সুন্দরবনের বনজীবিদের ঈদ
ম.ম.রবি ডাকুয়া,বাগেরহাট জেলা প্রতিনিধি : ঈদে খুব খারাপ দিন কাটছে সুন্দরবনের বনজীবিদের, একদিকে করোনা অপরদিকে পাশপারমিট বন্ধ এ যেন অনেকটাই মরার উপর খাড়ার ঘা।নানা রকম অভাব অভিযোগ আর অনাহার অর্ধাহারে দিন কাটছে বাগেরহাট ও সাতক্ষিরা এলাকার বনজীবিদের।
এমন দৈন্য আর দরিদ্রতায় আক্রান্ত অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেল জেলে বাওয়ালী আর মৌয়ালদের দরিদ্রতার আসল চিত্র। বাগেরহাটের মোংলার কাইনমারি, কানাইনগর,চিলা আর রামপালের উলুবুনিয়ার কিছু জেলে পল্লীর মানুষের একটাই পেশা তাদের বনছাড়া আর কোন জীবিকার পথ নেই কেউ মাছ ধরে কেউ কাঠ, গোলপাতা কেউবা মধু সংগ্রহ করে।
গত বছর কোরবানিতেও অনেকেই ভাগাভাগি করে কোরবানি করেছে, এবার জীবন জীবিকার চহিদা মেটানো আর সংসার চালাতেই হিমসিম খাচ্ছে।গেল বছর আম্ফানে ঘর ভাঙ্গা নদী ভাঙ্গা আর নানা রকম প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে জীবনের সব সঞ্চয় হরিয়ে দরিদ্রতার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌছে গেছে।
স্থানীয় বিভিন্ন এলাকার বাসীন্দাদের মধ্যে গ্রামের মালঞ্চ নদী পাড়ের বাসিন্দা জেলে আকবার আলী বলেন, ‘আমি জঙ্গল করে সংসার চালাই। ছোট ভাইডা মোটরসাইকেল ভাড়ায় চালায়, দেড়মাস ধরে লকডাউন চলতেছে। গাড়ি বের করতি পারে না। সেও এখন আমার সংসারে। মা-বাবাসহ আমার বাড়ি প্রতিদিন ১২ জনের রান্না করতি হয়। এখন সুদের টাকায় বসে বসে খাচ্ছি। যাহয় দুডো মাছ ধরে খেতাম তাও এখন বন্ধ। গত মাস থেকে সুন্দরবনে ঢুকতি দেচ্ছে না। এখনও একমাস পরে পাস দেবে। এখন তিন বেলা ঠিকমত খাবার জুটতেছে না। কোরবানির চিন্তা করব কিম্মাই (কেমন করে)তাদের মতোই, সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় জনপদের শত শত মুসলিম জেলে পরিবার এবারের ঈদুল আজহা’র আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জুন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত কাঁকড়া ও মাছের প্রজনন মৌসুমের কারণে জেলেদের বনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বন বিভাগ। ফলে সুন্দরবন থেকে মাছ ও কাঁকড়া আহরণ করতে পারছেন না জেলেরা। এতে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন বনের ওপর নির্ভরশীল শত শত জেলে পরিবার। সুন্দরবন সংলগ্ন কয়েকটি জেলে পরিবারের সাথে কথা বলে জানা গেছে এবারের ঈদে তাদের মধ্যে কোনো উন্মাদনা নেই।তবে এই তিন মাস সরকারিভাবে জেলে কার্ডধারীদের মাসিক ৪৭ কেজি করে চাল দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয় না বলে অভিযোগ জেলেদের।
গাবুরা ইউনিয়নে সোরা গ্রামের মৎস্যজীবী ইউনুস গাজী জানান, সুন্দরবনে মাছ ও কাঁকড়া ধরে তারা প্রতি গোনে (এক পক্ষ) ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় হয়। কিন্তু জেলে কার্ডে মাঝে মাঝে চাল পাওয়া যাচ্ছে। এ চালে তাদের সংসার চলছে না।গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে আম্পান, ইয়াস পরবর্তী সময়ে বেড়ি বাঁধ ভেঙে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পরিবারগুলো এখনো সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ইউনিয়নের বেশিরভাগ গরিব মানুষ সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে বনে প্রবেশ নিষিদ্ধ রয়েছে। ফলে অর্থকষ্টের কারণে এবার অনেকে কোরবানি করছেন না। এতে গরিবরা মাংস খাওয়া থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। তবে ঈদ উপলক্ষে পরিষদ থেকে গরিব পরিবার পিছু ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে।’
শ্যামনগর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তুষার মজুমদার বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে সারা দেশের জেলেদের জন্য বরাদ্দ আসলে ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে এসব চাল জেলেদের মাঝে বিতরণ করা হয়। কেবল মাত্র সুন্দরবনের জেলেদের জন্য আলাদা বরাদ্ধ না থাকায় এখন চাল দেয়ার কোন সুযোগ নেই। বিষয়টি তাই একটু কষ্টকর।
পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) এম এ হাসান জানান, ‘পুরো পশ্চিম সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ এলাকা অভয়ারণ্য। অভয়ারণ্য এলাকায় প্রবেশ নিষেধ। তাছাড়া মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত হওয়ায় বর্তমানে মাছ ও কাঁকড়ার পাস-পারমিট বন্ধ রয়েছে। এজন্য বৈধভাবে জেলেরা বনে ঢুকতে পারছেন না। সেপ্টেম্বর মাসে আবার পাস-পারমিট চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
এছাড়াও মোংলায় কিছু জেলেদের নামে কার্ডের মাধ্যমে সহায়তা দেয়া হলে তা সঠিক জেলেদের হাতে পৌছেনি বলে জানায় জেলেরা ও তা যথেষ্টও নয় বলেও অভিযোগ করেন কেউ কেউ। স্থানীয় জেলাদের কর্মহীন সময়ে সরকারি বরাদ্দের ও দাবি করেছেন কেউ কেউ।