আজ ৯ ডিসেম্বর শ্যামগঞ্জ  মুক্ত দিবস

বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর এখন ময়লার বাগাড়!

0
মো. হুমায়িন কবির, গৌরীপুর : আজ ৯ ডিসেম্বর গৌরীপুর উপজেলার শ্যামগঞ্জ মুক্ত দিবস ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সুধীর বড়ুয়ার শাহাদাৎ দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে  গৌরীপুর উপজেলার শ্যামগঞ্জ ও তার আশপাশ এলাকা থেকে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার ও আলবদরদের পরাজিত করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ঐতিহাসিক শ্যামগঞ্জ রেলওয়ের মাঠে স্বাধীন বাংলার লাল সবুজ পতাকা উত্তোলন করেন। বিজয়ের আগ মুহুত্বে ৯ ডিসেম্বর সকালে আবারো পাকহানাদার বাহিনী জারিয়া-ময়মনসিংহ রেলপথে ট্রেন যোগে গৌরীপুর থেকে পূর্বধলা প্রবেশ করতে চাইলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিপাগল  জনতার তীব্র আক্রমন ও প্রতিরোধের মূখে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এসময় পিছুহটা পাকসেনারা পূর্বধলা উপজেলার পাবই রেল সেতুটি মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস করে যায়।
তৎকালীন নেত্রকোণা মহকুমা ও ময়মনসিংহ জেলার সংযোগস্থল শ্যামগঞ্জ ও এর আশপাশ এলাকা যখন পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়ে বিজয়ের ঠিক আগ মুহুত্বে একদল পাকিস্তানি সৈন্যের ব্রাশফায়ারে নির্মমভাবে নিহত হন তৎকালীন ইপিআর হাবিলদার সুধীর বড়ুয়া ।
৮ ডিসেম্বর রাত ১১ টার পর থেকে নেত্রকোণা, মোহনগঞ্জ, বারহাট্রা, দূর্গাপুর, জারিয়া, পূর্বধলা ও সুনামগঞ্জ  জেলার ধর্মপাশা এলাকা থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ট্রেন যোগে শ্যামগঞ্জ এলাকায় জমায়েত হতে থাকে। প্রায় ৩ শত পাক সেনা ও  রাজাকার শ্যামগঞ্জ রেলওয়ে মাঠ, স্টেশন এলাকা মইলাকান্দা, গোহালাকান্দা ও শ্যামগঞ্জ বাজার এলাকা দখল করে কিছু কিছু স্থানে বাংকার খনন করে এ খবর পেয়ে স্থানীয়  মুক্তিযোদ্ধারা পাকহানাদার বাহিনীর চারিদিকে অবস্থান নেয় এবং আক্রমনের অপেক্ষায় থাকে। (স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি কম্পানি রজব কম্পানি, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীর প্রতীক কম্পানি (বেলাল কম্পনি) ও তোফাজ্জল হোসেন চুন্নু কম্পানি মূলত এই তিনটি কম্পানি পাকবাহনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহন করে। চারিদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান টের পেয়ে শ্যামগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে থাকা পাক সৈন্যরা স্টেশনে জড়ো হয়ে ট্রেনে এলাকা ত্যাগ করে। পাকিস্তানি সৈন্যদের পলায়নের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে স্বাধীনতাকামী জনতা রাস্তায় বেরিয়ে আসে এবং বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা শ্যামগঞ্জ আসতে থাকেন।
বিকালে রজব কোম্পানি, বেলাল কোম্পানি ও শামসু সেকশনে নিজ নিজ গ্রুপ নিয়ে শ্যামগঞ্জ ঐতিহাসিক রেলওয়ে মাঠে মিলিত হয়ে বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠে। পড়ে বিকাল ৫ টায় ঐতিহাসিক রেলওয়ের মাঠে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এলাকাবাসীর পক্ষে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন শিল্পী শাহাতাব। এ সময় উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা ফাঁকা গুলি ছোড়েন এবং জয় বাংলা শ্লোগানে পুরো এলাকা প্রকম্পিত করে তোলেন।
এ দিকে ইপিআর এর সুধীর বড়ুয়া তার দলবল নিয়ে শ্যামগঞ্জ ডাকবাংলায় রাত কাটানোর জন্য চলে আসতে থাকেন এবং সন্ধ্যায় শ্যামগঞ্জ বাজারের পূর্বপাশে অবস্থানকারী এবং রেকি করে এগিয়ে আসা পাক সেনাদের সঙ্গে শ্যামগঞ্জ পশ্চিম বাজারের পল্লী হাসপাতালের সামনে মুখোমুখি হয়ে পড়েন। এ সময় পাক সেনাদের সাথে থাকা কয়েকজন রাজাকার জয় বাংলা শ্লোগান দিলে তাদেরকে বন্ধু মনে করে সুধীর বড়ুয়া ও জয় বাংলা শ্লোগান দেন। একই সময় পাকসেনাদের মেশিনগানের ব্রাশফায়ারে সুধীর বড়ুয়ার দেহটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এ সময় তার দুই জন সাথীও আহত হন। পরেরদিন সকালে ভারতীয় বাহিনীর মেজর প্রিথ সিং, ক্যাপ্টেন মূরারী, ক্যাপ্টেন বালজিত সিং ক্যাপ্টেন চোপড়াসহ ভারতীয় সেনা সদস্যদের উপস্থিতিতে শ্যামগঞ্জ রেলওয়ের মাঠের উত্তর পাশে সম্পূর্ণ সামরিক কায়দায় শহীদ সুধীর বড়ুয়াকে সমাহিত করা হয়।
তার এই বীরত্ব পূর্ণ অবদানের জন্য গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে মরনোত্তর বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত করেন। এই যুদ্ধই ছিল একাত্তরের রনাঙ্গনের এলাকার শেষ যুদ্ধ। পরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় তার স্মৃতিতে একটি সৌধ নির্মাণ করা হয়। প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারী, ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা সুধীর বড়ুয়ার স্মৃতি সৌধে ফুল দিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানান। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও এই বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর বা স্মৃতি সৌধটি অবহেলা ও অযত্নে   পড়ে রয়েছে। বর্তমান নতুন প্রজন্ম জানেই না এই বীর সেনানীর বীরত্ব গাথা  গল্পের কাহিনী। শুধু স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও শহীদ দিবস এলেই   তার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান স্থানীয় বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ও স্কুল কলেজের ছাত্র/ছাত্রীরা। বর্তমানে  সঠিক রক্ষনা বেক্ষনের অভাবে এই বীর  মুক্তিযোদ্ধার কবরের চার পাশে ময়লা আবর্জনা ফেলে ময়লার বাগাড়ে পরিনত করা হয়েছে এবং চার পাশে গড়ে উঠেছে অবৈধ দোকান পাঠ।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.