অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি কাপ্তাইকে ঘিরে কবিঃ মুহাম্মদ নরুল কবির করিমী’র ভাবনা

0

মাহফুজ আলম, স্টাফ রিপোর্টার : কাপ্তাই রাঙামাটি  কাপ্তাইয়ের পথে পথে….
আনন্দ বিলাস !
খন্ড- (চ)
সনটা ছিল ২০০৩ ।
চন্দ্রঘোনা ফরেস্ট অফিস পেরিয়ে যাচ্ছি । দুপুর দু’টোর কাঁটা ছুঁই ছুঁই করছে । গাড়ি চলছে , থামছে কাপ্তাইয়ের পথে পথে । একের পর এক পাহাড় , পর্বত অতীত হয়ে যাচ্ছে । আমার দেখা অনেক সুন্দর দৃশ্যগুলো ও যেনো পলকেই গাড়ীর পশ্চাতে দৌঁড়ে পালাচ্ছে । আসলে বর্তমানটা খুব ক্ষণস্থায়ী ।

চলন্ত গাড়ী থেকে কতোটুকুইবা দেখা যায় ?
তবুও যা একটু দেখছি তাতেই অনেকটা মন ভরে যাচ্ছে । পাহাড়ের বুক চিরে সড়কের দু’ধারে ঢেউখেলানো নীলাভ রূপের ঝিলিক নজর কাড়ছে । দৃষ্টির সীমান্তজুড়ে মেঘের মলাটকরা অবারিত সবুজের বন- বনানি , আমার দিকে তাকাচ্ছে আর আমাকে অব্যক্ত ইশারায় তাদের কাছেই ডাকছে ।

যেদিকে দৃষ্টি যাচ্ছে পাহাড়ি গাঢ়- কালো মায়ায় আমার পথিকনয়ন-যুগল গেঁথে থাকছে । দূরের ঐ পাহাড়গুলো যেনো নীলাকাশে হেলান দিয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে । মৌসুমী হাওয়ায় ভেসে আসা বুনোফুলের মৌমৌ সুগন্ধে , বিকেলের ক্লান্তিও কিছুটা দূরীভূত হচ্ছে । ফুলের অমৃত সুবাসে বুকটা ক্রমশঃস্ফীতই হচ্ছে । জলসা- ঘরের নব অতিথির ন্যায় , আমি প্রফুল্ল-মত্ত-মাতোয়ারা ।

গুমোটধরা ভেঁপসা গরমে কখনো বিদ্রোহী মেঘের বকুনি শুনছি । চম্পা , কদম্ব , কেতকী , জারুলের মিঠেকড়া সুগন্ধ নাকে আসছে । কখনো বা চাঁপালিশ , সেগুনের উগ্র ভেঁদর গন্ধে মাথাটা আউলা ডিগবাজি খাচ্ছে ।

কিছু বয়েসী লম্বা কড়ই , জারুল , নিমের গাছ দেখলাম স্যাঁত স্যাঁতে পিচ্ছিল সারীবদ্ধ গাছগুলো গাছে পেঁছিয়ে আকাশ ফুঁড়ে উঠা শত প্রকারের বুনো গুল্ম লতা ।কোনো কোনো লতায় কী সুন্দর মনোলোভা ফুল , গুল্ম-কলি আর দৃঠিহরা ফুলের নন্দিত-শোভা , মোহনীয় জাদুর খেলা শুরু করেছে । শত সহস্র তাজা-পুষ্প-ডালায় যেনো কোনো লংকান কুমারীর বিয়ের আয়োজন চলছে ।

গগনচুম্বী গর্জন , সেগুনে ঝুলে আছে থোকায় থোকা কাঁইবিচি আর ঘিলালতা । হালকা বাতাসে গাছভর্তি লালে লাল ওড়িয়াআম , গাছতলে ঝরে ঝরে পড়ছে । জঙ্গলের এসব আম কুড়ানোর মানুষ কই ?খাবার মানুষ কই ? ইচ্ছে হচ্ছে নেমে বিনে পয়সার রাজকীয় ফলগুলোর কিছু কুড়িয়ে নিই ।

পর্বতের ঢালুতে আধাপাকা বাঁদরহুলা , কাউগুলা , লটকন নজর কাড়ছে । মন চাচ্ছে গাড়ি ছেড়ে হিলারী-তেনজিং
এর মতো পর্বতে গিয়ে চড়ি ।

