কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হচ্ছে
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নানা টানাপোড়েন সত্ত্বেও নতুন সরকার গঠনের পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও সরকারকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) পশ্চিমা দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। বাংলাদেশের সঙ্গে চলমান সম্পর্ক শুধু অব্যাহত রাখাই নয়, তা আরও জোরদারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে তারা। ফলে নির্বাচনের আগে অর্থনৈতিক অবরোধসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হলেও এরই মধ্যে সে ধরনের শঙ্কা অনেকটাই কেটে গেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্ব সম্প্রদায় জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের দূরদর্শী পরিকল্পনাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। নির্বাচনের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরিতে এ বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। তবে আপাত স্বাভাবিক এই পরিস্থিতি টেকসই করতে সরকারকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সৃজনশীল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচন ঘিরে গত বছরের মধ্যভাগ থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলো সরকারকে চাপে রেখেছিল। অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণ নির্বাচনের তাগিদ অব্যাহত রেখেছিল শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্র তো র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। এমনকি দেশটির নতুন শ্রমনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে উদ্বেগের মধ্যে রেখেছিল। তবে ভারত, রাশিয়া ও চীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এদেশের জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে বলে সরকারের পক্ষে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করে; যদিও বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি দল গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়নি। নির্বাচনের পরদিন ভারত, চীন, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানালেও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলো পৃথক বিবৃতিতে বলেছিল, সবশেষ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মানদণ্ড মেনে অনুষ্ঠিত হয়নি। নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ না করায় হতাশা প্রকাশ করে তারা। তবে নির্বাচনের ১০ দিনের মধ্যেই গত ১৫ জানুয়ারি ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা এবং ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ও ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে পৃথক সাক্ষাতের পরই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। একে একে নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ প্রতিনিধি আব্দুল্লায়ে সেখ, ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মারি মাসদুপুয়ে, জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত আলেকজান্দ্রা বার্গ ভন লিন্ডে ও বিমসটেক মহাসচিব ইন্দ্রমনি পাণ্ডেসহ প্রভাবশালী বন্ধুদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মিশনপ্রধানরা সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন এবং অভিনন্দন জানান। একই সঙ্গে তারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও নিবিড় করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবীর মনে করেন, রাজনৈতিক জগৎকে যতটা সরলীকরণ করে দেখা যায়, কূটনৈতিক জগৎ ততটাই জটিল। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ও এদেশের জনগণের সঙ্গে সব দেশই সম্পর্ক অব্যাহত ও জোরদার করতে চাইবে—এটি স্বাভাবিক। নির্বাচনের আগে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে তারা বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কিছু দেশ অবস্থান ব্যক্ত করেছে বলে তারা এদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে বিষয়টি এমন নয়। নির্বাচনের পরও তারা তাদের অবস্থান ব্যক্ত করতে থাকবে। আর নির্বাচনের পর শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানানো কূটনৈতিক শিষ্টাচারেরও অংশ।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বন্ধু দেশগুলো বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব চাইবে, গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু থাকুক। কারণ এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা না থাকলে দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতার জায়গা সংকীর্ণ হতে থাকে। এতে অর্থনৈতিক দুর্নীতি, অনিয়ম, বৈষম্যসহ নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয়, যার সমাধানও কঠিন হয়ে পড়ে। আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকলে যে কোনো বিষয়ে সংসদে আলোচনা হয়, সরকারের জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতাও বাড়ে।’
এবারের নির্বাচন সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করেছে মন্তব্য করে সাবেক অভিজ্ঞ এই কূটনীতিক বলেন, ‘এই নির্বাচনে বড় একটি রাজনৈতিক দল অংশ না নেওয়ায় সবাই অংশগ্রহণ করতে পারেনি। বিভিন্ন দেশ নির্বাচনের পর সরকারকে অভিনন্দন জানালেও এই নির্বাচনে মতভেদ ও সংকট অতিক্রম করতে পারেনি। ফলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।’
অভ্যন্তরীণ সংকট কূটনৈতিক সম্পর্কে যেন নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে সে ব্যাপারে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকা পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনীতিতে একটি সংকটাপন্ন অবস্থা বিরাজ করছে। নির্বাচনের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি আপাতত স্বস্তির জায়গা তৈরি হয়েছে। এটি টেকসই করতে সরকারকে আরও সৃজনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। কর্মসংস্থানের সংকট সমাধানে নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে। সাময়িক স্বস্তি যেন দীর্ঘমেয়াদে বিষয়গুলোকে আড়াল না করে, সে বিষয়ে সরকারকে দৃষ্টি রাখতে হবে।’
নির্বাচনের পর কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক গতিতে চলার নেপথ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী পরিকল্পনা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকেই আমরা বন্ধুরাষ্ট্র ও উন্নয়ন সহযোগীদের জানিয়েছি, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমরা তাদের হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করি না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার অঙ্গীকার অনুসারে ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সহযোগিতা করেছে। নির্বাচনের আগে ও পরে সরকার এমন একটা অবস্থানে পৌঁছুতে পেরেছে, অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে সরকার সদিচ্ছার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল। এরপর যখন বিএনপি নির্বাচনে আসেনি, তখন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্রদের অতীতের মতো বসিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়নি। এর ফলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা জোরালো হওয়ার পাশাপাশি স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা গেছে।’
তিনি বলেন, ‘অতীতে বিএনপি সমর্থন করেছেন এমন ভোটাররাও এবারের নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। ভালো একটি নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে ইসি ও সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কিছু নেই। এ বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক মহল গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। তাই নির্বাচনের পর বিভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্র ও উন্নয়ন সহযোগীদের সরকারপ্রধানসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে বাংলাদেশের নতুন সরকারকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়েছে এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অব্যাহত রাখার পাশাপাশি আরও জোরদারে আগ্রহ দেখিয়েছে।’
বিশ্ব সম্প্রদায় জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী পরিকল্পনাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় উল্লেখ করে শাহরিয়ার বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে গত দেড় দশকে বাংলাদেশের আঞ্চলিক অবস্থান ও উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান। বিশেষ করে তৃতীয় দেশকে ব্যবহার করে ধর্মীয় মূল্যবোধ উসকে দেওয়ার মাধ্যমে মৌলবাদ, উগ্রবাদ ও অস্থিরতা তৈরির অপচেষ্টা রুখে দেওয়ার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সরকারের জিরো টলারেন্স নীতিকে চ্যালেঞ্জ করলে কারও জন্য মঙ্গলজনক হবে না এটি বিশ্বের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নের পর বিশ্বব্যাংক ও বন্ধুদেশগুলো ভিশন ২০৪১ নিয়েও আশাবাদী। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে বৈশ্বিক সম্পর্ক সামনের দিনে আরও জোরদার হবে বলে আশা করছি।’