রিজার্ভের শর্ত শিথিল করবে আইএমএফ
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : ঋণের পরবর্তী কিস্তি প্রদানে রিজার্ভের শর্তে কিছুটা ছাড় দিতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিনের মধ্যে চলমান যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, মহামারি করোনা পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের মতো চারটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় ঋণের কিস্তি ছাড়ে রিজার্ভের শর্ত শিথিল করতে আইএমএফকে অনুরোধ করেছে সরকার।
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে রিজার্ভের শর্ত পূরণের বিষয়ে আইএমএফ ইতোমধ্যে নমনীয় হয়েছে বলে আভাস দিয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়। দুই সপ্তাহের বেশি সময় বাংলাদেশে অবস্থান করার পর ১৯ অক্টোবর সফররত আইএমএফ স্টাফ মিশন ঢাকা ত্যাগ করবে বলে নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। এবারের সফরে প্রতিনিধি দলটি অর্থমন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়সহ সরকারের প্রায় ৩০টি দপ্তর ও অধিদপ্তরের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে।
জানা গেছে, দুই সপ্তাহের বেশি সময়ের এই সফরে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও জানার সুযোগ পায় আইএমএফ। এছাড়া ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রদানের যে শর্তগুলো রয়েছে তা কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে সেই বিষয়ে একটি সম্যক ধারণা পায় সংস্থাটি। তবে আইএমএফের পক্ষ থেকে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে তার বেশিরভাগ পূরণ হলেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মজুত এবং রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। ফলে ঋণের পরবর্তী কিস্তিগুলো পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। সম্প্রতি ঋণ পাওয়ার শর্তপূরণে ব্যর্থ হওয়ায় আইএমএফের ঋণ পায়নি শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তান। ফলে বাংলাদেশও এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় কি না তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ে সংশ্লিষ্টদের।
অর্থমন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। রিজার্ভ পূরণ না হওয়া এবং রাজস্ব কমে যাওয়ার বিষয়টির জন্য বৈশ্বিক সংকট দায়ী।
বাংলাদেশ এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আন্তরিকভাবে কাজ শুরু করেছে। সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আইএমএফের বেশিরভাগ শর্ত পূরণ হয়েছে। রিজার্ভ ও রাজস্ব আদায় বাড়ানোর ক্ষেত্রেও সরকার আন্তরিক হয়ে কাজ করছে। তবে বিশ্বমন্দা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী ডলারের দাম বেড়ে গেছে। চাহিদা অনুযায়ী ডলার মিলছে না। এরপরও ডলারের সরবরাহ বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে সরকারের। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স নিয়ে আসা এবং হুন্ডি বন্ধে কাজ করা হচ্ছে। এ বিষয়গুলো আইএমএফকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, সংস্থাটি সারাবিশ্বে কাজ করে এবং এ বিষয়ে তারাও অবগত। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পুরো বিষয়টি তাদের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। আন্তরিকতার ঘাটতি না থাকায় আশা করছি আইএমএফ ঋণের পরবর্তী কিস্তিগুলো পাওয়া যাবে।
জানা গেছে, আইএমএফের এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে সফররত ১১ সদস্যের প্রতিনিধি দলটি আগামীকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা ত্যাগ করবেন। এর আগে আজ বুধবার আবারও প্রতিনিধি দলটি অর্থমন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করবে। ফিরে যাওয়ার আগে প্রতিনিধি দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের সফর সম্পর্কে ব্রিফিং করতে পারে কিংবা এ সংক্রান্ত একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হতে পারে। পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে আইএমএফের ওপর। তবে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এই সফরে থাকাকালীন সংস্থাটি মিডিয়ার মুখোমুখি হয়নি। সূত্রগুলো বলছে, আইএমএফের স্টাফ মিশন তাদের এই সফরের অর্জন, শর্তপূরণে বাংলাদেশের সক্ষমতা এবং সামগ্রিকভাবে এদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করবে।
যা ওয়াশিংটনের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিতব্য আগামী নভেম্বরের বোর্ড মিটিংয়ে উপস্থাপন করা হবে। এরপর বোর্ড মিটিং ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি অনুমোদনে চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দেওয়া হতে পারে। তবে বাংলাদেশের রিজার্ভ পরিস্থিতি এবং রাজস্ব আদায় নিয়ে খুব বেশি সন্তুষ্ট নয় আইএমএফ। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে এক সময় যদি তা ১০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, তখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সহায়তা না-ও মিলতে পারে। এ কারণে রিজার্ভ বাড়ানোর দিকে তিনি সরকারের মনোযোগ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
এদিকে মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আইএমএফ মিশনটির বৈঠকে অর্থসচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার সভাপতিত্ব করেন। এদিন দুপুরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সংস্থাটির বৈঠকে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। দুটি বৈঠকেই আইএমএফের এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করেন। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয় সংস্থাটির। অর্থমন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রিজার্ভ ও রাজস্ব আদায় বাড়ানোর ওপর সর্বোচ্চ জোর দিয়েছে আইএমএফ। জানা গেছে, আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করার শর্ত ছিল সেপ্টেম্বরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকতে হবে ২৫৩০ কোটি ডলার। সেটি এখন ২০০০ ডলারে নামিয়ে আনতে, আইএমএফের প্রতি অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, পরিদর্শনকারী আইএমএফ প্রতিনিধি দল যখন শর্ত পূরণের অগ্রগতির নানা দিক পর্যালোচনা করছিল, তখন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ অনুরোধ জানানো হয়। অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল পণ্য আমদানি কমানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া সত্ত্বেও, গত তিন মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৫৮ কোটি ডলার হ্রাস পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দুটি প্রধান উৎস, অভ্যন্তরীণ রেমিটেন্স প্রবাহ সেপ্টেম্বরে রেকর্ড ১৩৪ কোটি ডলার হ্রাস পেয়েছে।
দেশে ডলার সংকট চলাকালে আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা নভেম্বরে পাওয়ার কথা রয়েছে।
তবে তা নির্ভর করছে ঋণের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া শর্ত পরিপালনের ওপর। রিজার্ভ, বাজারভিত্তিক ডলারে রেট, ঋণ খেলাপি, রাজস্ব সংস্কার এবং তারল্য ব্যবস্থাপনাসহ ৪৭টি শর্তে বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দিতে রাজি হয় আইএমএফ। সংস্থাটির দেওয়া অধিকাংশ শর্ত পূরণ করতে পেরেছে বাংলাদেশ। কিন্তু রিজার্ভে উন্নতি, কর-জিডিপি অনুপাত এবং বাজারভিত্তিক ডলার রেট করা সম্ভব হয়নি। আইএমএফ মিশনের সফরের শেষ দিন আগামী ১৯ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও অর্থ সচিবের সঙ্গে সমাপনী বৈঠক করবেন। সেখানে আগামী বছরের ডিসেম্বর ও জুনের জন্য নতুন পরিমাণগত শর্ত চূড়ান্ত করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এরপর রাহুল আনন্দের নেতৃত্বাধীন স্টাফ মিশন আইএমএফের ম্যানেজমেন্ট ও বোর্ডের সামনে বাংলাদেশের প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন করবে।