নাটোরে বাল্যবিবাহ ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া বেড়েছে
রিয়াজ হোসেন (লিটু), নাটোর: নাটোরে গত দেড় বছরে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গুলোতে ঝরে পড়ার হার-বেড়েছে -বেড়েছে বাল্যবিবাহ। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলোতে এটি প্রকট হয়েছে। বিভিন্ন স্কুলগুলোতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে এই চিত্র। অল্প কিছু ছেলে শিক্ষার্থী বিদ্যালয় ছেড়ে কাজের সন্ধানে এলাকার বাইরে চলে গেছে। অপরদিকে মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। বিশেষ করে অষ্টম এবং নবম শ্রেণীর ৩০ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছেলেদের মধ্যে ৩-৪ শতাংশ পর্যন্ত শিক্ষার্থী স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। এই বিয়ের মধ্যে সপ্তম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীর হার বেশি। বিবাহিতাদের মধ্যে ২-৩ শতাংশ এখনো বিদ্যালয়ে আসছে।
জেলায় কতজন মেয়ের বাল্য বিয়ে হয়েছে তার হিসেব নেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে। জেলা শিক্ষা অফিসার রমজান আলী আকন্দ জানান, প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ মেয়ের বাল্য বিয়ে হয়েছে-তা আমাদের জানা নেই। শিক্ষা বিভাগের তথ্য মতে এই উপজেলায় প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ৫০ শতাংশের ওপরে মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলায় বাল্যবিবাহের হার সবচাইতে বেশি। নলডাঙ্গা উপজেলার কালিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ৪১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৩ জনের বিয়ে হয়ে গেছে। এদের মধ্যে দুইজন এখনো বিদ্যালয়ে আসছে। তাদের একজন সুখী খাতুন অত্যন্ত ক্ষীণকায়। তাকে এই বিয়েতে মত ছিল কিনা জানতে চাওয়া হলে সে নীরব থাকে। পরক্ষণে জানায় তার বাবা অসুস্থ, বেশি দিন বাঁচবেন কিনা, এই কারণেই কন্যাদায় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এই বিয়ে দিয়েছেন। আরেকজন শিক্ষার্থী আদরি খাতুন জানায়, তার বাবা ভালো ছেলে পেয়েছে তাই তার বিয়ে দিয়েছে। এই বিয়েতে তারও কোন অমত ছিল না।
যারা একেবারেই স্কুল ছেড়ে দিয়েছে তাদের একজন অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, বারবার টেলিভিশনের খবর দেখে তিনি জেনেছেন করোনার কারণে কবে স্কুল খুলবে তার কোন নিশ্চয়তা নাই। মেয়েকে বাড়িতে রেখে কি করবেন- তাই বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। আরো একজন অভিভাবক জানান, বাড়িতে যখন মেয়েকে দেখি, তখন আমার কাছে বোঝা মনে হয়। এই কারণেই তাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। এমনি অনেক অভিভাবকই জানিয়েছেন স্কুল খোলার কোনো নিশ্চয়তা না থাকায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকা সত্বেও তারা তাদের মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। কালিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক একাব্বর আলী জানান,এই যে বাল্যবিয়ে দিয়েছেন অভিভাবকরা বিয়ে সংক্রান্ত কোনো জটিলতা হলে তারা তো আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন না।
প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভয়ে তারা নিবন্ধিত কাজী ছাড়াই কলেমা পড়িয়ে বিয়ে সম্পন্ন করেছেন। প্রধান শিক্ষক মোঃ এনামুল হক জানান, আমি এবং আমার শিক্ষকরা করোনাকালে বিভিন্ন বাড়িতে গিয়েছি পাড়া-মহল্লায় গিয়েছি তাদের খোঁজখবর নিতে। কিন্তু বরাবরের মত সব অভিভাবকই বিয়ের কথা টি গোপন করে গেছেন। নারী নেত্রী এবং সমাজসেবক শামীমা লাইজু নীলা জানান, করোনাকালে বাল্যবিয়ে মতো ভয়ঙ্কর একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারেনি।ঠিক তেমনি শিক্ষকরাও ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়িতে যাননি। তাদের মধ্যে এই যোগাযোগের শূন্যতা এমন একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে। বিশেষ করে মেয়ে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা বেশিরভাগই অসচেতন একথা ঠিক। তার পরেও আমাদের পাঠ্যপুস্তকে প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা সংযুক্ত করতে না পারা এবং এই বিষয়ে কাউন্সেলিং করতে না পারার কারণেই মূলত বাল্যবিয়ে এবং ঝরে পড়ার মত এমন ঘটনা ঘটছে।