নেত্রকোণার শীতল পাটি তৈরির কারীগররা দাদন ঋণে দিশেহারা

0

মেহেদী হাসান আকন্দ : নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার ডিঙ্গাপোতা হাওর পাড়ের শত শত পরিবার যুগ যুগ ধরে পাটি তৈরির কাজে জড়িত। তারা সারা বছর ধরে পাটি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। হাওরের হাতনী, জৈনপুর, কেন্দুয়া, রঘুরামপুর, ভাটাপাড়া, নোয়াগাও, তাহেরপুরের তৈরি ব্যাতের পাটির খ্যাতি রয়েছে দেশ জুড়ে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় বাড়িতে নারী-পুরুষ পাটি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছে। পুরুষদের তুলনায় নারীরাই এই কাজে বেশি দক্ষ। সাংসারিক কাজ শেষ করে বাঁকি সময়টা তারা পাটি তৈরির কাজেই ব্যস্ত থাকে। স্থানীয়ভাবে পাটি তৈরির কাঁচামাল মুক্তার চাষ হলেও তা যতেষ্ট না হওয়ায় পুরুষরা জেলার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে ঘুরে মুক্তা সংগ্রহ করে।
মুক্তা সংগ্রহকারী হাতনী গ্রামের মৃত খগেন্দ্র দত্তের ছেলে মানিক দত্ত এবং মৃত সুখময় কুমার সরকারের ছেলে শ্যামল চন্দ্র সরকার জানান, বর্ষামৌসুমে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় অধিকাংশ মুক্তা বর্ষা মৌসুমেই সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। তাছাড়া শুস্ক মৌসুমেও মোহনগঞ্জ, বারহাট্টা, কলমাকান্দা, দূর্গাপুর, জাইরাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে তারা মুক্তা সংগ্রহ করে স্থানীয় পাটি কারীগরদের কাছে বিক্রি করে।
পাটি তৈরির কারীগর হাতনী গ্রামের সন্তোষ সরকারের স্ত্রী লক্ষী রানী, অনিল ঘোষের স্ত্রী প্রমিলা রানী ঘোষ, মানিক দত্তের স্ত্রী সুগন্ধা দত্ত, শ্যামল দত্তের স্ত্রী সন্ধা রানী ও মদন চন্দ্রের স্ত্রী রেখা রানী জানান, পাটি তৈরি করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। একটি সাধারণ পাটি তৈরিতে তাদের সময় লাগে কমপক্ষে ৮দিন। প্রতিটি পাটির কাঁচামাল ক্রয় করতে ব্যয় হয় প্রায় ২’শ থেকে ৩’শ টাকা, বিক্রি হয় ৭’শ থেকে ৮’শ টাকায়। তৈরিকৃত পাটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকাড়রা এসে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়।

আবার স্থানীয় জৈনপুর বাজারে সপ্তাহে সোমবার ও শুক্রবার পাটি বিক্রির বাজার বসে। পাটি তৈরির কারীগররা জানান, পাটি তৈরির কাঁচামাল মুক্তা সংগ্রহ বর্ষা মৌসুমেই তারা বেশি করে থাকে। নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশি সুদে টাকা নিয়ে তারা পাটি তৈরির কাঁচামাল মুক্তা ক্রয় করে। বছর শেষে দাদন ব্যবসায়ীদের টাকা পরিশোধ করতে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। এক দাদন ব্যবসায়ীর ঋণের টাকা পরিশোধ করতে অন্য দাদন ব্যবসায়ীর কাছে তাদের ঋণ করতে হয়।

শীতল পাটির কারীগর প্রমিলা রানী ঘোষ জানান, শীতল পাটি তৈরিতে সময় ও খরচ বেশি হওয়ায় কারীগরদের মধ্যে শীতল পাটি তৈরির আগ্রহ কমে যাচ্ছে। উৎকৃষ্টমানের মুক্তা বেশি দামে ক্রয় করতে হয়। এসব মুক্তা থেকে ব্যাত তুলে ভাতের মাড়ের সাথে সিদ্ধ করে প্রথমে রোদে শুকাতে হয় তারপর শুকনো ব্যাত আবারো সিদ্ধ করে রং করে শুকায়ে সুনিপুন হাতে পাটি তৈরি করতে হয়। একটি শীতল পাটি তৈরি করতে প্রায় ১মাস সময় লাগে। একটি শীতল পাটি বিক্রি হয় ২৪’শ থেকে ২৫’শ টাকা। খরচ এবং পরিশ্রমের তুলনায় লাভ হয় অত্যান্ত সীমিত।
প্রমিলা রানী বলেন, প্রায় ৪০বছর ধরে তিনি শীতল পাটি তৈরি করছেন। ২ছেলে, ১মেয়ে ও পঙ্গু স্বামীকে নিয়ে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনিই। দিন-রাতের অধিকাংশ সময় তিনি পাটি তৈরিতেই পার করেন। উপার্জিত অর্থে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন দক্ষিণ সুনামগঞ্জে। সামান্য ফসলী জমি ছিল তাদের স্থানীয় ভুমিদস্যুরা সেটাও জোর করে দখল করে নিয়েছে। বাঁধা দিতে যাওয়ায় সন্ত্রাসীদের হামলায় গুরত্বর আহত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর শরীর থেকে একটি পা কেটে বিচ্ছিন্ন করে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে প্রায় ১৩বছর আগে স্বামী অনিল ঘোষের।

তিনি বলেন, স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ীর নিকট থেকে ৪০হাজার টাকা ঋণ নিয়ে পাটি তৈরির কাঁচামাল মুক্তা ক্রয় করেছেন। বছর শেষে তাকে ৬০হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবি জানিয়ে প্রমিলা রানী বলেন, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে শীতল পাটি তৈরির উৎসাহ বৃদ্ধির পাশাপশি ব্যবসার আরও প্রসার করা সম্ভব হবে। স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতে গ্রামের মানুষের বেকারত্ব দূর হবে। পাশাপাশি দেশীয় চাহিদা পূরন করে বিদেশে রপ্তানীর সম্ভাবনা তৈরি হবে।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.