৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস, বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষনের দাবী মুক্তিযোদ্ধাদের
রিজাউল করিম সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে সাতক্ষীরার দামাল ছেলেরা থ্রি নট থ্রি আর এসএলআরের ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে সাতক্ষীরা শহরে প্রবেশ করে। ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। সন্তান হারানোর বেদনা ভুলে সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাথে রাস্তায় নেমে আসে মুক্তিপাগল আপামর জনতা। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেদিনের সাহসী সন্তানরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মুক্ত করেছিল এই সাতক্ষীরাকে। কিন্তু স্বাধীনার ৫০ বছর পরেও সাতক্ষীরার বধ্যভূমিগুলো রয়ে গেছে অরক্ষিত। মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারি এসব বীর সেনানীদের দাবী বধ্য্যভূমিগলো সংরক্ষনের।
জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২ মার্চ সাতক্ষীরা শহরে পাকিস্তাান বিরোধী মিছিলে রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করে শহীদ আব্দুর রাজ্জাককে। আর এখান থেকে শুরু হয় সাতক্ষীরার দামাল ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া। মুক্তিযুদ্ধের খরচাদি বহনের জন্য সাতক্ষীরা ট্রেজারী হতে অস্ত্র লুট আর ন্যাশনাল ব্যাংক হতে অলংকার টাকা পয়সা লুটের মধ্য দিয়ে শুরু মুক্তির সংগ্রাম। ৮ম ও ৯ম সেক্টরের অধীনে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ট্রেনিং শেষে ২৯ এপ্রিল সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় পাক সেনাদের ২ শতাধিক সৈন্য নিহত হয়। ১৭ ঘন্টাব্যাপী এ যুদ্ধে শহীদ হয় মাত্র ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা। আহত হয় আরো ২ জন মুক্তিযোদ্ধা।
এরপর থেমে থেমে চলতে থাকে সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্ত হামলা। ভোমরা, টাউন শ্রীপুর, বৈকারী ও খানজিয়া সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হয় আব্দুর রাজ্জাক, কাজল, খোকন, নাজমুল, নূর মোহাম্মদসহ ৩৩জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। লাইটের আলোয় অসুবিধা হওয়ায় ২৯ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা টাইম বোমা দিয়ে শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত পাওয়ার হাউস উড়িয়ে দিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত করে ফেলে পাক সেনাদের। মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় টিকতে না পেরে ৬ ডিসেম্বর রাতে পিছু হটতে শুরু করে পাক সেনারা। ৭ ডিসেম্বর জয়ের উন্মাদনায় জ্বলে ওঠে সাতক্ষীরার দামাল ছেলেরা।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে শত্রুদের গুলিতে সাতক্ষীরার যে সকল বীর সন্তান শহীদ হন তারা হলেন, শহীদ আব্দুর রাজ্জাক, কাজল, খোকন, নাজমুল, হাফিজউদ্দিন, নুর মোহাম্মদ, আবু বকর, ইমদাদুল হক, জাকারিয়া, শাহাদাত হোসেন, আব্দুর রহমান, আমিনউদ্দিন গাজী, আবুল কালাম আজাদ, সুশীল কুমার, লোকমান হোসেন, আব্দুল ওহাব, দাউদ আলী, সামছুদ্দোহা খান, মুনসুর আলী, রুহুল আমীন, জবেদ আলী, শেখ হারুনার রশিদ প্রমুখ।
তবে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ, স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও সাতক্ষীরার বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি আজও। একই সাথে সাতক্ষীরা কালেক্টরেট চত্বরে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নির্মিত শহীদ স্মৃতি স্তম্ভে কিছু নাম নিয়ে বিতর্ক থাকায় তা এখনও উদ্বোধন করা হয়নি। সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে যান না মুক্তিযোদ্ধারা।
অযত্নে আর অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে বধ্যভূমি ও গণকবরের স্মৃতিচিহ্ন। তাই বধ্যভূমি ও গণকবরের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন সাতক্ষীরার মুক্তিযোদ্ধারা। সাতক্ষীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মোশারফ হোসেন মশু জানান, প্রতিবছর ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস উপলক্ষ্যে জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের আয়োজনের যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটি পালন করা হয়। তিনি এ সময় সাতক্ষীরার বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো সংরক্ষণের দাবী জানান সরকারের কাছে।
সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির জানান, জেলা প্রশাসক চত্বরে স্বাধীনতার যে স্মৃতি স্তম্ভটি রয়েছে সেটি এখনও উদ্বোধন করা হয়নি। কিছু নাম নিয়ে প্রশ্ন উঠায় সেগুলো যাচাই বাছাই করে স্তম্ভটি উদ্বোধন করা হবে। তিনি আরো জানান,সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি বর্ধ্যভূমি ও গনকবরগুলি সংরক্ষনের মাধ্যমে শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদনের ব্যবস্থা করা হবে।