পাবনায় অবৈধভাবে বালু-মাটি উত্তোলন ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাবাসী : নির্বিকার প্রশাসন
রফিকুল ইসলাম সুইট : বালু-মাটি উত্তোলন ও পরিবহণের থাবায় নিঃস্ব এলাকাবাসীর অসহায়ত্ব, বিনষ্ট সড়ক, ক্ষতিগ্রস্ত জীববৈচিত্র ও পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহতা সরেজমিনে ঘুরে এসে এইপ্রতিবেদক পদ্মা-যমুনা বিধৌত পাবনা জেলার বালু-মাটি খেকো সিন্ডিকেট, নির্বিকার প্রশাসন ও সুবিধা ভোগীদের সম্মিলিত থাবায় বিপর্যস্ত জনপদের দুর্দশা ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন উন্মোচনের প্রথম পর্ব।
পাবনার সদর উপজেলার হেমায়েতপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ-পশ্চিম দিয়ে প্রবাহিত হওয়া পদ্মা নদীর পার বাজিতপুরঘাট হঠাৎ পাড়া. নেয়ামত উল্লাহপুর ভবানীপুর, চরগোষপুর, চুলিকানির হাট,বাংগাবাড়িযা এলাকার ফসলি জমি থেকে স্কেভেটর বা ভেকুমেশিন দিয়ে মাটি কাটার মহোৎসব চলছে। কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে প্রশাসন ম্যানেজ করে চলছে মাটিকাটা। গভীরভাবে গর্ত করে মাটি কাটায় হুমকির মুখে(ভেঙে) পড়েছে অন্যদের(পাশের) ফসলী জমি, কলা বাগান সহ চরাঞ্চলে বসবাসরত মানুষের বসত ভিটা। বাধ্য হচ্ছে এসব মাটি দস্যুদের কাছে নাম মাত্রমুল্যে জমি বিক্রি করতে।
হেমায়েতপুর ইউনিয়নের পদ্মা বিধৌত এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খাদ মালিক নামে পরিচিত ভিন্ন ভিন্ন প্রায় ১০/১৫ জন মাটি দস্যু অসংখ্য ফসলি জমি খনন করে প্রায় ১০/১৫টি খাদ সৃষ্টি করেছে। নিজেদের জমি দাবী করে খনন করা এসকল খাদের মাটি যাচ্ছে উপজেলার বিভিন্ন ইটভাটা, খালভরাট ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রজেক্টেও ভরাট কাজে। অসংখ্য ভেকুমেশিন বা স্কেভেটর দিয়ে প্রতিদিন ও শতশত ট্রলি ও ডাম্প ট্রাকে মাটি পরিবহণ করায় নষ্ট হচ্ছে জনপদের রাস্তা-ঘাট। পাকা ও আধাপাকা রাস্তা গুলো ভেঙে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে; পরিবেশ হচ্ছে বিপন্ন। এলাকাবাসী অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না। এলাকাবাসীর ধারনা, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের দু-একজন প্রভাবশালী রাজনীতিকের আত্মীয় পরিচয় বা নেক-নজরে থাকায় এসকল খাদ মালিকগণ সহজেই স্থানীয় প্রশাসনের দু-একজন অসাধু কর্মকর্তার সাথে যোগসাজসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন স্থানীয় ব্যাক্তি ইমন, মিঠু, জয়নাল, নজু মেম্বর, হাসাই, হাজী ফারুক, আশরাফসহ কয়েক জন খাদ মালিকের নাম জানালেন। এই মাটি দস্যুদের কেউ কেউ পাবনা শহরের সবচেয়ে প্রভাবশালী মহল¬ার ক্ষমতার বলয়ের বৃত্তে বসবাস করে। হেমায়েতপুর ইউনিয়নে শতশত বিঘা ফসলিজমির উপর সৃষ্টিকরা বড় খাদ গুলির দু-একটি থেকে প্রতিদিন অন্তত গড়ে ২শতাধিক ট্রাক মাটির বিপণন হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, ভেকুমেশিন দিয়ে মাটির গভীর থেকে বাল ুমাটি উত্তোলন করায় পার্শ্ববর্তী আবাদি জমি বিলীন হয়ে চরম ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে চাষি পরিবার গুলো। গভীরভাবে গর্তকরে মাটি উত্তোলন করায় পাশের জমি ধসে পরছে ফলে আমাদের জমিও খাদ হয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতর স্বীকার হয়ে নাম মাত্র মূল্যে আমরা আমাদের আবাদি জমি ভূমিদস্যুদের নিকট বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি; কিন্তু, মাটি খেকোরা প্রভাবশালী হওয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নাম মাত্র মূল্যে বিক্রিত জমির বা মাটির টাকা আমরা বুঝে পাচ্ছিনা। ‘অন্যদিকে,প্রতিদিন শতশত মাটি ভতির্ ট্রলি,ট্রাক্টর ও ড্রাম্পট্রাক আসা-যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
