সিডরে শরণখোলা উপজেলায় নিহত হয় ৪৩৯ শিশু ।। দুর্যোগ প্রস্তুতিতে শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়না

0

আসাদুজ্জামান মিলন, বাগেরহাট থেকে : প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয় শিশুরা। অথচ দুর্যোগ প্রস্তুতিতে শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়না। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সুপার সাইক্লোন সিডরের আঘাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ শরণখোলা উপজেলায় নিহত মোট ৭২২ জনের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ছিল ৪৩৯। এক সাথে এত শিশুর প্রাণহানির ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলেছে। তারা দূর্যোগে শিশুর নিরাপত্তা ও শিশু সুরক্ষার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়ার দাবি তুলেছেন।

সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত শিশু, অভিভাবক ও দুর্যোগ সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে ও ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে জানা যায়, সিডরের আঘাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শরণখোলা উপজেলায় নিহত মোট ৭২২ জনের মধ্যে নির্মম ভাবে প্রাণ হারিয়ে ছিল ৪৩৯ শিশু। এদের মধ্যে সদ্য ভূমিষ্ট থেকে ১৮ বছরের শিশু রয়েছে। সিডরে মৃত্যু উপত্যকা শরণখোলা উপজেলার দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামে সিডরের রাতে দুলাল মিয়ার স্ত্রীর জন্ম দেয়া শিশুটি জন্মের মাত্র ৬ ঘন্টার মধ্যে বলেশ্বরের প্রবল তোড়ে ভেসে যায়। সিডরে নিহতদের মধ্যে এ শিশুটি সবচেয়ে হতভাগ্য শিশু। যে পৃথিবীর একটি সূর্যোদয় দেখার আগেই প্রলয়ংকারী দুর্যোগের নির্মম শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে।

মৃত্যুর পর এলাকাবাসী ও স্বজনরা তার নাম রাখে সিডর। ৪৩৯ শিশুর মধ্যে অধিকাংশের বয়স একমাস থেকে ৫ বছরের মধ্যে। সিডরে নিহত অন্যান্য শিশুর মধ্যে রাজৈর গ্রামের রফিক মিয়ার কন্যা তামান্নার বয়স ছিল মাত্র ২২ দিন, দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামের আসলাম মিয়ার কন্যা সুমাইয়ার বয়স ছিলো মাত্র এক মাস, একই গ্রামের বেলাল মিয়ার কন্যা বিলকিসের বয়স ছিলো মাত্র দুই মাস, উত্তর সাউথখালী গ্রামের শহীদুলের কন্যা সুরমার বয়স ছিলো দুই মাস।

দুর্যোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, সিডরে উপকুলীয় উপজেলা শরণখোলার এতগুলো শিশু যেমন চরম যন্ত্রণা ভোগ করে প্রাণ দিয়েছে। তেমনি সিডরে নিহতদের জীবিত শিশুরা অভিভাবকহীন হয়ে চরম অসহায় জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। বগী গ্রামের সোহেল পঞ্চায়েত (১২) সিডরে তার মা-বাবা ও ভাই বোনদের হারিয়ে চরম অসহায় হয়ে পড়ে। ২০০৭ সালে সোহেল বগী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ত। তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ৯ বছর। প্রথম দিকে দেশী- বিদেশী দাতা ও এনজিও’র সাহায্য নিয়ে বড় বোনের আশ্রয় থেকে লেখাপড়া করলেও এখন সে অনেকটা অসহায়। মা-বাবা ও নিজের স্বপ্ন পুরনের প্রত্যয় নিয়ে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত লেখা পড়া করলেও এক সময় তা বন্ধ হয়ে যায়। তার মত সিডরে মাতা-পিতা হারানো কয়েশ’ শিশুর দিন কাটছে চরম অযত্ন ও অবহেলায়।

দুর্যোগ কবলিত শরণখোলা এলাকার চারণ সাংবাদিক নজরুল ইসলাম আকন বলেন, দুর্যোগে শিশুরাই সবচেয়ে বেশী ক্ষতির শিকার হয়। একদিকে তাদের জীবন বিপন্ন হয়। অপর দিকে পিতা মাতা হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে। রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি শরণখোলার মাঠ সমন্বয়ক সাত্তার মারওয়া জানান, মাঠ পর্যায়ে তারা সামগ্রীক ভাবে কাজ করলেও শিশুদের জন্য তাদের আলাদা কোন কর্মসূচী নেই। দুস্থঃ স্বাস্থ্য কেন্দ্র ডিএসকে’র মাঠ কর্মকর্তা রাশিদা পারভীন জানান, শিশুদের জন্য তাদের দুর্যোগ বিষয়ে আলাদা কোন কর্মসূচী না থাকলেও কেএনএইচ নামের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে তারা উপজেলার ৩টি ইউনিয়নে ৪৬ টি দলে ১২০০ শিশুকে নিয়ে সব ধরনের সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছেন।

উন্নয়ন সংস্থা এডুকো বাংলাদেশ এর প্রোগ্রাম ডেভলপমেন্ট ম্যানেজার শাহীনুল ইসলাম বলেন, জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী যে কোন পরিস্থিতিতে শিশু সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিতের কথা উল্লেখ থাকলে ও জাতীয় পরিকল্পনা ও মাঠ পর্যায়ের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তা উপেক্ষিত হচ্ছে।
সিডর ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাজে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দক্ষিন পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম উন্নয়ন সংস্থা রুপান্তরের নির্বাহী পরিচালক রফিকুল ইসলাম খোকন অভিমত দিয়ে বলেন, দুর্যোগে শিশুদের জীবন বিপন্ন হয়। তাদের মধ্যে চরম ভীতির সৃষ্টি হয়। অভিভাবক হারিয়ে তারা আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। আশ্রয়ের অভাবে তারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। তাই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও প্রস্তুতি মূলক পরিকল্পনায় শিশু সুরক্ষার বিষয়টি কে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খাতুনে জান্নাত বলেন, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই য়ে কোন পরিস্থিতিতে শিশু সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিশু নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য সরকারী বেসরকারী সংস্থা গুলোকে পরিকল্পনা গ্রহনের আহবান জানিয়ে বলেন, সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হচ্ছে।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.