কৃষিতে ঈর্ষণীয় সাফল্য : সঙ্কট থেকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : স্বাধীনতার ৫০ বছরে কৃষিতে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। একদিকে কৃষিজমি কমেছে, অন্যদিকে কয়েকগুণ বেড়েছে জনসংখ্যা। তবুও খাদ্যের কোনো অভাব নেই। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের খাদ্য সঙ্কটের বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল। ধান, গম, ভুট্টা, আলু, সবজি, মাছ উৎপাদনে শীর্ষ কাতারে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। কৃষি বিজ্ঞানীদের খাদ্যশস্যের নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবন, ভর্তুকি দিয়ে সার ও সেচের পানিপ্রাপ্তি সহজ করা, বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবন, ১ কোটি ৮০ লাখেরও বেশি কৃষকের মধ্যে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড বিতরণ, ১০ টাকার বিনিময়ে কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলাসহ নানা রকম পদক্ষেপের কারণেই গত ৫০ বছরে কৃষিতে বাংলাদেশ এই অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে।
এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান সময়ের আলোকে জানান, ৫০ বছর আগের বাংলাদেশ আর বর্তমান সময়ের বাংলাদেশের মধ্য বিস্তর ফারাক রয়েছে। এ সময়ে বাংলাদেশের অনেক খাতেই গর্ব করার মতো সাফল্য রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কৃষিখাত। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে ছিল ব্যাপক খাদ্য সঙ্কট। বর্তমান সময়ের বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় ১৯৭৪ সালে যে দেশে দুর্ভিক্ষে মানুষ না খেয়ে মরেছে, সে দেশে এখন খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকে। এই অর্জন কোনো ছোট অর্জন নয়, অনেক বড় অর্জন। এই অর্জনের পেছনে সবার আগে অবদান রয়েছে আমাদের দেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের। কারণ তারা গবেষণা করে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের নতুন নতুন জাতের উদ্বাবন ঘটিয়েছেন, যাতে অল্প জমিতে বেশি ফসল ফলানো যায়। যে দেশে একদিকে কৃষিজমি কমেছে, অন্যদিকে জনসংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে: সে দেশে খাদ্যের উৎপাদন তিনগুণ বাড়ানোর মূল কারিগর এই বিজ্ঞানীরা। তা ছাড়া কৃষির আধুনিকায়ন, সার, সেচের পানি সহজ করাও বড় ভূমিকা রেখেছে।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন তিনগুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচগুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দশগুণ। স্বাধীনতার পর দেশে প্রতি হেক্টর জমিতে ২ টন চাল উৎপাদিত হতো। এখন হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হচ্ছে ৪ টনেরও বেশি। ধান ধরে হিসাব করলে তা ৬ টন। তা ছাড়া হেক্টরপ্রতি ভুট্টা উৎপাদনে বিশ্বের গড় ৫ দশমিক ১২ টন। বাংলাদেশে এই হার ৬ দশমিক ৯৮ টন। খাদ্যশস্যে প্রতি হেক্টরে ১০ দশমিক ৩৪ টন উৎপাদন করে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের পর রয়েছে আর্জেন্টিনা, চীন ও ব্রাজিল। আর এভাবেই প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ।
সারাবিশ্বে চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। আমন, আউশ ও বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলনে বছরে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। আজ সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয়। দেশে রীতিমতো সবজি বিপ্লব ঘটে গেছে গত এক যুগে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। এখন দেশের প্রায় সব এলাকায় সারাবছরই সবজির চাষ হচ্ছে। এখন দেশে ৬০ ধরনের ও ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। দেশে বর্তমানে ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার রয়েছে। এই কৃষক পরিবারগুলোর প্রায় সবাই কম-বেশি সবজি চাষ করে।
মাছ উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। মাছ রফতানি বেড়েছে ১৩৫ গুণ। এফএও পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। এরপর থাইল্যান্ড, ভারত ও চীন। মৎস্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ডফিশের তথ্য মতে, বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ এখন বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। অথচ চার বছর আগেও বিশ্বের মোট ইলিশের উৎপাদনের ৬৫ শতাংশ আসত বাংলাদেশ থেকে। এ সময়ের মধ্যে এখানে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে ইলিশের উৎপাদন। ফলে সারাবিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন শীর্ষে। বাংলাদেশের পরই ইলিশ উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে ভারত।
ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে পঞ্চম। বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল বিশ্বের সেরা জাত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আম উৎপাদনে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বে মোট আম উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়। ফলটির উৎপাদনে শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। গত দুবছরে প্রায় ১০ লাখ টন আম উৎপাদনের মাধ্যমে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ মূল্যায়নে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ আলু উৎপাদনে অষ্টম স্থানে রয়েছে। এক দশক আগেও আলুর উৎপাদন ছিল অর্ধলাখ টনের নিচে। এখন তা ১ কোটি টন ছাড়িয়ে গেছে। এ সাফল্য বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে আলু উৎপাদনকারী শীর্ষ দশ দেশের কাতারে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য মতে, আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ রয়েছে অষ্টম স্থানে। ফসলের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষ কাতারে রয়েছে বাংলাদেশ। ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সফলতাও বাড়ছে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) বেশ কয়েকটি জাত ছাড়াও এরই মধ্যে পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) বিজ্ঞানীরা মোট ১৩টি প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। এর মধ্যে লবণসহিষ্ণু নয়টি, খরাসহিষ্ণু দুটি ও বন্যাসহিষ্ণু চারটি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন তারা।
স্বাধীনতার পর দেশে ১ কোটি ১০ লাখ হেক্টর চাষযোগ্য জমি ছিল। মাথাপ্রতি জমির পরিমাণ ছিল গড়ে দশমিক ১৮ হেক্টর। কৃষিতে ৮০ শতাংশ শ্রমশক্তি নিয়োজিত থাকত। দানাজাতীয় ফসলের উৎপাদন থেকে বার্ষিক দেশজ চাহিদার মাত্র ৬০ শতাংশ মেটানো যেত। বাকি ৪০ শতাংশের জন্য নির্ভর করতে হতো বিদেশ থেকে আমদানির ওপর। ফল, ফুল, শাকসবজি, দুধ, ডিম, মাংসের উৎপাদন ছিল মূলত পরিবারকেন্দ্রিক।
অথচ ৫০ বছর পর দেশের কৃষিচিত্র হয়ে উঠেছে ঐশ্বর্যমণ্ডিত। এখন আমাদের মাথাপিছু চাষযোগ্য জমি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র দশমিক ৮ হেক্টরে। জনসংখ্যা হয়েছে ১৭ কোটির কাছাকাছি। এ অবস্থা সত্ত্বেও বর্তমানে গড়ে প্রায় ৪ কোটি ৪৬ লাখ টন দানাজাতীয় খাদ্য উৎপাদন করছে বাংলাদেশ, যা ৫০ বছর আগের তুলনায় প্রায় সাড়ে তিনগুণ।
এক সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির পর্যালোচনা করেছিল বিশ্বব্যাংক। ঐ প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছিল, ৭০-এর দশকের বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিচিত্র। যেখানে বলা হয়েছিল, ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিএনপি) কৃষিখাতের অবদান ছিল ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ। আর শিল্প ও সেবাখাতের অবদান যথাক্রমে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও ৩৪ শতাংশ। আর এখন জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান ১৩ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে।
এ বিষয়ে আরেক অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, গত ৫০ বছরে আমাদের অর্থনীতির কাঠামোগত বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। আগে কৃষির অবদান ছিল ‘জিডিপিতে’ সবচেয়ে বেশি। এখন সেবাখাতের অবদান সবচেয়ে বেশি। শিল্প, ছোট শিল্পের অবদান ক্রমবর্ধিষ্ণু। আগে আমাদের রফতানিযোগ্য দ্রব্য ছিল পাট, পাটজাত দ্রব্য, চা এবং চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য। এসবের রফতানিমূল্য এখন খুবই কম। এখন এসবের বিপরীতে স্থান পেয়েছে তৈরি পোশাক। তৈরি পোশাক রফতানির পরিমাণ মোট রফতানির প্রায় ৮০ শতাংশ। তিনি আরও বলেন, জিডিপিতে হয়তো কৃষির অবদান কমেছে, কিন্তু খাদ্যে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এটি বাংলাদেশের অনেক বড় পাওয়া।