বিচারক উমা দাস পুত্র সন্তানের হাতের ছোঁয়া কাঠিতে আগুন লাগিয়ে মুখাগ্নি করলেন স্বামীর
একাই এসেছিলেন উমাদেবী শশ্বানভুমিতে, চিতার আগুনে স্বামীর দেহ বিলীন করে দিয়ে একাই নিজে নিজের কপালের সিঁদুর মুছলেন, নিজেই ভেংগে ফেললেন নিজের হাতের মংগল শাখা দুগাছি, বিধবা বেশে একাই রওনা দিলেন বাড়ির পথে। সে জানে বাড়িতে কেউ নেই আজ, যে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একটু সহানুভূতির আশ্বাস দেবে, বুকে টেনে নিয়ে ঝাপটে ধরে একটু স্বান্তনার প্রলেপ দিবে, শুধু পথ চেয়ে বসে আছে তার আড়াই বছরের সন্তান তার জন্য।
নিজস্ব প্রতিনিধি :ময়মনসিংহের সহকারী বিচারক উমা দাস পুত্র সন্তানের হাতের ছোঁয়া কাঠিতে আগুন লাগিয়ে মুখাগ্নি করলেন স্বামীর । ময়মনসিংহের সিনিয়র সহকারী বিচারক উমা দাস ঘর বেধেছিলেন ডা: দেবাশীষ দাসের সাথে। নিজে বিচারক হয়েই ইচ্ছা করে বিয়ে করেছিলেন একজন ডাক্তারকে। দুজনের প্রচন্ড ইচ্ছা ছিলো মানবসেবার কাজে নিয়োজিত থাকবে আজীবন। একদিকে বিচার বঞ্চিত জনগণকে ন্যায়বিচার, অন্যদিকে অসহায়দের অসুখ-বিসুখের ডাক্তারি সেবা। ভালোই চলছিলো উমা-দেবাশীষের সংসার, কাজকর্মের প্রশাসনিক ব্যাস্ততার সাথে সংসারের ব্যস্ততা মিলেমিশে একাকার হয়ে চলছিলো তাদের সংসার, এরমধ্যে বছর আড়াই আগে কোল জুড়ে এসেছিলো এক ফুটফুটে সন্তান। স্বপ্ন দেখেছিলো আগামীদিনের মানবসেবার জন্য উপযুক্ত ভাবে গড়ে তুলবে সন্তানকে। কিন্তু হঠাৎ করেই উমা দাসের সংসারে হানা দিলো সর্বনাশা করোনা ভাইরাস। উমাদেবী ঘূনাক্ষরেও চিন্তা করেনি এই ভাইরাসই তার ঘরে ভয়ংকর এক সর্বনাশা লিকলিকে বিষধর সাপ হয়ে ঢুকেছে। এই বিষধর সাপ তার কালোকুট বিষে জর্জরিত করবে তার সাধের সংসার! হলোও তাই!! মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই চিকিৎসায় থাকা অবস্থায় অবস্থায় স্বামী দেবাশীষ দাস হার মানলেন করোনার কাছে। সর্বনাশের এই খবরটা পাবার পরেই উমাদেবী বুঝলো আজ সে একা, বড়ই একা,বিশেষ করে এই মুহুর্তে। ডানে বামে সামনে পিছনে কেউ নেই আজ তার। করোনা ছোয়ার আতঙ্কে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব অফিস সহকারী সবাই আজ দূরে, বহুদূরে। চেনা শহরটাকেই আজ খুব অচেনা মনে হচ্ছে উমাদেবীর। একদিকে বাড়িতে আড়াই বছরের অবোধ অবুঝ সন্তান অন্যদিকে হাসপাতালের মর্গে স্বামীর মৃতদেহ। কি করবে এখন সে? হঠাৎ করেই মন বাধলেন উমাদেবী, স্থীর করলেন নিজেকে, ধীর শান্ত হলেন কিছুক্ষণের জন্য, পায়ের নীচে মাটি না থাকলেও পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাড়ালেন উমাদেবী। একা এবং একাই আয়োজন করলেন স্বামীর শেষ যাত্রার, বাড়ি থেকে নিজেই শিশু পুত্র সন্তানের হাত ছুইয়ে পাটকাঠী সাথে নিয়ে আসলেন শহরের শশ্বান ঘাটে, হিন্দু শাস্ত্রমতে পুত্র সন্তানেরই যে অধিকার পিতার মুখাগ্নিতে।একাই নিরবে নিথরে নির্জন শশ্বানভুমিতে অপেক্ষা করলেন উমাদেবী, কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃতদেহ আনা হলো শশ্বানে, যে কয়জন মৃতদেহ নিয়ে এসেছিলো তাদের সাহায্যেই স্বামীর সৎকারের কাজ শুরু করলেন। জানতে চাইলেন না শশ্বানবন্দীর শেষযাত্রার বন্ধুরা কোন ধর্মের! কোন জাতের? জানতে ইচ্ছাও হলো না তার। উমাদেবী ভালোভাবেই বুঝেছিলেন নিজেদের বিপদকে উপেক্ষা করে যারা মানুষের বিপদে এগিয়ে আসে, তারাই প্রকৃত মানুষ, সব ধর্মের উপরেই তাদের অবস্থান। পুত্রসন্তানের হাতের ছোঁয়া কাঠিতে আগুন লাগিয়ে মুখাগ্নি করলেন স্বামীর। ঘন্টা তিনেক স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলেন উমাদেবী দাউদাউ করে জ্বলা জলন্ত শশ্বানের দিকে তাকিয়ে। সদ্যমৃত প্রিয় স্বামীর দেহ আগুনে পুড়ে যাচ্ছে, সাথে সাথে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে উমাদেবীর স্বপ্ন সাধ ভবিষ্যৎ! একাই এসেছিলেন উমাদেবী শশ্বানভুমিতে, চিতার আগুনে স্বামীর দেহ বিলীন করে দিয়ে একাই নিজে নিজের কপালের সিঁদুর মুছলেন, নিজেই ভেংগে ফেললেন নিজের হাতের মংগল শাখা দুগাছি, বিধবা বেশে একাই রওনা দিলেন বাড়ির পথে। সে জানে বাড়িতে কেউ নেই আজ, যে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একটু সহানুভূতির আশ্বাস দেবে, বুকে টেনে নিয়ে ঝাপটে ধরে একটু স্বান্তনার প্রলেপ দিবে, শুধু পথ চেয়ে বসে আছে তার আড়াই বছরের সন্তান তার জন্য। উমাদেবীর বড় ইচ্ছা আজ মা সন্তানে জড়াজড়ি করে বসে থাকবে বেশ কিছুক্ষণ, কিছুটা হলেও হয়তো খুঁজে পাবে স্বামীর স্পর্শ, অবুঝ সন্তান পাবে বাবার পরশ। যাই হোক! দ্রুতই অবসান ঘটুক উমাদেবীর অন্ধকার কালো রাত্রের। মানসিক ভাবে সুস্থ হয়ে উঠুক উমাদেবী, কঠিন কঠোর দুনিয়ায় সাথে নিজেকে আত্মস্ত করে, খাপ খাইয়ে উঠুক ধীরে ধীরে। বুকের ধন সন্তানকে মানুষ করুক নিজের মতো করে, সমাজ সংসারের কাছে আজ সে ন্যায্য পাওনা বিচার না পেলেও বিচারক উমাদেবী বিচারকের চেয়ারে বসে ন্যায্য বিচার বুঝিয়ে দিক বিচার বঞ্চিত বিচারপ্রার্থী মানুষদের! এই অসহায় পৃথীবির জন্য একজন উপযুক্ত মানুষ হয়ে তৈরি হোক উমাদেবীর বুকের মানিক। মা সন্তান ভালো থাকুক এই প্রার্থনা রাখি আজ সবাই…
করোনা আমাদের সমাজ, বাস্তবতা,সামাজিক-পারিবারিক বন্ধন অনেক কিছু চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো।