বঙ্গবন্ধু যোগাযোগ অবকাঠামো পুনঃস্থাপন ও উন্নয়ন শুরু করেন
হীরেন পণ্ডিত : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর ক্ষতিগ্রস্ত সকল সড়ক ও সেতু মেরামত করে যোগাযোগ অবকাঠামো পুনঃস্থাপন করেন। তিনি ১৯৭৪ সালের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত সকল সেতু পুন:নির্মাণ করে চলাচলের উপযোগী করেন, পাশাপাশি তিনি ৪৯০ কি.মি. নতুন সড়ক নির্মাণ করেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় জাতির পিতা সড়ক পরিবহন খাতকে অগ্রাধিকার প্রদান করে আধুনিক সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কার্যক্রম শুরু করেন। সরকার জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ এবং প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নিরাপদ সড়ক নেটওয়ার্ক উন্নয়নের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন ও সময় সাশ্রয়ী যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন সম্প্রসারণের নিমিত্তে কাজ করে যাচ্ছে। নিজস্ব অর্থায়নে করা স্বপ্নের বহুমুখী পদ্মা সেতুসহ সারা দেশে বিস্তৃত যোগাযোগ ব্যবস্থা জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়নের পাশাপাশি নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা জোরদার করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে বর্তমান সরকার। আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর এবং টেকসই ও নিরাপদ মহাসড়ক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করাই সরকারের লক্ষ্য। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে স্বয়ংক্রিয় মোটরযান ফিটনেস সেন্টার চালু করা হয়েছে। ই-ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রবর্তনের মাধ্যমে বিআরটিএ’র প্রায় সকল সেবা ডিজিটালাইজড করা হয়েছে, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে ৬ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বাংলাদেশ রোড সেইফটি প্রজেক্ট’ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
চালকের অদক্ষতা ও বেপরোয়া যানবাহন চালানোর পাশাপাশি ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, সড়ক ও সেতুর নাজুক অবস্থাও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বহুলাংশে দায়ী। গণপরিবহনে বাড়তি যাত্রী সামাল দিতে গতিসীমার বাইরে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে বেশি ট্রিপ দেয়ার অশুভ প্রতিযোগিতা আর বাড়তি মুনাফার লোভে পরিবহন সংস্থাগুলো চালকদের অনেক বেশি সময় কাজ করতে বাধ্য করে। ফলে চালকের ওপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ পড়ে, তাকে বেসামাল হয়ে গাড়ি চালাতে হয়; যা প্রকারান্তরে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যানবাহনে রঙ লাগিয়ে যেনতেন মেরামত করে রাস্তায় চলাচল করে বিভিন্ন উৎসব-পার্বণের সময়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী দূর-দূরান্তে গমনাগমন করে। সড়ক-মহাসড়কে চলে বাস-ট্রাকের চালকের অমনোযোগী লড়াই। অতি আনন্দে গাড়ি চালানোর সময় তারা ব্যবহার করেন সেলফোন, যা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত। পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী বহন, অদক্ষ চালক ও হেলপার দ্বারা যানবাহন চালানো, বিরামহীন যানবাহন চালানো, মহাসড়কে অটোরিকশা, নসিমন-করিমন ও মোটরসাইকেলের অবাধ চলাচল এবং ব্যস্ত সড়কে ওভারটেকিং, ওভারলোডিং সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। প্রধানমন্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেগুলো ছিল চালক ও সহকারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, দূরপাল্লার বাসযাত্রায় বিকল্প চালক রাখা ও ৫ ঘণ্টা পরপর চালক পরিবর্তন করা, চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা বাধ্যতামূলক করা, চালকদের জন্য মহাসড়কে বিশ্রামাগার নির্মাণ এবং সিগন্যাল মেনে যানবাহন চালানোর ওপর কড়াকড়ি আরোপ।
উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা অর্থনৈতিক অগ্রগতির একটি নির্দেশকও বটে। বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে, আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাগুলোর দৃষ্টিতে সম্ভাবনাময় অর্থনীতির দেশ। সরকারের লক্ষ্য ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়ার। উন্নয়নশীল বা মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে শামিল হওয়া বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে অনেক কাজ চলছে। বাংলাদেশে মোটরসাইকেল বিক্রি সম্প্রীতি বহুগুণ বেড়েছে। আঞ্চলিক সড়কে মোটরসাইকেল চালানোর নিয়ম মানছেন না চালকরা; চালক ও আরোহীরা হেলমেট ঠিকমতো পরেন না; এক মোটরসাইকেলে দু’জনের বেশি না ওঠার নিয়ম মানা হয় না; জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অনিবন্ধিত মোটরসাইকেল অহরহ চলাচল করে; অনেকের আবার মোটরসাইকেল চালানোর প্রশিক্ষণ নেই।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি; চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্টকরণ; বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি; পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ এবং এগুলোর জন্য আলাদা সার্ভিস রোড তৈরি; পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ; গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ; রেল ও নৌপথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়কপথের ওপর চাপ কমানো; টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
যে কোনো দুর্ঘটনা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সড়কে যেভাবে মানুষের প্রাণহানি ঘটছে, তা যেভাবেই হোক কমাতে হবে। নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। দক্ষ চালক তৈরির জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক চালক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া সড়কে মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন চলাচল বন্ধে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যু ও ইনজুরির অন্যতম প্রধান কারণ। সব বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর অষ্টম প্রধান কারণ হলো সড়ক দুর্ঘটনা। ৫-২৯ বছর এবং আরো কম বয়সি শিশুদের জন্য এটি মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছে। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয় যে, বিশ্বব্যাপী শতকরা ৯০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে, যার সংখ্যা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় তিন গুণ বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের চিত্র অনেকটা একই রকম।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, ২০১৬-১৭ সালে পরিচালিত একটি জরিপে, অর্থনৈতিক ক্ষতি, চিকিৎসা ব্যয়, জীবনযাত্রার ব্যয়, যানবাহন ও প্রশাসনিক ক্ষতি এবং অন্যান্য হিসাব থেকে দেখানো হয়েছিলো কর্মজীবী ব্যক্তি যিনি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন তার সব মিলিয়ে একটি মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৫ মিলিয়ন টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। তবে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার জনপ্রতি পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতি হয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য সড়ক দুর্ঘটনা একটি উদ্বেগজনক বিষয়। দুর্ঘটনা মানবিক ও অর্থনৈতিক উভয় অবস্থাকে প্রভাবিত করে। হিউম্যান ক্যাপিটাল পদ্ধতিতে একটি খরচ অনুমান মডেল করা হয়েছে। গড় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ (টাকায়) মোট ক্ষতির পরিমাণ ৪৯ লাখ ৬৯ হাজার।
একজন কর্মজীবী ব্যক্তির অর্থনৈতিক ক্ষতি, সরকারি সমীক্ষা দেখায় যে সড়ক দুর্ঘটনায় একজন কর্মজীবী ব্যক্তির মৃত্যুর ফলে গড় অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় ২৪ লাখ ৭২ হাজার ১০৮ টাকা। গুরুতর আঘাতের ক্ষেত্রে, গড় আর্থিক ক্ষতি হয় ২১ হাজার ৯৮ টাকা। ৩৮ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে অসাবধানে গাড়ি চালানোর কারণে বেশির ভাগ চালক ট্রাফিক নিয়মের প্রতি তাদের অবাধ্য মনোভাবের পাশাপাশি সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত বা উপযুক্ত বিশ্রামও পান না।
সড়ক-দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ বা যুবক এবং নানাবিধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও এর ক্ষয়-ক্ষতির ব্যাপকতা বহুমাত্রিক যা প্রতিটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। বিআইডিএস এর গবেষণায় দেখা যায়, সড়ক-দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতিবছর জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। সড়ক-দুর্ঘটনাকে সহনীয় মাত্রায় রাখতে তথা সড়ক-দুর্ঘটনাজনিত মানুষের মৃত্যু, পঙ্গুত্ব ও অসুস্থতা এবং সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি লাঘবের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ তার সদস্যভুক্ত প্রায় প্রতিটি দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে সাথে নিয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা শতকরা ৫০ ভাগ কমানোর জন্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ও কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করা এবং “গ্লোবাল প্ল্যান ফর সেকেন্ড ডিকেড অফ অ্যাকশন ফর রোড সেইফটি ২০২১-২০৩০” নিশ্চিত করতে কার্যকর কর্মপন্থা নির্ধারণ করে সেগুলো বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা ইত্যাদি। আশার কথা হলো এই যে, সড়ক-দুর্ঘটনা কমানোর উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাপী গৃহীত এসকল পদক্ষেপ সমূহের সাথে বাংলাদেশও একাত্মতা প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি সেগুলোর বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ কর্মপন্থা নির্ধারণ পূর্বক প্রয়োজনীয় কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর আলোকে সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২ হালনাগাদ করণের মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা জোরদারের প্রচেষ্টা গ্রহণ সরকারের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এবং অন্যতম প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এসডিজিগুলোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ “সড়ক পরিবহন বিধিমালা- ২০২২” এ বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বিধান সংযুক্তিপূর্বক গেজেট প্রকাশ করেছে। এ সকল বিধিমালার কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের সড়ক নিরাপত্তাকে জোরদার করে তোলাই উক্ত বিধিসমূহ সংযোজনের প্রধান উদ্দেশ্য। তাই এ ধরনের কার্যকর ও সময়োপযোগী সড়ক পরিবহন বিধিমালা জারির জন্য বাংলাদেশ সরকার নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার।
সড়ক দুর্ঘটনার একাধিক কারণ রয়েছে যার মধ্যে অন্যতম প্রধান করণ হলো অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো। দেশে নিয়মিত ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। অনিয়ন্ত্রিত গতি দুর্ঘটনার ঝুঁকির পাশাপাশি আঘাতের তীব্রতা এবং দুর্ঘটনার ফলে মৃত্যুর সম্ভাবনাকে সরাসরি প্রভাবিত করে। বিশ্বের ৮০ টির বেশি বড় শহরে পরিচালিত সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে জাতিসংঘ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, শহর এলাকায় সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারলে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এছাড়াও শহর এলাকায় যানবাহনের এরূপ নিম্নমাত্রার গতিসীমা যানযট ও বায়ুদূষণ কমানোর ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখে বলে গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে।
যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত গতি ছাড়াও নেশাগস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকির পাশাপাশি আঘাতের তীব্রতা এবং দুর্ঘটনার ফলে মৃত্যুর সম্ভাবনাকে সরাসরি প্রভাবিত করে। গবেষণায় এটা প্রমাণিত যে, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো নিষেধ- এই বিধানটি শতভাগ প্রয়োগ করা সম্ভব হলে দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা শতকরা ২০ ভাগ হ্রাস করা সম্ভব। (সূত্র: গ্লোবাল রোড সেইফটি পার্টনারশীপ)।
পাশাপাশি, দুই এবং তিন চাকার মোটরযান ব্যবহার মাথায় আঘাত জনিত মৃত্যু ও ট্রমার অন্যতম প্রধান কারণ। দ্রুততম সময়ের মধ্যে গন্তব্যস্থলে পৌঁছার জন্য বহু মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহার করছেন। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে এর ব্যবহার অত্যধিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্ষেত্রে গতির পাশাপাশি হেলমেট পরিধানের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হেলমেট পরিধান না করা সরাসরি দুর্ঘটনার কারণ না হলেও দুর্ঘনায় আহত ব্যক্তির আঘাতের মাত্রা হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণায় এটাও দেখে গেছে যে নিরাপদ হেলমেট যথাযথা নিয়মে ব্যবহারে দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঝুঁকি শতকরা ৪০ ভাগ এবং মাথার আঘাতের ঝুঁকি শতকরা ৭০ ভাগ হ্রাস করে। (সূত্র: গ্লোবাল রোড সেইফটি পার্টনারশীপ)।
একইভাবে সিটবেল্ট ব্যবহার সরাসরি দুর্ঘটনার কারণ না হলেও দুর্ঘনায় আহত ও নিহতের হার হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, সিটবেল্ট পরা চালক এবং সামনের আসনে যাত্রীর মধ্যে মৃত্যুর ঝুঁকি শতকরা ৪৫-৫০ ভাগ এবং পিছনের আসনের যাত্রীদের মধ্যে মৃত্যু এবং ও আঘাতের ঝুঁকি শতকরা ২৫ ভাগ হ্রাস করে। এছাড়াও গ্লোবাল রোড সেইফটি পার্টনারশীপ এর তথ্য মতে, শিশুদের জন্য নিরাপদ বা সুরক্ষিত আসনের ব্যবহার সড়ক দুর্ঘটনায় ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে শতকরা ৭০ ভাগ এবং বড় শিশুদের ক্ষেত্রে শতকরা ৫৪-৮০ ভাগ মারাত্মক আঘাত পাওয়া এবং মৃত্যু হ্রাসে অত্যন্ত কার্যকর।
যানবাহনের গতিসীমা বিষয়ে উক্ত বিধিমালার সপ্তম অধ্যায়ে সুনির্দিষ্ট বিধান সন্নিবেশিত হয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মোটরযানের গতিসীমা নির্ধারণ, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক নির্দেশনা বা গাইডলাইন জারি করা সংক্রান্ত বিধানটি। এর ফলে ভবিষ্যতে সড়ক ও মোটরযানের প্রকারভেদের ভিত্তিতে যথাযথ গতিসীমা নির্ধারণ করা ও এর যথাযথ বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত হলো। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অচিরেই এই গাইডলাইনে উল্লেখিত বিধিগুলো কার্যকর বাস্তবায়নের নিমিত্তে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
এই বিধিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন সড়কে নিরাপত্তা বিষয়টিকে আরো জোরদার করবে এবং সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করার মাধ্যমে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথকে আরো সহজতর করবে। সরকার বিধিমালায় যেসকল পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছে যেমন- সড়ক ও মোটরযানের প্রকারভেদের ভিত্তিতে গতিসীমা নির্ধারণ, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা, হেলমেটের গুণগত মান নির্ধারণ, এর যথাযথ ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা, সীটবেল্টে যথাযথ ব্যবহার, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সুরক্ষিত শিশু আসন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে যত দ্রæত সম্ভব সেগুলো নিশ্চিত করণ ও বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিবেন।
এসডিজির অভীষ্ট ৩:৬-এ বিশ্বব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের সংখ্যা ২০২০ সালের মধ্যে অর্ধেকে কমিয়ে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। এসডিজির অভীষ্ট ১১:২-এ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত যানবাহন সম্প্রসারণ করে সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও সুলভ পরিবহন ব্যবস্থায় সবার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। ২০৩০ সালের লক্ষ্য অর্জনে এখন সবাইকে কাজ করতে হবে।
সড়ককে নিরাপদ করতে ডিভাইডার স্থাপন, বাঁক সরলীকরণ, সড়ক ৪ লেনে উন্নীতকরণ, মহাসড়কে চালকদের জন্য বিশ্রামাগার নির্মাণ ও গতি নিয়ন্ত্রক বসানোসহ নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা আনয়ন, দক্ষ চালক তৈরি এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে টাস্কফোর্স গঠন করে এর ভিত্তিতেই কাজ চলছে। সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ তথা সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সরকারের পাশাপাশি পরিবহন মালিক, শ্রমিক, যাত্রী, পথচারী ও সংশ্লিষ্ট সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে একযোগে কাজ করতে হবে।
সড়ক নিরাপত্তা বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সেফ সিস্টেমস এপ্রোাচ যেমন নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ মোটরযান, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী, নিরাপদ গতিসীমা ও দুর্ঘটনা পরবর্তী ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির সমন্বয়ে একটি পৃথক সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করার বিষয়ে সরকারের যে উদ্যোগ রয়েছে সেগুলো আমাদের সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে জোরদার করবে এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ও বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এক গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী ভূমিকা পালন করবে। এতে একদিকে যেমন সড়কে মৃত্যু কমবে একইসাথে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতি (জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ) কমানোর পথ সুগম হবে। যার মাধ্যমে এসডিজির ধারা ৩.৬ এবং ১১.২ অর্জনের পথে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক