নেত্রকোণায় ভিজিএফের চাল নিয়ে জজ মিয়া নাটক
মেহেদী হাসান আকন্দ: নেত্রকোণার কলমাকান্দায় অতিদরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে দেওয়া (ভিজিএফ) চাল নিয়ে ‘জজমিয়া’ নাটক সাজিয়ে খারনৈ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে ফাঁসানোর ঘটনা ঘটেছে। এমন অভিযোগ করেছেন উপজেলার খারনৈ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. ওবায়দুল হক। গত ৭ জুলাই ঈদ উপলক্ষে উপজেলার খারনৈসহ আট ইউনিয়নে অতিদরিদ্রদের জন্য ভিজিএফ চাল বিনামূল্যে চাল বিতরণ করা হয়। এদিন রাত সাড়ে দশটায় সদর ইউনিয়নের নয়ানগর মেদির বিলে একটি নৌকা থেকে ভিজিএফের ১২৮ বস্তা চাল জব্দ করে স্থানীয়রা। এ ঘটনায় নৌকার মাঝি জজ মিয়াকে গণধোলাই দেয় জনতা। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ সময় মাঝির সহাকারী আরমান হোসেন সানোয়ারকে আটক করে পুলিশে দেওয়া হয়।
পরে খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঘটনাস্থলে যায়। জিজ্ঞাসাবাদে সরকারি চাল খারনৈ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. ওবায়দুল হকের নির্দেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে জানায়, মাঝির সহকারী আরমান হোসেন সানোয়ার। চাল আটকের ঘটনায় পরদিন (৮ জুলাই) মাঝির সহাকারী আরমান হোসেন সানোয়ারের ভাষ্য অনুযায়ী থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন কলমাকান্দা উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. লতিফুর রহমান। এটিই পরে মামলায় রুপান্তরিত হয়। এ ঘটনায় চেয়ারম্যান মো. ওবায়দুল হককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন ইউএনও মো. আবুল হাসেম। পরে যথা সময়ে এর জবাবও দেন চেয়ারম্যান। জবাবে এই ঘটনাকে প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেন তিনি। পরে গত সোমবার (১৮) জুলাই চাল জব্দের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। ১০ কার্য দিবসের মধ্যে তাদেরকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট স‚ত্রে জানা গেছে, গত ৭ জুলাই খারনৈ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. ওবায়দুল হকের বাউশাম বাজারস্থ অস্থায়ী কার্যালয়ে ৩৯ টন (১৩০০ বস্তা) চাল জন প্রতি ১০ কেজি করে ৩ হাজার ৯০০ জনের মধ্যে বিতরণ শুরু হয়। ট্যাগ অফিসার একাডেমিক সুপার ভাইজার মুহাম্মদ তারিকুল ইসলামের উপস্থিতিতে সকাল সাড়ে নয়টা থেকে বিতরণ শুরু হয়। বিকাল ৫ টায় ১২৭০ বস্তা (প্রতি বস্তায় ৩০ কেজি) চাল বিতরণ হওয়ার পর লোকজন কমে গেলে ট্যাগ অফিসার কাগজে প্রত্যয়ন পত্র স্বাক্ষর করে চলে যান। এ সময় বিতরণে বাকি থাকে ৩০ বস্তা চাল।
ট্যাগ অফিসার চলে যাবার পর আর মাত্র ১৫ বস্তা চাল বিতরণ হয়। বাকি ১৫ বস্তা স্টকে থেকে যায়। চাল বিতরণের বিষয়ে ট্যাগ অফিসার একাডেমিক সুপার ভাইজার মুহাম্মদ তারিকুল ইসলাম বলেন, আমি নিজে উপস্থিত থেকে চাল বিতরণ করেছি। সার্বক্ষণিক দুইজন পুলিশ সদস্য ছিল। মাঝখানে সেনাবাহিনী চাল বিতরণ দেখতে এসেছিলেন। তারা মেপে দেখে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গেছেন। এদিন সন্ধ্যা ছয়টা-সাড়ে ছয়টার দিকে চলে আসি। তখন উপকারভোগীদের আসা কমে গিয়েছিল। এ সময় ১২৭০ বস্তা চাল বিতরণ শেষ হয়। আর ৩০ বস্তা (৯০০ কেজি) চাল রেখে আসি। উপস্থিত মেম্বারদের বলে আসি লোকজন আসলে তারা যেন বিতরণ করেন। পরে ১২৮ বস্তা চাল জব্দের কথা শুনেছি। ওই চাল কার বা কোথা থেকে এল বলতে পারবো না। খারনৈ ইউনিয়নের ১নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মো. তাজ উদ্দিন, ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার সুবোধ হাজং, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মো. সুরুজ মিয়া, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মো. আশাদ মিয়া, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার এনামুল হক, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আওলাদ হোসেন, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মোহাম্মদ আলী, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মো. আব্দুল খালেক, সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার (১,২,৩) মদিনা খাতুন ও সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার (৪,৫,৬) শামছুন্নাহার জানান, আমরা প্রতি মেম্বার ১০০ জন করে মোট ১২০০ জনের নামের সুপারিশ করেছি। আমাদের ১২০০ জনের সবাই চাল পেয়েছে।
এ বিষয়ে জনগণের কোন অভিযোগ নেই। আমরা নিজেরা উপস্থিত থেকে চাল বিতরণ করেছি। পরদিন শুনলাম ১২৮ বস্তা চাল ধরা পড়েছে। কিন্তু এত চাল আসলো কিভাবে। এটা কোন ষড়যন্ত্র হবে। সঠিকভাবে তদন্ত করে ওই চাল কার কোথায় থেকে কে আনলো এটা বের করা হোক। তাদের দাবি- সকালে চাল বিতরণের সময় একদল যুবক চাল মাপে কম দেওয়া হচ্ছে বলে গুজব রটায়। পরে সেনাবাহিনী এসে উপকারভোগীদের চাল নিয়ে মেপে দেখেন পরিমাণ ঠিকই আছে। এতে করে বাধ্য হয়ে পিছু হটে ওই যুবকেরা। পরে রাতে হয়তো তারাই এই নতুন নাটক সাজিয়েছে। সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঘটনার দিন সকালে একদল যুবক চাল ওজনে কম দেওয়া হচ্ছে এমন গুজব ছড়ায়। পরে সেনাবাহিনী এসে মেপে সঠিক প্রমাণ পেলে এ যাত্রায় তারা পিছু হটে। পরে রাতে ১২৮ বস্তা চাল নৌকা করে নিয়ে খারনৈ যাবার পথে মেদির কান্দা হাওরে কারেন্ট জালে নৌকা আটকে গেলে বাধে বিপত্তি। সূত্র মতে, খারনৈ ইউনিয়নের সীমানায় যাওয়ার পর প্রশাসনকে জানানোর পরিকল্পনা ছিল তাদের। কিন্তু নৌকার মাঝির সাথে জালের মালিকের দ্ব›দ্ব শুরু হলে ওই যুবকেরা ইউএনওকে কল করে চাল চুরির বিষয়টি জানায়। ইউএনও গিয়ে চাল জব্দ করে। এ সময় খবর পেয়ে সাংবাদিকরাও গিয়ে হাজির হয়। মাঝি জজ মিয়া আহত হলে তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। শেখানো পরিকল্পনা অনুযায়ী মাঝির সহকারী আরমান হোসেন সানোয়ার জানায়, চেয়ারম্যান ওবায়দুল হকের নির্দেশে এসব চাল তারা পাশের এক বাজারে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে কার কাছে নিয়ে যাচ্ছিলেন এটা বলতে পারেন না। পরে তাকে আটক করা হয়। ঘটনার দশদিন পর রফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি চেয়ারম্যান মো. ওবায়দুল হকসহ সাতজনকে আসামি করে কলমাকান্দা থানায় মামলা দায়ের করেন। তার অভিযোগ চাল জব্দের সময় চেয়ারম্যানের নির্দেশে তাঁকে মারধর করা হয়। তবে তার এজাহারে চাল জব্দ ও মারধরের সময় প্রকৃত ঘটনার এক ঘণ্টা আগে উল্লেখ করা আছে। কলমাকান্দা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. লতিফুর রহমান বলেন, জব্দকৃত চালগুলো সরকারি ত্রাণেরই। তাই এ ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি করেছি। তবে চালগুলো কার বা কোন ইউনিয়নের এটা জানি না। তদন্তের মাধ্যমেই প্রকৃত ঘটনা বের হবে আশা করছি। খারনৈ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. ওবায়দুল হক বলেন, পুরো ঘটনা সাজানো। আমাকে ফাঁসাতেই এই সব আয়োজন।
ট্যাগ অফিসার, পুলিশ, মেম্বারগণ সহ সবাই উপস্থিত থেকে চাল বিতরণ করা হয়েছে। বিতরণ নিয়ে জনগণের কোন অভিযোগ নেই। ট্যাগ অফিসারের প্রত্যয়ন অনুযায়ী মাস্টার রোল দেখে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনের দাবি জানান তিনি। কলমাকান্দা থানার ওসি মোহাম্মদ আবদুল আহাদ খান জানান, এ ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। এদিকে দুদকেও অভিযোগ হয়েছে। বিষয়টি তদন্তাধীন আছে। কলমাকান্দার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবুল হাসেম বলেন, এ ঘটনায় চেয়ারম্যানকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছিল। যথা সময়ে তিনি এর জবাব দিয়েছেন। পরে কৃষি কর্মকর্তাকে প্রধান করে তিন সদস্যর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ট্যাগ অফিসারের প্রত্যয়ন ও স্টক লিস্ট অনুযায়ী ১৫ বস্তা বাদে সব চাল বিতরণ হয়েছে। তবে চেয়ারম্যান বিক্রির জন্য এত চাল (১২৮ বস্তা) পেলেন কোথায় ? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি আসলে গোলমেলে, হিসেব মিলছে না। তবে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ বিষয়টি পরিষ্কার হবে আশা করছি।