ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হলে ব্যাংকের পরিচালক নয়
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা জারি । ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হয়েছেন এমন কোনো ব্যক্তি ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। একই সঙ্গে কোনো জাল-জালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ বা অন্য অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকলেও তিনি এ পদে অযোগ্য হবেন। পাশাপাশি ন্যূনতম বয়স ৩০ বছর না হলে কেউ আর ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির তালিকায় নাম উঠলেও অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। এ ধরনের বিধান রেখে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠন এবং পরিচালকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কিত একটি নীতিমালা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ-সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করে তা দেশের সব তফসিলি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
নীতিমালা জারির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিতের লক্ষ্যে ২০২৩ সালে ব্যাংক-কোম্পানি আইনে অধিকতর সংশোধনী আনা হয়েছে। এ সংশোধনের ফলে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের গঠন এবং পরিচালকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য, যোগ্যতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নতুন করে এ নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজন হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালায় বলা হয়েছে, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হবে শেয়ারধারী পরিচালক, শেয়ারধারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি পরিচালক ও স্বতন্ত্র পরিচালকের সমন্বয়ে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিকল্প পরিচালকও পর্ষদের সদস্য হতে পারবেন। তবে পর্ষদে পরিচালকের সংখ্যা হবে সর্বোচ্চ ২০ জন। এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা হবে ন্যূনতম তিনজন। আর ২০ জনের কম হলে স্বতন্ত্র পরিচালক হবেন ন্যূনতম দুজন। কোনো একক পরিবার থেকে তিনজনের বেশি সদস্য একই সময়ে কোনো ব্যাংকের পরিচালক পদে থাকতে পারবেন না। পরিচালনা পর্ষদে কোনো একক পরিবারের সদস্যের অতিরিক্ত সেই পরিবারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বা নিয়ন্ত্রণাধীন অনধিক দুটি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির পক্ষে প্রতিনিধি পরিচালক থাকতে পারবেন। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির পক্ষে একের অধিক প্রতিনিধি পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হতে পারবেন না। কোনো ব্যক্তি শেয়ারধারীর পক্ষে পরিচালক হিসেবে অন্য কোনো ব্যক্তি নিযুক্ত হতে পারবেন না।
ব্যাংকের পর্ষদে পরিচালকের মেয়াদের বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি থেকে কোনো ব্যাংকের পরিচালক পদে কেউ টানা ১২ বছরের বেশি থাকতে পারবেন না। এ মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন বছর পর অবশ্য তিনি পুনরায় ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন।
ব্যাংকের পরিচালক হতে হলে ন্যূনতম বয়স ৩০ বছর হতে হবে। সেই সঙ্গে ন্যূনতম ১০ বছরের ব্যবস্থাপনা বা ব্যবসায়িক বা পেশাগত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অবশ্য ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগের কোনো অভিজ্ঞতাকে এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হবে না। ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত, জাল-জালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ বা অন্য অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কেউ পরিচালক হতে পারবেন না। এমনকি কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলায় আদালতের রায়ে বিরূপ পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্য থাকলেও তিনি অযোগ্য হবেন। আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট কোনো নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের বিধিমালা, প্রবিধান, নীতিমালা বা নিয়মাচার লঙ্ঘনের কারণে দণ্ডিত ব্যক্তিও পরিচালক হওয়ার যোগ্য নন।
নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে, ব্যাংকের পরিচালক হতে আগ্রহী ব্যক্তি এমন কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, যার নিবন্ধন বা লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে বা প্রতিষ্ঠানটি অবসায়িত হয়েছে। সেই সঙ্গে তার নিজের কিংবা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া ঋণের জন্য খেলাপি হতে পারবেন না। তিনি অন্য কোনো ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা কোম্পানি বা এ ধরনের কোম্পানিগুলোর কোনো সাবসিডিয়ারি কোম্পানির পরিচালক বা উপদেষ্টা বা পরামর্শক বা অন্য কোনোভাবে লাভজনক পদে নিয়োজিত থাকতে পারবেন না। এছাড়া একই ব্যাংকের বহিঃহিসাব নিরীক্ষক, আইন উপদেষ্টা, উপদেষ্টা, পরামর্শক বা অন্য কোনো লাভজনক পদেও থাকতে পারবেন না ওই ব্যক্তি।
পরিচালকের যোগ্যতা সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে, আগ্রহী ব্যক্তি কোনো সময়ে আদালতে দেউলিয়া ঘোষিত হননি; ব্যক্তিগতভাবে অথবা তার ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বা অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের জন্য কর খেলাপি হতে পারবেন না। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কোনো পদে চাকরিরত থাকলে চাকরি অবসায়নের পাঁচ বছর অতিক্রম না হলে সেই ব্যক্তি ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। কোনো ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন, ২০২৩-এর আওতায় প্রতিষ্ঠিত কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে সেখান থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পাঁচ বছর না পেরোলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি পরিচালক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন না। তাছাড়া স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে এসব শর্ত ছাড়াও স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগসংক্রান্ত নীতিমালা পরিপালিত হবে। পরিচালক নিয়োগ কিংবা পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন নিতে হবে।
