বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : বোরো উৎপাদনে এবার নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। এ বছর বোরো উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ৭ লাখ ৮৪ হাজার ৫০৮ টন, যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। এ বছর বোরোর উৎপাদন গত বছরের তুলনায় ১১ লাখ টনেরও বেশি হয়েছে। গত বছর উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৯৬ লাখ টন। উৎপাদন বাড়লেও কৃষকরা পর্যাপ্ত মূল্য পাচ্ছেন। এতে তারা লাভবানও হচ্ছেন। এছাড়া বিগত বছরগুলোর তুলনায় ফলনের পরিমাণও বেড়েছে। গত বছর দেশে বোরো ধানের জাতীয় গড় ফলন ছিল প্রতি হেক্টরে ৩ দশমিক ৯৭ টন। এ বছর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ২৯ টনে। অর্থাৎ হেক্টরপ্রতি উৎপাদন বেড়েছে দশমিক ৩২ টন, যা গত বছরের তুলনায় ৮ দশমিক শূন্য শতাংশ বেশি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এ বছর বোরোর উৎপাদন গত বছরের তুলনায় ১১ লাখ টনেরও বেশি হয়েছে। গত বছর উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৯৬ লাখ টন। এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি উৎপাদন হয়েছে। এবার বোরোতে ২ কোটি ৫ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সব মিলিয়ে এ উৎপাদন দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় চলতি বছরের শুরুতেই আমরা সর্বাত্মক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলাম। সকল স্তরে যে কোন মূল্যে বোরোতে উৎপাদন বাড়াতে কাজ হয়েছে। বীজ ও সারসহ প্রণোদনা পেয়েছেন কৃষকরা। আমাদের উদ্যোগের ফলে গত বছরের তুলনায় এ বছর ১ লাখ ২০ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়। তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩ লাখ হেক্টরেরও বেশি জমিতে হাইব্রিডের আবাদ বেড়েছে। ফলে গত বছরের তুলনায় এবার বোরোতে বেশি উৎপাদন হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, উৎপাদন যেমন বেড়েছে, চাহিদাও তেমন বেড়েছে। দেশে কৃষিজমি প্রতিনিয়ত কমছে। এর মধ্যে বাড়ছে মানুষ। রোহিঙ্গাদের চাপ তো আছে। এছাড়া মাছের খাবার, পোল্ট্রিশিল্প, গরু মোটাতাজা করাসহ বিভিন্ন কাজে চালের ব্যবহার বাড়ায় প্রতিনিয়ত চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। যে কারণে এটি রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে।
এবার অতিরিক্ত গরম হাওয়া হাজার হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান পুড়িয়ে দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন বছরে মোট উৎপাদিত চালের ৫৫ ভাগের বেশি আসে বোরো থেকে। যদিও সফলভাবে প্রতি বছর এ ধান ঘরে উঠানো খুবই চ্যালেঞ্জিং। কারণ আকস্মিক বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে হাওড়ের ধান ঠিকমতো ঘরে তোলা নিয়ে প্রতি বছরই আতঙ্কে থাকতে হয় কৃষকদের। এদিকে এ বছরও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হিটশকে আক্রান্ত হয় বোরো ধান। পাশাপাশি করোনা পরিস্থিতির জন্য ধান কাটার সময় চলাচলে বিধিনিষেধ কিছুটা প্রভাবিত করে। তার পরও এ বছর সফল উৎপাদন দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় অর্জন।
কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, এত কিছুর পরও বোরোর রেকর্ড উৎপাদন নিশ্চয়ই প্রশংসনীয়। বড় কোন দুর্যোগ না থাকায় অত্যন্ত সফলভাবে এ বছর হাওড় অঞ্চলসহ সারাদেশের বোরো ধান ঘরে তোলা সম্ভব হয়েছে। এ জন্য সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছে। তিনি আরও বলেন, জমি কমলেও নতুন নতুন জাতের বোরোতে আশা জাগিয়ে রেখেছে সব সময়। কৃষকও এ বছর ভাল দাম পাচ্ছে। তাতে তাদের আগ্রহ আরও বাড়বে।
এদিকে এ বছর ধান কাটার শ্রমিক সঙ্কট অনেকটা কমিয়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার। তিন হাজার ২০ কোটি টাকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় অঞ্চলভেদে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ ভর্তুকি দিয়ে ধান কাটাসহ অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষকদের দেয়া হয়েছে। তথ্য বলছে, গত বছর ধান কাটতে কম্বাইন হারভেস্টার মাঠে নামানো হয়েছে ১ হাজার ২৪০টি। এ বছর ১ হাজার ৬৬৬টিসহ মোট ২ হাজার ৯০৬টি কম্বাইন হারভেস্টার মাঠে ধান কেটেছে। রিপারও চলছে মোট ৮৩৯টি, যা গত বছরের প্রায় দ্বিগুণ।
এবার তিন লাখ হেক্টরেরও বেশি জমিতে হাইব্রিডের আবাদ বেড়েছে। সারাদেশে এ বছর ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে। গত বছর বোরো ধান আবাদ হয় ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার ৪৪৭ হেক্টরে। অর্থাৎ এ বছর ১ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর বেশি আবাদ হয়েছে। এদিকে এ বছর বেড়েছে উচ্চ ফলনশীল জাতের চাষাবাদ। যেখানে গত বছর হাইব্রিড ধান চাষের জমির পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৮৬ হাজার হেক্টর, তা এ বছর বেড়ে হয়েছে ১২ লাখ ১৩ হাজার হেক্টর। অর্থাৎ ৩ লাখ ২৭ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে হাইব্রিড ধান আবাদ হয়েছে। হাইব্রিডের গড় ফলন এবার বেশি।
এছাড়া হাওড়ভুক্ত সাতটি জেলায় এ বছর বোরো আবাদ হয়েছে ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৫৩৪ হেক্টর জমিতে, যা দেশের মোট আবাদের প্রায় ২০ শতাংশ। শুধু হাওড়ে বোরো আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫১ হাজার ৭৭০ হেক্টর জমিতে, যা মোট আবাদের প্রায় ৯.২৫ শতাংশ। নতুন জাতের ফলন হয়েছে বিঘাপ্রতি ৩১ মণ। দীর্ঘকাল ধরে দেশে বোরো উৎপাদনের সিংহভাগই আসছে ‘ব্রি ধান ২৮’ এবং ‘ব্রি ধান ২৯’ থেকে। দুই যুগের বেশি পুরনো এসব জাতের উৎপাদনশীলতা দিন দিন কমেই চলেছে। অন্যদিকে বাড়ছে নতুন নতুন রোগ-বালাইয়ের প্রকোপও। ফলে পুরনো এসব জাতের বিকল্প হিসেবে নতুন নতুন উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষের চেষ্টা চলছে প্রতিনিয়ত।
এবার হাওড়ে বোরো আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫১ হাজার ৭৭০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে এ বছর সবচেয়ে আশা জাগানো নতুন জাত হিসেবে উঠে এসেছে ‘ব্রি ধান ৮১’। এছাড়া ‘ব্রি ধান ৮৮’, ‘ব্রি ধান ৮৯’, ‘ব্রি ধান ৯২’ ও ‘ব্রি ধান ৯৬’ পুরনো জাতগুলোর তুলনায় পরীক্ষামূলক প্রদর্শনীতে দারুণ ফলন দিয়েছে।
জানা গেছে, সদ্য সমাপ্ত বোরো মৌসুমে দেশে রেকর্ড পরিমাণ ফলন দিয়েছে ‘ব্রি ৮১’। চাষীরা বিঘাপ্রতি ৩১ মণ ফলন পেয়েছেন উচ্চ ফলনশীল এ জাত থেকে। যেখানে প্রতি হেক্টরে আগের জনপ্রিয় জাত ‘ব্রি ২৮’ উৎপাদন হতো ৬ টন, সেখানে একই জমিতে ‘ব্রি ৮১’ চাষ করে ফলন পাওয়া গেছে সাড়ে ৭ টন পর্যন্ত। ফলন বেশি হওয়ায় এ বছর হাইব্রিড ধানের উৎপাদন যেমন বেশি হয়েছে, উচ্চ ফলনশীল ধানের প্রচলন ও সম্প্রসারণও বেড়েছে।