স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণে অভিযুক্ত নৈশপ্রহরীর হুমকিতে বাড়ি ছাড়া ধর্ষিতার পরিবার
নিজস্ব প্রতিনিধি : দরিদ্র দিনমজুর বাবার নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। বাধ্য হয়ে মাও কাজ করেন অন্যের বাড়িতে। বাড়িতে একা কিশোরী মেয়ে (১৪)। বাড়ির পাশে স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী সে। অভিযোগ, এই সুযোগে একই স্কুলের নৈশপ্রহরী নানা প্রলোভনে, পরিবারের সদস্যদের প্রাণনাশের হুমকিতে ওই স্কুলছাত্রীকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করে।
এক পর্যায়ে ঘটনা জানাজানি হলে আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন স্কুলছাত্রীর মা। আর এতেই ভুক্তভোগী পরিবারটির উপর নেমে আসে নানারকম হুমকি ও আপোষ মিমাংসার চাপ। তাদের হুমকিতে শেষ পর্যন্ত বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে ভিকটিম ছাত্রী ও তার পরিবার।
এমনই ঘটনা ঘটেছে পাবনার সুজানগর উপজেলার মানিকহাট ইউনিয়নের মানিকহাট গ্রামে। অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম ইউসুফ আলী খাঁ (৪৮)। তিনি একই গ্রামের মৃত জাবদার খাঁর ছেলে এবং মানিকহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী হিসেবে কর্মরত।
পাবনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে দায়েরকৃত মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, মানিকহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের নৈশ প্রহরী ইউসুফ আলী খাঁর বাড়ির পাশে ছোট্ট একটি ছাপড়া ঘরে বসবাস করেন দরিদ্র দিনমজুর। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষটির সংসার চালানোই দায়। ফলে বাধ্য হয়ে তার স্ত্রীও অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। তাদের এক মেয়ে ও দুই ছেলে। মেয়েটি (১৪) সবার বড়। মানিকহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। সকালে বাবা-মা দু’জন কাজে বেরিয়ে যান।
বাড়িতে একা থাকার সুযোগে স্কুলছাত্রীর নজর পড়ে নৈশপ্রহরী ইউসুফ খাঁর। তিনি নানা বাহানায় ওই বাড়িতে যাতায়াত করেন এবং নানারকম প্রলোভনে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ পরিবারের। সেইসাথে বিভিন্ন সময়ে স্কুলের কাগজপত্র নিয়ে আসার কথা বলে স্কুল খোলার আগেই ওই স্কুলছাত্রীকে ডেকে নিয়ে সেখানেও ধর্ষণ করে। এছাড়া মোবাইল ফোনে ধর্ষণের আপত্তিকর ছবি তুলে সেই ভিডিও ছড়িয়ে দেবার কথা বলে দিনের পর দিন স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করে বলে দাবি ভুক্তভোগী পরিবারের।
এরই এক পর্যায়ে গত ৩ সেপ্টেম্বর সকাল আটটার দিকে স্কুলে নৈশ প্রহরীর শয়ন কক্ষে ইউসুফ খাঁ একইভাবে ওই স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টাকালে তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন এসে তাকে উদ্ধার করে। ওই সময় অভিযুক্ত ইউসুফ খাঁ এ ঘটনায় মামলা মোকদ্দমা করলে ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেবার হুমকি দেয়। পরে এ ঘটনায় ভিকটিম স্কুলছাত্রীর মা বাদি হয়ে পাবনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে গত ৪ সেপ্টেম্বর একটি মামলা করেন। সেইসাথে স্কুল কর্তৃপক্ষ, শিক্ষা অফিসার সহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযুক্ত ইউসুফ খাঁর বিচার চেয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তিনি।
বুধবার (১২ অক্টোবর) দুপুরে ভুক্তভোগীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় ঘর তালাবদ্ধ, বাড়িতে কেউ নেই। প্রতিবেশিরা জানান, ইউসুফ খাঁ কর্তৃক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের কথা তারাও লোকমুখে শুনেছেন। ইউসুফ খাঁর পরিবারের লোকজন ঘটনা ধামাচাপা দিতে ওই পরিবারটিকে দেড় লাখ টাকা দিয়ে আপোষের চেষ্টা করছে বলেও জানান তারা।
মানিকহাট বাজারের ব্যবসায়ী আহসানুল মালিক ও আক্কাস আলী বলেন, ইউসুফ খাঁ ইতিপূর্বেও এমন একটি নারী কেলেংকারীর ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। তার চরিত্র সুবিধার নয়। স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা এখন সবার মুখে মুখে। যেদিনের ঘটনা সেদিন তারা বাজারে উপস্থিত ছিলেন। তার শাস্তি হওয়া দরকার।
পরিবারটির খোঁজ নিয়ে একই উপজেলার ক্ষেতুপাড়া ইউনিয়নের একটি গ্রামে গিয়ে তাদের দেখা পাওয়া যায়। স্কুলছাত্রীর মা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আমার ছোট্ট মিয়েডার জীবন নষ্ট করে দিছে ইউসুফ খাঁ। তাকে আমারে বাড়িতে আসতে নিষেধ করছিলাম। আমরা গরীব মানুষ, কোথায় যাবো? কোর্টে মামলা করার পর থেনে সে আমাগারে নানারকম হুমকি ধামকী দিচ্ছে। মামলা তুলে নেয়ার জন্যি চাপ দিচ্ছে। তাদের ভয়ে আজ ৬ দিন হলো বাড়ি থেনে পলায়া এক আত্মীয়ের বাড়িতে আইসে উঠছি। আমার মেয়ের যে সর্বোনাশ করিছে তার বিচার চাই।
স্কুলছাত্রীর বাবা বলেন, আমার শরীর ভাল না। কাজকাম ঠিকমতো করবের পারিনে। আমি ও আমার বউ সকালে দুইজনই কামে বারায়া যাই। ইউসুফ আমার বাড়িত যাওয়া আসা করতো, মুরুব্বী মানুষ। তাকে নিষেধ করতাম। সকাল নয়টায় কিলাশ শুরু হলি সে সকাল আটটায় নানারহম উছিলায় আমার মিয়েডাক ডাইকে নিয়ে যাইতো। পরে জানতে পারি সে আমার মিয়ের সর্বোনাশ করিছে। এহন যেরহম হুমকি ধামকি দিচ্ছে, বাড়িতে থাকপের পারতিছি না। টেকা দিয়ে আপোষ করার জন্যিও চাপ দিচ্ছে।
ভুক্তভোগী স্কুলছাত্রী জানায়, ইউসুফ খাঁ তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেছে। পরিবারের বাবা, মা, ভাইদের ক্ষতি করার ভয় দেখাতেন তিনি। বিভিন্ন প্রলোভন দিতেন। স্কুলের বিভিন্ন কাগজপত্র আনার কথা বলে তাদের বাড়িতে যেতেন, কখনও স্কুলে ডেকে নিয়ে যেতেন। ধর্ষণের পর তাকে জোর করে কি যেন ওষুধ খাওয়াতেন। ঘটনা জানাজানি হলে প্রাণে মারারও ভয় দেখিয়েছেন। এজন্য পালিয়ে অন্য এলাকায় চলে গেছেন তারা। এ ঘটনার বিচার চান স্কুলছাত্রী।
মানিকহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রমজান আলী বলেন, ভুক্তভোগী ওই স্কুলছাত্রীর মা একটি লিখিত অভিযোগ ১১ অক্টোবর আমাদের স্কুলে দিয়েছেন। আমরা স্কুল পরিচালনা কমিটির সাথে কথা বলে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করবো। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর ইউসুফ খাঁ দোষী সাব্যস্ত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
স্কুল পরিচালনা কমিটির আহবায়ক ও মানিকহাট ইউপি চেয়ারম্যান শফিউল ইসলাম শফি বলেন, আমরা লোকমুখে শুনেছি ঘটনাটি। স্কুলছাত্রীর মা লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। তদন্ত করে আইনগত দিক খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে, ইউসুফ খাঁ লোকটির বিরুদ্ধে এর আগেও এমন একটি অভিযোগ উঠেছিল বলে জানান তিনি।
সুজানগর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ভিকটিমের মা আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। পরে শুনলাম তিনি কোর্টে মামলা করেছেন। কোর্টে মামলা করলে তো আমাদের কিছু করার থাকে না।
তিনি বলেন, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি ই এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন। তারা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শোকজ করবেন, সন্তোষজনক জবাব না পেলে তাকে চাকুরিচ্যুত করার বিষয়টি রেজুলেশন করে ডিজি অফিসে পাঠাবেন। এখানে শিক্ষা অফিসের কিছু করণীয় নেই বলে জানান এই কর্মকর্তা।
সুজানগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল হান্নান বলেন, এমন কোনো অভিযোগ থানায় পাইনি। যদি আদালত থেকে কোনো নির্দেশনা আসে তার আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে বক্তব্য নেয়ার জন্য অভিযুক্ত ইউসুফ আলী খাঁর মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তার ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। বুধবার (১২ অক্টোবর) দুপুরে তার বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। পরিবারের লোকজন এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজী হননি।