পরিচালক পদের শূন্যতা বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোম্পানি আইন, ১৯৯৪-এর ধারা ১০৮-এর উপধারা (১)-এর বিধান সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালকের পদ শূন্য হবে। এর বাইরে কোনো পরিচালক কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে গৃহীত অগ্রিম বা ঋণের জন্য ব্যাংক-কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ১৭ ধারার বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে নোটিস পাওয়ার দুই মাসের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তির সময় বাংলাদেশ ব্যাংকে মিথ্যা ঘোষণা বা তথ্য প্রদান করলে কিংবা তার যোগ্যতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হলে সংশ্লিষ্ট পরিচালকের পদ শূন্য বা নিয়োগ বাতিল হয়ে যাবে।
নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে, ব্যাংক-কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ১৭ ধারার আওতায় কোনো পরিচালকের পদ শূন্য হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্য টাকা যে তারিখে সম্পূর্ণ পরিশোধিত হবে সে তারিখ থেকে এক বছরের মধ্যে তিনি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না। এক্ষেত্রে তার কাছে প্রাপ্য টাকা, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে থাকা তার শেয়ার যথাযথ প্রক্রিয়ায় সমন্বয়ের মাধ্যমে আদায় করতে হবে। ঋণ পরিশোধের নোটিস প্রাপ্ত হলে, তার কাছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সমুদয় পাওনা পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত তিনি যে ব্যাংকে পরিচালক পদে নিয়োজিত ছিলেন সে ব্যাংকে তার নামে ধারণকৃত শেয়ার হস্তান্তর করতে পারবেন না এবং নোটিসপ্রাপ্ত কোনো পরিচালক নোটিসের কার্যক্রম চলমান থাকা অবস্থায় তার পদ থেকে পদত্যাগ করলে ওই পদত্যাগ কার্যকর হবে না। কোনো ব্যাংকের পরিচালক ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে ব্যাংক-কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ২৭খ ধারায় বর্ণিত বিধান পরিপালন সাপেক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক তার পরিচালক পদ শূন্য ঘোষণা করতে পারবে।
পরিচালক পদ থেকে অপসারণ এবং বিশেষ প্রয়োজনে পরিচালক নিয়োগের বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, ব্যাংক-কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ধারা ১৫-এর উপধারা (৪)-এ বর্ণিত বিধান অনুযায়ী বিশেষায়িত ব্যাংক ব্যতীত অন্য যেকোনো ব্যাংক-কোম্পানির কোনো পরিচালককে তার পদ থেকে অপসারণ করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। এ লক্ষ্যে অপসারণের কারণ ও যৌক্তিকতা সংবলিত বিবরণ এবং পর্ষদের গৃহীত সিদ্ধান্তের অনুলিপি এবং পরিচালকদের একটি তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগে (ডিভিশন-২) দাখিল করতে হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ার তারিখ থেকে অপসারণ কার্যকর বলে গণ্য হবে। আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী কর্মকাণ্ড বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট লেনদেনের মাধ্যমে ব্যাংকের তহবিলের অপব্যবহার বা মানি লন্ডারিং বা সন্ত্রাসী কার্যে অর্থায়ন কিংবা জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক-কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ৪৬ ধারার আওতায় যেকোনো ব্যাংকের পরিচালক বা চেয়ারম্যানকে অপসারণ ও ৪৭ ধারার আওতায় যেকোনো ব্যাংকের পর্ষদ বাতিল করতে পারবে। আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী বা ব্যাংকের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর কার্যকলাপ প্রতিরোধ করার জন্য বা জনস্বার্থে ব্যাংক-কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ৪৫ ধারার আওতায় সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে ব্যাংকের যেকোনো পরিচালককে অপসারণ করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া ব্যাংক বা আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় বা সুনির্দিষ্ট বা বিশেষ প্রয়োজনে কিংবা জনস্বার্থে ব্যাংক-কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ৪৫ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালক নিয়োগের যোগ্যতা ও উপযুক্ততা থাকা সাপেক্ষে কোনো ব্যক্তিকে কোনো ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ প্রদান কিংবা নতুন পর্ষদ গঠন বা পর্ষদ পুনর্গঠন করতে পারবে।
ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মধ্য থেকে একজন দুই বছরের জন্য চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হবেন বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে পরিচালক পদের মেয়াদ থাকা সাপেক্ষে তিনি চেয়ারম্যান পদে পুনর্নির্বাচনের জন্য যোগ্য হবেন। পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান বা পর্ষদ কর্তৃক গঠিত কোনো কমিটির চেয়ারম্যান বা কোনো পরিচালক এককভাবে কিংবা ব্যক্তিগতভাবে কোনো নীতিনির্ধারণী বা নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের এখতিয়ার রাখেন না বিধায় তিনি ব্যাংকের প্রশাসনিক বা পরিচালনাগত দৈনন্দিন কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তবে ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা পর্ষদ গঠিত অন্য কোনো কমিটির চেয়ারম্যান ব্যাংকের কোনো শাখা বা অর্থায়ন কার্যক্রম সরজমিন পরিদর্শন করতে পারবেন। এছাড়া ব্যাংকের পরিচালনাসংক্রান্ত যেকোনো তথ্য তলব বা কোনো বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিতে পারবেন বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
ব্যাংকের পরিচালকদের সম্মানী ও আর্থিক সুবিধার বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, পরিচালনা পর্ষদ বা সহায়ক কমিটির সভায় উপস্থিতির জন্য পরিচালকদের সম্মানীর পরিমাণ হবে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। এছাড়া স্বতন্ত্র পরিচালকরা সভায় উপস্থিতির সম্মানী ছাড়াও প্রতি মাসে স্থায়ী সম্মানী বাবদ ৫০ হাজার টাকা পাবেন।