এ সকল বিষয়ে, সরেজমিনে গিয়ে ভুক্তভোগীদের বক্তব্য যাচাই করা যতটা সহজ; অভিযুক্তদের স্বীকারোক্তি মূলক বক্তব্য পাওয়া ততোটাই কঠিন। এ ব্যাপারে ফারুক মাটি-বালু উত্তোলনের কথা অস্বীকার কওে বলেন আমার কোন খাদ নাই। আমি এসবের সাথে জড়িত নই।
এ বিষয়ে খাদের মালিক জয়নায়, ইমন মিঠু এর সাথে মোবাইল ফোনে কয়েক যোগাযোগ করা হলে ফোন রিসিভ করেন নাই কেউই।
হেমায়েত পুলিশ ফাঁরির ভারপাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুস সালাম বলেন, মো. আব্দুস সালাম বলেন, এ এলাকায় লোকাল বালু ও মাটি কাটার বিষয় আমার জানা নাই। প্রতিদিন শতশতমাটি বা বালু ভর্তি ট্রাক যাতায়াত কওে সেটাও দেখেন না এই পুলিশ কর্মকর্তা। মাটি দস্যূদের সাথে যোগসাজসের বিষয়টি অস্বীকার করেন ক্যাম্প ইনচার্জ আব্দুস সালাম।
পাবনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিদা আকতার বলেন, বিষঠি আমার জানা নাই। এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে আইনী ব্যবস্থা নেব।
উল্লেখ্য, বালু-মাটি খেকোদের ভয়াল থাবায় বিপর্যস্ত জনপদের দুর্দশা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে মনে হয়েছে, জনাকয়েক ভুক্তভোগী ছাড়া যেনো কেউই ‘বালুমহাল ও মাটিব্যবস্থাপনা আইন-২০১০’ এবংপ্রস্তাবিত ‘বালুমহাল ও মাটিব্যবস্থাপনা (সংশোধন) আইন-২০২২’-এর খসড়া সম্পর্কে ওয়াকি বহাল নন। এমনকি, ২০১০ সালের চলমান আইনের শাস্তি নিয়েও ভীত কিংবা চিন্তিতনন। প্রস্তাবিত ‘বালুমহাল ও মাটিব্যবস্থাপনা (সংশোধন) আইন-২০২২’-এর খসড়ায় সংযুক্ত প্রধান প্রধান বিষয় গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ব্যক্তি মালিকানাধীন উবর ্রকৃষি জমি রক্ষা, কৃষি জমির উপরিভাগের উবর ্রমাটি সংরক্ষণের ব্যবস্থাসহ ভূগর্ভস্থ বালু বা মাটি উত্তোলনের ফলে ওই জমিসহ পার্শ্ববর্তী অন্য জমি বা প্রতিবেশের যাতে ক্ষতি সাধন না হয় তার ব্যবস্থা রাখা। এছাড়া, পরিবেশের ক্ষতি সাধিত হয় কিংবা পার্শ্ববর্তী ভূমির ক্ষতি, চ্যুতিবাধ সেরকারণ উদ্ভব হয় এমন কোন ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমি হতেও কোন ওবালু বা মাটি উত্তোলন না করার বিধান রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। উপরন্তু, বালু মহাল থেকে উত্তোলিত বালু পরিবহনের কারণে কোনও রাস্তা ক্ষতিগ্রস্তহলে তা বালু পরিবহনকারী কর্তৃক মেরামত কওে দেওয়া বা ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিধান ও উক্ত আইনে বিধান রাখা হয়েছে। গত ৩১ অক্টোবর ২০২২ তারিখে এই আইনের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
প্রসঙ্গত, জনস্বার্থে করা এক রিটের শুনানি শেষে গত ২৯ মার্চ ২০২৩ হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ থেকে পাবনার পাকশী চ্যানেল পর্যন্ত পদ্মা নদীর তলদেশ হতে হাজার হাজার বাল্কহেড বা ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে ওইসব এলাকার বালুমহালকে দেওয়া লিজ বাতিল করারও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এই রায়ের পর থকে পাবনার জেলায় পদ্মা নদীর তলদেশ হতে মোটা বালু উত্তোলন বন্ধ থাকলেও জেলাজুড়ে অবৈধভাবে চিকন বালু ও মাটি কাটার মহোৎসব চলছেই। হেমায়েতপুর ইউনিয়নেও মহোৎসব চলছে।