ইতোমধ্যে নুরুলহুদা কাদেরী স্কুলের সহ্নিকট পাহাড়ী শৈলজা দেখে খুব তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে পুলক লাগছে । আর এ জায়গাটা খুব ভয়ংকর একটা এলবো মোড় ।অনেক দূর্ঘটনা কিন্তু এখানে ঘটতে পারে । সেজন্যে চালকদের হতে হবে খুব সতর্ক । এ সড়কে প্রায় শত মোড়ের বিপদসংকুল ঘূর্ণি মোড় কে ,
লোকেরা কেনো জানি বারো ঘুণিয়া নাম রাখছে ! বিষয়টি ভেবে বড়ই বেখাপ্পাই মনে হচ্ছে ।

একটু দূরে চিরহরিৎ বনের পিচ্ছিল ঢালু চূঁড়ায় দেখা গেলো জুমচাষ । বিশেষ পদ্ধতিতে একই গর্তে এক সাথে অনেক গুলো ফল-ফসলের বীজ রোপনকে জুমচাষ বলে ।ফসলের কোনটি একমাস পর , কোনোটি দু’মাস আবার কোনটি চার-ছয়মাস পর তোলা হবে । বন- পাহড়ে এটি আজব ধরনের এক কৃষিকাজ বলা চলে । পাহাড়ী উপত্যকায় উপজাতি বা আদীবাসী মেয়েরাই এসবে সারাক্ষণ কঠিন পরিশ্রম করে নানান রকম ফল আর ফসল ফলাচ্ছে ।

পাহাড়ি জনপদের অধিবাসীদের সেকেলে কৃষিকৌশল আধূনিকতাকেও পরাস্ত করেছে । আদিবাসীরা কোনরূপ গরু , লাঙল , জোঁয়াল
পাওয়ারটিলার ছাড়াই বৎসরে প্রায় নয় মাস এখানে বিচিত্র সব ফল-ফসল ফলাচ্ছে । বড়ই অবাক লাগছে !
এরকম নির্ভেজাল ফল-ফসল বাংলাদেশের আর কোথাও কী আছে ?

আদা , হলুদ , জুম্মামরিচ , করলা , বরবটি , মারফা ,
গুনছিগুলা , লাউ , শশা , ঝিঙ্গা , চিচিঙ্গা , কুমড়া ,
সত্যিকারের অনন্য স্বাদের
লাল , সবুজ কচু , মিষ্টি কুমড়ায় জুমক্ষেত ভর্তি ।মো’আলু,গাত্ত্যুয়াআলু,মাইট্যা আলু,ঠান্ডাআলু,বারোমাসি ঝুমকাবেগুন সহ শত কিছিমের শাক-সবজিতে বাগান ভরে আছে ।

কোথাও প্রকান্ড গাছে বেল পেঁকে আছে । তেঁতুল গাছে ফুল এসেছে । হাজার চালিতার ভারে গাছ ন্যূয়ে পড়েছে । আমার দেহনথেকে মনটা চোখের পলকেই বেরিয়ে চলে গেলো সেই জুমফসলের সুশোভিত কাননে ।ক’জনপাহাড়ি নারী-পুরুষ সেই ফসল কেটে তাদের মাথায় বাঁধা পিঠের থুরুমে ভরছে । এতদূর থেকে ও জুমিয়াদের আবছা নড়াচড়া অনুমান করা যাচ্ছে । তাদের মুখে তামাকু চুরুটের ধোঁয়ার কুন্ডলী উড়তে দেখা যাচ্ছে ।

আর সারাটা কাপ্তাই সড়কের বাঁকে বাঁকে , কৃষ্ণচুঁড়া ,
আকাশমনিরা রূপের আগুন জ্বালিয়েছে । গ্রীষ্মের খরতা কাটিয়ে ঝড়-বৃষ্টির ফলে পহাড় পাড়ায় , নবীন তরঙ্গ আন্দোলিত হচ্ছে । বনে বনে প্রকৃতি এখন নবযৌবন পেয়ে সবুজের আলপনা এঁকেছে ।

কাপ্তাই সড়কের ধারে ধারে পাহাড়ের ঢালুতে হালকা-
পাতলা কিছু বাড়িঘর মারাত্মক ঝুঁকিতে কোন রকম দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে । এসবে সড়ক দূর্ঘটনা,ভূমিকম্প,কিংবা পাহাড় ধ্বসের সমুহ আশংকা আছে ।

খানিক পর পর উতলা পাগলা সমীরণ বইছে । আলতো ভাবে আমাদের ঘর্মাক্ত শরীরে ,
শীতলতার একরাশ পরশ বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে । কী যে অপূর্ব লাগছে !

আবার কখনো দৃষ্টি চলে যায় হৃদয়ের ডানায় চড়ে । যাচ্ছে জুমের সীমানার বৃক্ষ প্রাচীর ডিঙিয়ে উঁচু পর্বতমালা ভেদকরে,দূরের ঐ সাদা মেঘের দেশে ।
এখন অন্যরকম অজানা এক অনুভূতির অনুরণনে , হৃদয়ের মনিকৌঠায় স্বর্গীয়- প্রশান্তির
আবেশ ছড়িয়ে দিচ্ছে । আমার দেহ-মনে বড় ভালো লাগা কাজ করছে ।

এতক্ষণে কাপ্তাই বাজারে এসে সিএনজি থেমেছে । পতিমধ্যে ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকেরা বড়ই ছড়ি আর লিচুবাগান থেকে লোকাল বাসেরাঙগামাটি ,
বান্দরবান যাচ্ছে ।

কাপ্তাই উপজেলার নামফলক দেখা যাচ্ছে । মনে হলো শিল্পী সুলতানের রংতুলিতে আঁকা,অপূর্ব সুন্দর-পরিচ্ছন্ন,
পরিপাটি একটা পাহাড়ি মনোমুগ্ধকর শহর কাপ্তাই ।এখানকার মানুষের মনে কোনোরূপ দুঃখ-সন্তাপের লেশমাত্র নেই । কিছুটা পাহাড় কেটে কেটে বানানো হয়েছে ছোট্ট একটা শহর কাপ্তাই ।

?কাপ্তাইকে মনে হচ্ছে যেনো গহীন বনে , সুনসান একটি নিরব ঘুমন্ত শহর । কোনো যানজট নেই শহরটাতে ।কোথাও ময়লা-আবর্জনা,দূর্গন্ধ পর্যন্ত নেই । এখানকার নাগরিকরা নিজেরা পরিচ্ছন্নতার ব্যপারে খুব সচেতন ।

হেলন্ত দুপুরেও এই শহরে নেই কোনো কোলাহল,বাদ্যবাজনা ।হাসিখুশী পাহাড়ি-বাংগালী মানুষগুলো মিলেমিশে যে যার কাজকর্ম করছে । কিছু আদিবাসী মানুষ-জন রাস্তার ধারে পেঁপে,পেয়ারা,আতা,
তেঁতুল,কাঁচা আম,পাকা জাম
ইত্যাদীর পসরা বসিয়েছে ।দু’য়েকজন ব্যবসায়ী,কর্ণফুলির সদ্য তোলা কেঁচকী,
বোয়াল,বাঙলা মৃগেল,পাঙ্গাশ আর সুস্বাদু কালীবাউশ মাছ বিক্রি করছে ।

পাহাড়ি-বাঙগালী সকলে মিলেমিশে পণ্য বিকিকিনি করছে।সর্বত্র মানুষের মধ্যে অন্যরকম এক সম্প্রীতি,সহমর্মিতা ও
সহাবস্থানের মায়া-বন্ধন বিরাজ করছে।

কাপ্তাই থানাকে পাহাড় চুঁড়ায় আর উপজেলাকে পাহাড়তলিতে।দেখতে কী যে দারুন লাগছে!

শহরের বুক চিরে চারটি রাস্তা চারদিকে চলে গেছে।একটি রাস্তা উপজেলার দিকে দ্বিতীয়টি পশ্চিমে রাঙগামাটির দিকে,তৃতীয়টিতো পেছনে চট্টগ্রামের দিকে,চতুর্থটি আমার সম্মুখের গন্তব্যপথ কাপ্তাই জল বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে ইষৎ বেঁকেই নেমে গেছে।
চলবে..

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.