আলোকিত সমাজ গড়তে জ্ঞানের আলোর বর্তিকা ছড়াচ্ছে মোহনগঞ্জ সাধারণ পাঠাগার
মেহেদী হাসান আকন্দ: ভাটি বাংলার সিংহদ্বার খ্যাত নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জে ১৯৮৮ সালে কতিপয় জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তির প্রচেষ্ঠায় গড়ে উঠেছিল মোহনগঞ্জ সাধারণ পাঠাগার। কালের বিবর্তনে বহু বিদ্যানুরাগিদের আত্মপ্রচেষ্ঠায় সমাজকে আলোকিত করতে নিয়মিত জ্ঞানের আলোর বর্তিকা ছড়াচ্ছে পাঠাগারটি। নদী ও হাওর বেষ্টিত ভাটি অঞ্চল মোহনগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত এ পাঠাগারে পাঠকদের জন্য প্রায় ৫হাজারের অধিক বই সংরক্ষণ করা হয়েছে। রাখা হয় প্রতিদিন ৯টি জাতীয় পত্রিকা। শিশু, কিশোর, বয়স্ক প্রত্যেকের জন্য রয়েছে আলাদাভাবে বসে বই পড়ার মনোরম ব্যবস্থা। প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পাঠকদের জন্য উম্মুক্ত থাকে এ পাঠাগার। দৈনিক প্রায় ১৪০-১৫০ জন বিভিন্ন বয়সী পাঠক পাঠাগারে বসে পছন্দের বিভিন্ন বই ও পত্রিকা পড়ে।
বিশিষ্ট নাট্যকার ও পাঠাগারের সহ সভাপতি হাজী সুলতান আহম্মেদ জানান, শিশু-কিশোররা পাঠ্যবই ছাড়া অন্যকিছু পড়ার সুযোগ পায় না। তাদের নতুন জ্ঞানের সন্ধান মেলে না, জ্ঞানের জগৎ থেকে তারা অনেক দূরে রয়ে যায়। তাই শিশু-কিশোরদের পাঠাগারে বই পড়তে আকৃষ্ট করতে রাখা হয়েছে বিভিন্ন শিশুতোষ গল্প, উপন্যাস, বিজ্ঞান মনস্ক বই। তারা যেন বৈজ্ঞানিক বিশ্বাস, আনন্দ, সৌন্দর্য এবং মূল্যবোধের সঙ্গে পরিচিত হয় এবং উচ্চতর জীবন সন্ধান ও দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে পায়। বয়স্কদের জন্য রয়েছে ধর্মীয় বিভিন্ন বই। এছাড়াও বাংলা পিডিয়ার সবগুলো গ্রন্থখন্ড ও নজরুল সমগ্র সমূহ পাঠকদের জন্য পাঠাগারে সংরক্ষিত রয়েছে।
পাঠাগারটি সমৃদ্ধ করতে অনেক গুনীজন পাঠাগারটি পরিদর্শন করেছেন। তাদের মধ্যে জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক মো: ফজলে রাব্বি, বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক হুমায়ন আহমেদ, খ্যাতিমান লেখক ড. জাফর ইকবাল, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আব্দুল মোমেন এমপি, প্রবন্ধকার ও কথা সাহিত্যিক কামাল নোহানী, কবি আসাদ চৌধুরী, তত্তাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ও বিচারপতি হাবিবুর রহমান, সাবেক সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর, এলিজাবেথ ষ্টিট ইউনির্ভাসিটির ভাইস চ্যাঞ্জেলর ডা: আতাহার আলী খান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ও বিমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান সাজ্জাদুল হাসান, বীরশ্রেষ্ট মতিউর রহমানের সহধর্মিনী মিলি রহমান, কথা সাহিত্যিক হুমায়ন আহমেদের মা রত্না রর্ভা আয়েশা ফয়েজ, বিশিষ্ট কার্টুনিষ্ট ও লেখক আহসান হাবিব, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীন। শিক্ষানুরাগী ও পাঠাগারের সহ সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বলেন, বেঁচে থাকার জন্য মানুষের যেমন খাবার দরকার, তেমনি জীবনকে গতিময় করার জন্য দরকার জ্ঞান।
কারণ, জ্ঞান হল মনের খোরাক বা খাবার। আর জ্ঞানের আধার হল বই, যা সংরক্ষিত থাকে পাঠাগারে। প্রতিটি সমাজে যেমন উপাসনালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল দরকার, তেমনি পাঠাগারেরও প্রয়োজন রয়েছে। পাঠাগারে আসা অবসর প্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সাজ্জাদুল হক বলেন, মানুষের মনে রয়েছে অনন্ত জিজ্ঞাসা, অসীম কৌতূহল। তার এই অনন্ত জিজ্ঞাসার জবাব, অন্তহীন জ্ঞান ধরে রাখে বই। পাঠাগারের বইয়ের ভান্ডারে সঞ্চিত আছে মানবসভ্যতার শত শত বছরের হৃৎস্পন্দন। এটি মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করে থাকে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তারিন্দা আক্তার নিপা বলেন, সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, সংস্কৃতিসহ সব ধরনের জ্ঞানের আধার হলো পাঠাগার। পাঠাগার একটি জাতির বিকাশ ও উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা ছাড়া জাতীয় চেতনার জাগরণ হয় না। আর তাই পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। মোহনগঞ্জ পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মেজবা উদ্দিন সুজাত বলেন, শিক্ষার আলোবঞ্চিত কোনো জাতি পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। পাঠাগারকে শিক্ষার বাতিঘর বলা হয়। অনেকেরই বই পড়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও টাকার অভাবে বই কিনতে পারে না। তাই পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা প্রতিটি সমাজে অনিবার্য। পাঠাগারের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে সংহতি, যা দেশ গড়া কিংবা রক্ষার কাজে অমূল্য অবদান রাখে।
বই পড়ার যে আনন্দ মানুষের মনে, তাকে জাগ্রত করে তুলতে আজ সব ধরনের পাঠাগারের ব্যাপক প্রসার প্রয়োজন। জীবনে পরিপূর্ণতার জন্য জ্ঞানের বিকল্প আর কিছু হতে পারে না। জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণ করতে প্রয়োজন পাঠাগার। একটি সমাজের রূপ বদলে দিতে পারে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার। গবেষকরা মনে করেন, মনকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পাঠাগারের অবদান অনস্বীকার্য। তাই শহরের পাশাপাশি প্রতিটি গ্রামে, মহল্লায় এধরনের পাঠাগার গড়ে তোলা প্রয়োজন। পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান নান্টু বলেন, ভাটি বাংলার সমাজকে আলোকিত করতে মোহনগঞ্জ সাধারণ পাঠাগার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পাঠাগারে প্রতিষ্ঠাকালিন সদস্য রয়েছে ৪৭জন, আজীবন সদস্য ১৫১জন, সাধারণ সদস্য ৮০৫জন ও পাঠক সদস্য রয়েছে ১৬০জন। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের বই পড়তে আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে নিয়মিত ক্যাম্পেইন করা হয়। পাঠাগার পরিচালনায় ২জন নিয়মিত কর্মচারী রয়েছে। পাঠাগারটি আরোও সমৃদ্ধ করতে সমাজের হিতৈষী ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহবান জানান।