৮ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত মৌসুমগুলোয় নিঃসন্দেহে চালের উৎপাদন অনেক ভালো হয়েছে। দেশে চালের কোনো সংকট নেই। বড় কোনো দুর্যোগ না হলে আর চাল আমদানি করতে হবে না। সরকার মূলত চাল সংগ্রহ কম হলে আমদানি করে থাকে। সরকারিভাবে মজুদের সক্ষমতা আগের চেয়ে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এটিকে আরো বাড়াতে হবে। কৃষক ধান বিক্রি করে ভালো দাম পাচ্ছে। এটা ধরে রাখতে হবে। তাহলে সরকারিভাবে চাল আমদানির প্রয়োজন পড়বে না।’
চাল উৎপাদনের তথ্য পরবর্তী সময়ে ডিএইর সঙ্গে সমন্বয় করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ডিএইর উৎপাদনের পরিসংখ্যান সাধারণত বিবিএসের তথ্যে এসে অনেকটাই কমে যেতে দেখা যায়। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে আউশে ২৯ লাখ টন ও আমনে ১ কোটি ৫৪ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। বোরো মৌসুমের উৎপাদনের তথ্য এখনো সমন্বয় করেনি বিবিএস।
এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট চাল উৎপাদন হয়েছিল ৩ কোটি ৮৩ লাখ টন। এর মধ্যে আউশে ৩২ লাখ টন, আমনে ১ কোটি ৪৯ লাখ টন এবং বোরো মৌসুমে ২ কোটি ১ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। সে অনুযায়ী গত বছরের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে চালের উৎপাদন বেড়েছে।
ডিএই সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরে আউশ মৌসুমে প্রায় ৩০ লাখ ৪৩ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে। আর চলতি আমন মৌসুমে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ কোটি ৭১ লাখ টন। এ পর্যন্ত ৫৮ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ করা হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমন মাঠে রয়েছে। এ বছর হালকা বন্যা হয়েছে কয়েক জেলায়। এতে অন্যান্য বছরের তুলনায় কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে কারণে বলা যায়, আমনের উৎপাদন অনেক ভালো হবে। বিগত বোরো ও আমনের উৎপাদনও ভালো হয়েছিল। অতএব চাল আমদানির প্রয়োজন নেই। কৃষকরা উচ্চফলনশীল জাতগুলো এখন বেশি চাষ করছেন। এতে স্বাভাবিকভাবেই ফলন বেড়ে যাবে।’