জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পয়েট অব পলিটিক্স
হীরেন পণ্ডিত : বঙ্গবন্ধুর জন্ম গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুনের চার কন্যা এবং দুই পুত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বাবা-মায়ের দেয়া আদুরে নাম খোকা। কিশোর বয়সেই তাঁর প্রতিবাদী চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রামের স্কুলে লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। তারপর গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানসিকতা, গরিব-দুঃখী মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও তাদের দুঃখ দূর করার প্রতিজ্ঞা তাঁকে রাজনীতিতে নিয়ে আসে। স্কুল থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
বঙ্গবন্ধু পড়াশোনার চেয়ে রাজনীতিই বেশি করেছেন। রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর পিতা তাঁকে বাধা দেননি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, তাঁর বাবা তাঁকে বলেছিলেন, “বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছো এতো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না”। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখানে
মুসলিম লীগের একজন কর্মী হিসেবে তিনি তার অগ্রজদের নজর কাড়েন।
প্রত্যেক দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন নেতা থাকেন যেমন রাশিয়ার (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) লেনিন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, চীনের মাওসেতুং, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, ভিয়েতনামের হো-চি মিন, কিউবার ফিদেল কাস্ট্রো, ঘানার পেট্রিস লুমাম্বা ও কওমী নক্রুমা, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, যুগোশ্লাভিয়ার মার্শাল টিটোর মতো বঙ্গবন্ধুও তাঁর অসামান্য দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের চিরঞ্জীব উদাহরণের জন্য বিশ্ব-ইতিহাসের অনিবার্য ও অবিচ্ছেদ্য অধ্যায় হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি শুধু বাঙালির বঙ্গবন্ধু নয়, বিশ্ববরেণ্য ও বিশ্বনন্দিত এক রাজনীতিবিদ।
বঙ্গবন্ধু সাহসী এক মহান সংগ্রামী বীর। শত্রুর মুখোমুখি হতে কখনো পিছপা হননি। রাজনৈতিক জীবনে বহুবার গ্রেফতার হয়েছেন, কিন্তু কখনো আত্মগোপন করেননি। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ২৫ মার্চের সেই ভয়াবহ রাতে বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাননি। দেশ ও মানুষের প্রতি অসীম ভালোবাসা, মানবিকতা ও অসীম সাহসিকতার অসামান্য ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জয় করেছিলেন বাংলার ধনী-গরিব, কবি-
সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের হৃদয়। তাই বঙ্গবন্ধু আমাদের মহান নেতা। তাঁরই নেতৃত্বে স্বাধিকারের জন্য দীর্ঘ
২৩ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি আমরা। তারই আহ্বানে ১৯৭১ সালে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ এদেশের অস্ত্রহাতে মুক্তিযুদ্ধ করেছে।
শত্রুর কাছে থেকে ছিনিয়ে এনেছে বিজয়। এনেছে লাল-সবুজের পতাকার স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ তাই এক ও
অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব তিনি শুধু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের একজন স্বপ্নদ্রষ্টাই ছিলেন না, অনন্য সাধারণ এক ঐক্যের বন্ধনে বাঙালি জাতিকে একতাবদ্ধ করে হাজার বছরের বাঙালি জাতির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আগে ও পরে বহু খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ এই বাংলাতে জন্মগ্রহণ করেছেন কিন্তু দুর্বার এক উন্মাদনায় কেউ বাঙালিকে জাগাতে পারেননি। তাই বঙ্গবন্ধুকে সবাই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি উপাধি দয়েছে, তেমনি তাঁকে ইতিহাস থেকে নির্বাসিত করা কোনদিন সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্বের এক
সম্মোহনী শক্তি ও যাদুস্পর্শে বাঙালিদের জাগিয়ে তুলে উদ্দীপ্ত ও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন স্বাধীনতার মন্ত্রে। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউজউইক ম্যাগাজিন তাদের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে।
এই প্রতিবেদনে তাকে অভিহিত করা হয় রাজনীতির কবি হিসেবে। তবে সেদিন যারা রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলেন তাদের মতে, সেই জ্বালাময়ী ভাষণ কোনো ভাষণ নয়, বরং একজন দক্ষ, সুনিপুণ কবির ছন্দময় কবিতা। সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। এই ভাষণের একটি লিখিত ভাষ্য বিতরণ করা হয়েছিল।
তবে সেদিন বাংলায় কবির মতো বক্তব্য রাখলেও বঙ্গবন্ধুকে প্রথম ‘রাজনীতির কবি’ এর মতো একটি সুন্দর উপাধিতে ভূষিত করে নিউজউইক ম্যাগাজিন। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল ম্যাগাজিনটি তাদের প্রচ্ছদজুড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দিয়ে লিড নিউজে তাঁকে অভিহিত করে ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ বা ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের জন্যই তাকে এ উপাধি দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তাঁর বেশ কয়জন সমালোচক মন্তব্য করেন, শেখ মুজিব তার চরমপন্থি সমর্থকদের কাছে প্রায়
নতিস্বীকার করেছেন এবং যে গণজোয়ারে তিনি পরিবেষ্টিত সেই জোয়ারের চূড়ায় তিনি চড়তে চাইছেন। তবে এই নতুন বাঙালি জাতির লড়াইরত নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের আবির্ভাব সারাজীবন ধরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য তার সংগ্রামেরই যৌক্তিক ফলাফল। শেখ মুজিব যদি জোয়ারের চূড়ায়ও চড়তে চেয়ে থাকেন, তবুও সেখানে তার অবস্থানটা মোটেও আকস্মিক ছিলনা। ১৯১৭ সালে শোষিতের পক্ষে সংঘটিত হয় রুশ বিপ্লব। পৃথিবীর রাজনীতি দ্বিধাবিভক্ত হয় শোষিত আর শোষকের পক্ষে। এ উপমহাদেশের রাজনীতিতে সূচিত হয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নানা সক্রিয় ধারা। রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধু উজ্জীবিত হয়েছিলেন রুশ বিপ্লবের মূলমন্ত্রে-শোষিতের পক্ষে, ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের দেশপ্রেম আলোড়িত করেছিল তাঁকে। একইসঙ্গে গান্ধী-নেহেরুর নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন তাকে আকৃষ্ট করেছিল।
তিনি অন্তরে গভীরভাবে গ্রহণ করেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ। নেতাজি সুভাষ বসুর স্বদেশি আন্দোলন তরুণ শেখ মুজিব উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন প্রবলভাবে। বঙ্গবন্ধু আত্মপরিচয়, আপন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, অবিভক্ত ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসকে ধারণ করেছিলেন হৃদয়ের গভীরে।
ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম, সিপাহি বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, গারো-হাজং বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহসহ অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত সব আন্দোলন- সংগ্রামকে অন্তরে ধারণ করেন। অবিভক্ত ভারতে শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন ও
দারিদ্র্য থেকে বাংলার দুঃখী মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষায় তিনি যুক্ত হন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। বরাবরই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে
বিশ্বাসী ছিলেন। সে কারণেই তিনি যুক্ত হন গান্ধী-জিন্নাহ-নেহেরুর ব্রিটিশবিরোধী নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে। শোষিত, বঞ্চিত, দরিদ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর মুক্তির আকাক্সক্ষায় তখন সমর্থন দেন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। কিন্তু ১৯৪৭-এর পর যখন মাতৃভাষা বাংলার ওপর
আঘাত এলে, মুখোশ উন্মোচিত হয় পাকিস্তানি শাসকদের, বঙ্গবন্ধু প্রতিবাদে সোচ্চার হন, যুক্ত হন রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনে।
১৯৪৮ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান সংবিধান সভার বৈঠকে মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার অভিমত ব্যক্ত করে, তখন
কুমিল্লার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন; কিন্তু পশ্চিম
পাকিস্তানের কোনো মুসলিম লীগ সদস্য কিংবা পূর্ব বাংলার কোনো মুসলিম লীগ সদস্যই তার প্রস্তাব সমর্থন করেননি। ১৯৫২-র ভাষা
আন্দোলনের পর ক্রমেই এ দেশের মানুষও সংগঠিত হয় স্বাধিকার ও জাতীয়তাবাদের চেতনায়। আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিবাদে
সোচ্চার হতে থাকে শোষণ-নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে। শাসনতন্ত্রের জন্য আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা
আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন সবই সেই সংগ্রামের মাইলফলক। বাঙালির স্বাধিকার
আদায়ে এসব আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে পরীক্ষিত বঙ্গবন্ধু কী করে সবার প্রিয় নেতা হয়ে উঠেন, সে ইতিহাস সবারই জানা। ঊনসত্তর
সালের প্রবল গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পদত্যাগ করে সামরিক বাহিনীর এক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের
কাছে ক্ষমতা অর্পণ করেন।
তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন ১৯৫৮ সালে। ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচন দেওয়ার ঘোষণা
দিলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গন নির্বাচনী হাওয়ায় সরগরম হয়ে ওঠে। ১৯৭০ এর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর
আওয়ামী লীগ পেয়েছিল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী স্বতন্ত্রসহ
পাকিস্তানের অন্যান্য নয়টি দল পেয়েছিল অবশিষ্ট ১৪০টি আসন। নির্বাচনে ১৬০টি আসনে জয়ী হওয়া ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের জন্য সংরক্ষিত নয়টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৭টি আসন। সর্বমোট আসন সংখ্যা ছিল ১৬৭। সাধারণ নির্বাচনের পাশাপাশি অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনের ৩০০ আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৮৮টি আসন।
অর্জিত হয় বাঙালির বিপুল বিজয়। ভূমিধ্বস বিজয় বা ল্যান্ড স্লাইড ভিক্টরি যাকে বলে। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর করতে নানা টালবাহানা করে সময়ক্ষেপণ করছিল। এলো একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ! মার্চ মাসের শুরু থেকেই সারা দেশ অসহযোগ আন্দোলন, বিক্ষোভ-সংগ্রামে টালমাটাল। রাজনীতির কবি প্রতিদিন রচনা করছিলেন বাংলাদেশ নামক মহাকাব্যের নতুন নতুন নতুন অধ্যায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করলে সারা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
ঢাকা হয়ে ওঠে, প্রতিবাদে, ক্ষোভে উত্তাল মিছিলের শহর। একাত্তরের ১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অকস্মাৎ ঢাকায় এলেন। ইতোমধ্যে
৭ মার্চে রেসকোর্সের জনসভায় রাজনীতির অকুতোভয় কবি বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। স্বাধীনতার অমোঘ
আহ্ধসঢ়;বান। ভাষণ নয়, যেন বাংলার মানুষের হৃদয়ের আকাক্সক্ষার এক অনন্য কবিতা যে কবিতা পাঠ করলেন কবি ১৯ মিনিট ধরে অত্যন্ত প্রতীকী স্টাইলে। ঢাকায় এসে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে আলোচনার নামে সাজানো নাটকের অন্তরালে করলেন গভীর গোপন ষড়যন্ত্র। ১৬-২৪ মার্চ পযন্ত মুজিব-ইয়াহিয়া বেশক’টি বৈঠক চলার পর আলোচনা অমীমাংসিত রেখেই কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ ঢাকা ত্যাগ করেন ইয়াহিয়া।
আর ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পরিকল্পিত নীলনকশা অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী শুরু করে ‘অপারেশন সার্চলাইট’
নামে পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম নৃশংস গণহত্যা। ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালির ওপর রাতের গভীরে চালায় অতর্কিত হামলা। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার
করে নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। গ্রেফতার হওয়ার আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পূর্বপ্রস্তুতি অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্টের (ইপিআর) ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে পুরান ঢাকার বলধা গার্ডেন থেকে গোপন ট্রান্সমিটার সেটের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় স্বাধীনতার ঘোষণাবার্তা পাঠান। সেই রাতে বঙ্গবন্ধু তার সব সহকর্মী নেতাকে নিরাপদ অবস্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন; কিন্তু তিনি থেকে যান ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের নিজ বাড়িতেই। গ্রেফতার বরণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। এসব ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যত ষড়যন্ত্র, অপচেষ্টাই হোক না কেন, তাকে কখনো বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। তিনি ছিলেন আমাদের অবিসংবাদিত নেতা, রাজনীতির এক অকুতোভয় কবি।
কবি কল্পনা করেন, ভাবেন, স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নের প্রতিরূপ ‘কবিতা’। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছেন রাজনীতি নিয়ে, সেই স্বপ্ন ছিল একটি জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতা এনে দেয়ার, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দেয়ার। কবিদের মতোই বঙ্গবন্ধু রূপ দিয়েছেন তাঁর স্বপ্নের। লিখলেন পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে এই জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতা এনে দেয়ার, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দেয়ার স্বপ্নের সে প্রতিরূপ, সে কবিতা। বঙ্গবন্ধুর সে কবিতাই হয়ে উঠলো আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। রাজনীতির এই কবিকে নিয়ে নানা দেশ এবং বিদেশের নানা লেখক, কবি লিখলেন গল্প, গান, কবিতা, নাটক। নিশ্চিতভাবেই বিশ্বের খুব কম রাষ্ট্রনায়ক ও রূপকারকে নিয়ে এত অধিক সংখ্যক কবিতা লেখা হয়েছে।
অগ্রজ কবিদের লেখনী থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমকালীন কবিরা যেমন লিখছেন, আগামী দিনের কবিরাও তেমন বঙ্গবন্ধুকে তাদের কবিতায় চিত্রিত করবেন নানাভাবে নানারঙে। যতকাল বাংলা ভাষা ও সাহিত্য থাকবে, ততকাল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত হবে কোনো না কোনো কবিতা, গল্প, উপন্যাস। বঙ্গবন্ধু রচিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে ‘থালা বাটি কম্বল- জেলখানার সম্বল’ লেখা থেকে বঙ্গবন্ধুর অনন্য সাধারণ রচনাসমূহ যে কত গভীর ও বিশাল কবিতার প্রতীক, উপমা ও কালের ক্যানভাস সমৃদ্ধ তা সহজেই অনুমেয়। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন ‘ জেলে যারা যায় নাই, জেল যারা খাটে নাই- তারা জানে না জেল কি জিনিস। আমি অনেকবার জেলে যেতে বাধ্য হয়েছি। রাজবন্দী হিসেবে জেল খেটেছি, সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছে। আবার হাজতি হিসেবেও জেল খাটতে হয়েছে। তাই সকল রকম কয়েদির অবস্থা নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পেরেছি।’ এমন চমৎকার ভাষায় কাব্যিক উচ্চারণে বন্দী জীবনকে চিত্রিত করার এত সহজ- সরল ভঙ্গিমা ক’জন মহান কবি ইতিহাসে উপস্থাপন করতে পেরেছেন তা সকলের অজানা।
লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট