সাংগ্রাই জলোৎসবকে ঘিরে পাহাড় যেন উৎসবের নগরী
মাহফুজ আলম, রাঙ্গামাটি থেকে : পুরাতন বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে পাহাড় সেজেছে উৎসবের নগরীতে। আগামী ১৬ এপ্রিল মারমাদের সাংগ্রাই জলোৎসবের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ে নামবে বৈসাবি উৎসবের জোয়ার। বর্ণাঢ্য এ দিনকে লক্ষ্য করে পাহাড়ের প্রতিটি গ্রামের ঘরে ঘরে চলছে উৎসবের আমেজ। উল্লেখ্য মহামারী করোনায় পার্বত্য অঞ্চলের গত ২ বছর পাহাড়ের বৈসাবী উৎসব পালিত না হলেও এ বছর আনন্দ উৎসব যেন আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। এই উৎসবের সৌন্দয্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী-পুরুষ ও দেশী বিদেশী পর্যটকরা এসে অবস্থান করছে পাহাড়ের পর্যটন এলাকা গুলোতে।
বৈসাবিকে কেন্দ্র করে ফুটে ওঠে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। তাই এটি পাহাড়িদের সাংস্কৃতিক চেতনার উৎসস্থল সামাজিক সাম্যবাদের প্রতিফলন। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকজন বছরের শেষদিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন পারস্পরিক সম্প্রীতির বন্ধন করে সান্নিধ্য লাভ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন ভাষায় এ উৎসবের ধরন ভিন্ন ভিন্ন হলেও উৎসবের লক্ষ্য ও রীতি প্রায় এক।
বৈসাবিতে পার্বত্য অঞ্চলের ১৩টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা সকল ভেদাভেদ ভুলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শান্তির পৃথিবী গড়ে তোলার শপথ নেয়। চাকমা সম্প্রদায় এ উৎসবকে বলে ‘বিজু’ ত্রিপুরারা বলে ‘বৈসু’ আর মারমারা বলে সাংগ্রাই। ত্রিপুরাদের বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু মিলে সংক্ষেপে এই উৎসবটির নামকরণ করা হয়েছে বৈসাবি।
আদিকাল থেকে পাহাড়িরা স্বীয় বৈশিষ্ট্যের বিজু সাংগ্রাই ও বৈসু পালন করে আসছে। চাকমাদের মতে বিজুতে সবার মনে বয়ে আনে অপরূপ সম্প্রীতি। জাতি, শ্রেণি, ধনী, গরীব শত্রু-মিত্রের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকে না। সবাই যেন এই সামাজিক উৎসবকে নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করে। তাই বিজু বয়ে আনে সম্প্রীতি, নতুন চিন্তা-চেতনা। চাকমা সমাজে এটি একটি অত্যন্ত আনন্দঘন দিন। চৈত্র মাস ঢুকার সাথে সাথে উৎসবের আমেজ পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়লেও মুলত ১২ এপ্রিল থেকে পাহাড়ের ৫ দিনের মুল উৎসব শুরু হয়। এই ৫ দিন পাহাড়ে বিভিন্ন দিন বিভিন্ন নামে উৎসব পালিত হয়।
১২ এপ্রিল, ২৯ চৈত্র ফুল বিজু ঃ চৈত্র মাস শেষের দিনের আগের দিন চাকমরা পালন করা হয় ফুল বিজু, ত্রিপুরা পালন করে হারি বৈসু। উপজাতীয় জনগোষ্ঠী ভোরে উঠে পাহাড়ের বিভিন্ন বাগান থেকে ফুল তুলে গঙ্গাদেবীর উদ্দেশ্যে ফুল ভাসানোর মধ্যে দিয়ে ফুল বিজুর সূচনা করা হয়। এছাড়াও বৌদ্ধবিহার, নদী বা খালে গিয়ে আগামী দিনের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য ভগবান বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করে। বিকেলে মোমবাতি এবং সাদা সুতা দিয়ে তৈরি বাতি সরিষার তৈল দিয়ে জ্বালিয়ে একই স্থানে প্রার্থনা করা হয়। ফুল দিয়ে ঘরে প্রতিটি দরজার মাঝখানে মালা গেঁথে সাজানো হয়।
১৩ এপ্রিল ,৩০ চৈত্র মূল বিজু: এই দিনটি বর্ষাবিদায়ী দিন বললেই চলে। ৩০ চৈত্র এই উৎসবটি পালিত হয়। এই দিনটি মূলত চৈত্রসংক্রান্তির দিন পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা সম্প্রদায় এ দিনকে মূল বিজু বলে থাকে। এ দিনে পাহাড়িদের ঘরে ঘরে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করা হয়। যে খাবারটি প্রায় ঘরে ঘরে তৈরি করা হয় তা হলো অতি পরিচিত ‘পাচন’। বিভিন্ন সবজী ও ফল মুল দিয়ে সহকারে প্রায় শতাধিক পদ দিয়ে তরকারি দিয়ে রান্না করা হয়। এই দিনে প্রতিটি ঘরে ঘরে চলে অতিথিদের আপ্পায়ন। সুসাধ্য পাঁচন, বিভিন্ন খাবার পরিবেশন করা হয়। এছাড়া অতিথিদের আপ্পায়ন করা হয় তৈরি মদ দিয়ে খাবার পরিবেশন করা হয় অতিথিদের। এদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করে ও স্নান সেরে নেয় সবাই। তারপর নতুন বা পরিষ্কার জামা-কাপড় পরে সবাই ঘুরতে বের হয়। অনেক রাত পর্যন্ত চলে এই ঘোরাফেরা। এ সময় গান বাজনাও চলে।
১৪ এপ্রিল, ১লা বৈশাখ। এই দিনটিকে পাহাড়ের গয্যা পয্যা দিন: বলে থাকে। এ দিনটি হলো মূল বিজুর পরের দিন। অর্থাৎ ১ বৈশাখে এটি পালিত হয়। এই দিনে ভালো ভালো খাবার তৈরি করে বয়োজ্যেষ্ঠদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। যাতে গুরুজনদের আশীর্বাদ পেয়ে আজীবন সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী জীবনযাপন করা যায়। ১৫ এপ্রিল ২ বৈশাখ পাহাড়ে প্রতিটি সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে চলে আনন্দ উৎসব। ১৬ এপ্রিল মারমাদের সাংগ্রাই উৎসবের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। মারমা তরুন তরুনীরা একে অপরের গায়ে পানি ছিটিয়ে পুরাতন বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। এই দিনটি ঘিরে পার্বত্য অঞ্চল সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রাঙ্গামাটিতে এসে ভীড় করে হাজার হাজার মানুষ। পাহাড়িদের অন্যতম সামাজিক এ উৎসবকে ঘিরে রাঙ্গামাটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ইনস্টিটিউট আগামী এপ্রিল থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত ৫ দিনব্যাপী বৈসাবি মেলা, নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ।