“এ যেন মৃত্যুফাঁদ “পাবিপ্রবির নির্মাণাধীন ভবন
নুরমোহাম্মদ, পাবিপ্রবি প্রতিনিধি: পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পাবিপ্রবি) চলমান ৪৮০ কোটি ৬০ লক্ষ টাকার মেগা প্রকল্পের অধীনে নির্মাণাধীন ভবনগুলো যেন এক একটি মৃত্যুফাঁদ হয়ে উঠছে।
পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই ২০১৮ সাল থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পের কাজে এখন পর্যন্ত নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে মারা গেছেন দশজনের বেশী নির্মাণ শ্রমিক এবং গুরুতর আহত হয়েছেন প্রায় পঞ্চাশ জন । এর মধ্যে অল্প কিছু সংখ্যক ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের নাম ভিন্ন ভিন্ন সময় গণমাধ্যমে আসলেও বেশিরভাগই গোপন রেখেছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এমনটাই জানিয়েছে একাধিক নির্মাণ শ্রমিকর।
তাদের দাবি জাতীয় বিল্ডিং কোড (২০১৪) অনুযায়ী, নির্মাণ কাজের সময় শ্রমিকদের পোশাক থেকে শুরু করে সবই নিরাপত্তা বান্ধব হওয়ার কথা থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত মুনাফার আশায় এ খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করছে না। কনস্ট্রাকশন সাইটে সেফটি হেলমেট, কোমরে সেফটি বেল্ট, কংক্রিটের কাজে যুক্ত তাদের হাতের গ্লাভস ও চোখের জন্য ক্ষতিকর কাজে শ্রমিকদের চশমা, পায়ে বুটসহ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সামগ্রীর সংকট রয়েছে। এ ছাড়া যেসব সুরক্ষা সরঞ্জাম আছে সে গুলোও অনেক পুরনো ও জরাজীর্ণ। এ কারণে প্রায়ই ছোট-বড় দুর্ঘটনার শিকার হতে হয় শ্রমিকদের। এমনকি বাংলাদেশের শ্রম আইনে কর্মক্ষেত্রে কোনো শ্রমিক মারা গেলে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ এবং আহতরা স্থায়ীভাবে অক্ষম হয়ে গেলে আড়াই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের কথা উল্লেখ থাকলেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সেই অর্থ সঠিকভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেনা কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ও একাডেমি ভবনের পার্শ্ববর্তী চারতলা বিশিষ্ট ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন, বারো তলা বিশিষ্ট দুইটি একাডেমিক ভবনসহ অন্যান্য নির্মাণাধীন বহুতল ভবনে শ্রমিকরা রশি দিয়ে ঝুলিয়ে বাধা মাচাং এ কাজ করছে কেউবা ভবনের ছাদের রড ধরে কাজ করছে। তাদের শরীরে হেলমেট, সেফটি বেল্ট, বুট বা গ্লাভসের মতো কোনো সুরক্ষা সরঞ্জাম নেই এমনকি বহুতল ভবন নির্মাণের সময় শ্রমিক ও শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার জন্য ভবনের চারপাশে যে শক্ত জাল বা টিন দিয়ে রাখার কথা সেটাও উপেক্ষিত। বহুতল ভবনের বেশিরভাগ শ্রমিককে লুঙ্গি পরে কাজ করতে দেখা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের এক শ্রমিক বিডি২৪ ভিউজকে বলেন , এখন বৃষ্টির সময় মাচাং এর রশি গুলো বৃষ্টির পানিতে ভিজে পচে যাচ্ছে । আমরা যখন কাজ করতে উঠি তখন ভার পেয়ে রশি ছিড়ে যায় আর দুর্ঘটনার ঘটে। কিছুদিন আগে ছাত্রাবাসে কাজ করার সময়ে দড়ি ছিঁড়ে দুই জন মারা গেছে । কাজের সাইড থেকে তো আমাদের কোন নিরাপত্তা সামগ্রী দেওয়া হয়না আবার কেউ দুর্ঘটনার শিকার হলে আমাদেরকে এটা বাহিরে না বলার জন্য চাপ দেওয়া হয়। আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবাররা তো তাদের সঠিক ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না ।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণের অর্থ সঠিকভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে না এমন অভিযোগ অস্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল (অব.) আজিজুর রহমান বলেন, কিছুদিন আগে যে দুইজন শ্রমিক মারা গেছে প্রাথমিক ভাবে আমি তাদের প্রত্যেকটা পরিবারকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিশ্চিত করেছি এবং তাদের জানাজা ও দাফনের ব্যবস্থা করেছি । এছাড়া যেসব শ্রমিকরা মারা গেছেন সরকারিভাবে তাদের ক্ষতি পূরণ প্রদান করা হবে।
শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি আরও বলেন, শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনা খুবই দুঃখজনক। যেকোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছ থেকে কাজ নেওয়ার সময় শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওয়াদা দিয়েই কাজ নেন। প্রকল্পের কাজ যখন শুরু হয় তখন থেকে একাধিকবার আমরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দপ্তর থেকে চিঠি দিয়ে নিরাপত্তাবিধি গুলো মেনে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছি এবং তাদেরকে সতর্কও করেছি। কিন্তু এরপরও তারা সঠিকভাবে নিরাপত্তাবিধিগুলো মেনে চলেননি। এখন আমরা তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে ইতোমধ্যে জরিমানা করা হয়েছে। আর সামনে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সরকারি বিধি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
হোসাইন কনস্ট্রাকশনের ম্যানেজার মফিজুল ইসলাম বিডি২৪ ভিউজকে বলেন, আমাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে হেলমেট এবং নিরাপত্তা সামগ্রী আছে। শ্রমিকদের সেগুলো ব্যবহারে উৎসাহিত করলেও তারা নিজেরাই এগুলো ব্যবহার করে না। আমরা মাঝেমধ্যে কাজ বন্ধ করে দিয়েও মাইকিং করে তাদেরকে সতর্ক করি। তারপরেও তারা নিরাপত্তার বিষয়ে উদাসীন।
উল্লেখ্য, বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. কামাল হোসেন বলেন, এ বিষয়গুলো আমরা প্রকল্প পরিচালক এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে কয়েকবার মিটিং করেছি। আমরা উনাদেরকে নিরাপত্তাবিধিগুলো মেনে কাজ করার জন্য অনুরোধ করেছি। উনারা কিছুদিন নিরাপত্তা বিধিগুলো মানেন এরপর আগের অবস্থায় ফিরে আসে।