রিয়াজ হোসেন (লিটু), নাটোর: চলনবিলে খাল খনন ও এলএলপি (লো লিফট পাম্প) ব্যবহার করে সুফল পাচ্ছেন কৃষকরা। পানাসি প্রকল্পের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ৮২ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। এতে করে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা নিরসনের পাশাপাশি সেচ সুবিধার আওতায় এসেছে ফসলি জমি। এদিকে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ফসল উৎপাদনের ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)। এজন্য চলনবিল অঞ্চলের কৃষকদের স্বল্প খরচে সমবায় ভিত্তিতে দেওয়া হচ্ছে লো লিফট পাম্প (এলএলপি)। এতে করে ৫ হাজার ৮১১ হেক্টর জমি সেচ সুবিধার আওতায় এসেছে। এতে কমেছে ফসল উৎপাদন খরচ।
বিএডিসি অফিস জানায়, চলনবিল অঞ্চলে সার্ভে অনুযায়ী মোট ২০০ কিলোমিটার খাল রয়েছে। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা খরচ করে ১১টি খালের ৬৪ কিলোমিটার খনন করা হয়েছে। এতে করে সেচের আওতায় এসেছে ৬ হাজার হেক্টর জমি। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৮কিলোমিটার খাল পুনর্খনন কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া এই অর্থবছরে আরও ৯৪ কিলোমিটার খাল পুনর্খননের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিএডিসি। এই খাল খনন হলে চলনবিলে ১২ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমির জলাবদ্ধতা নিরসনের পাশাপাশি ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার করে সেচের আওতায় আসবে ১০ হাজার হেক্টর জমি।
এতে করে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমে আসবে। স্বল্প খরচে ফসল উৎপাদন করতে পারবে কৃষক। এছাড়া মাঠ থেকে ফসল আনা নেওয়ার জন্য রাস্তা ও পরিবেশের ভারসম্য রক্ষার জন্য গাছ রোপণ করা হচ্ছে। কৃষকরা বলছেন, চলনবিল অঞ্চলের মজা খালগুলো পুনরায় খনন করা হলে এ অঞ্চলের জমিগুলো জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা পাবে। পাশাপাশি ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার করে শুকনো মৌসুমে সেচ সংকট মেটাতে পারবে কৃষক। যে খালগুলো খনন করা হয়েছে, সেগুলো থেকে সুফল পেতে শুরু করেছে তারা।
চলনবিলের ডাহিয়া ইউনিয়নের কৃষক আবুল কালাম বলেন, প্রতি দশ বছর পর পর চলনবিলে বন্যার পানিতে খালগুলো ভরাট হয়ে যায়। এতে খালগুলো মজা খালে পরিণত হয়। আর মজা খালগুলোতে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ থাকার কারণে জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে তারা। কিন্তু স্থানীয় বিএডিসি খালগুলো পুনরায় খনন করায় গত দুই বছরে জলাবদ্ধতার কবলে পড়েনি তারা। তাছাড়া শুকনো মৌসুমে খালের পানি ব্যবহার করে রবিশস্যে ফসল উৎপাদন করতে পারছে তারা। সিংড়ার ইটালি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম বলেন, শস্য উৎপাদনের জন্য চলনবিলকে খাদ্যভা-ার বলা হয়। আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর চেষ্টায় চলনবিলের খালগুলো পুনরায় খনন করা হচ্ছে।
এতে শস্য উৎপাদন বাড়ছে। বিএডিসি সিংড়া উপজেলার সহকারী প্রকৌশলী শাহ কিবরিয়া মাহবুব তন্ময় বলেন, ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে চলনবিলে মোট ৮২ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। আমরা চলতি অর্থবছরেও আরও ৯৪ কিলোমিটার খাল খননের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছি। আগে খাল খননের কারণে ৬ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় এসেছে। নতুন করে খাল খনন হলে আরও ১০ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসার পাশাপাশি জলাবদ্ধতা নিরসন হবে।
এদিকে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে এনে ফসল উৎপাদনের জন্য ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)। এজন্য চলনবিল অঞ্চলের কৃষকদের স্বল্প খরচে সমবায় ভিত্তিতে ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে দেওয়া হচ্ছে লো লিফট পাম্প (এলএলপি)। বর্তমানে মোট ২১টি স্থানে এই এলএলপি স্থাপন করা হয়েছে। চলতি বোরো মৌসুমে এখন পর্যন্ত মোট ৬টি চালু করা হয়েছে। শিগগিরই আরও ১৫টি চালু হবে। এতে করে চলনবিলের নদী এবং খালের পানি ব্যবহার করে ৫ হাজার ৮১১ হেক্টর জমি সেচ সুবিধার আওতায় আসবে। এতে করে কমবে ফসল উৎপাদন খরচ।
বিএডিসি সিংড়া উপজেলার উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. ইমরান বলেন, ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদনের জন্য জোর দিয়েছে সরকার। এই লক্ষ্য নিয়ে আমরা চলনবিলের কৃষকদের সমবায় ভিত্তিতে এলএলপি স্থাপন করে দিচ্ছি। যার প্রতিটিতে খরচ পড়ছে ২৫ লাখ টাকার মতো। এছাড়া ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে ১ হাজার মিটার ভূগর্ভস্থ পাইপ স্থাপন করা হচ্ছে। এতে করে সেচের পানির অপচয় হচ্ছে না। ফলে কৃষকদের পাম্প পরিচালনা এবং ফসল উৎপাদন খরচ কমে আসছে। চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, চলনবিল অঞ্চলে বেশি বেশি খাল পুনরায় খনন করা হলে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের ওপর জোর দেবে কৃষকরা। এতে করে কৃষকদের উৎপাদন খরচও কমে আসবে। পাশপাশি রির্জারভার তৈরি হবে ভূগর্ভস্থ পানি। এতে করে ঠিক থাকবে চলনবিলের পরিবেশ।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, পানাসি প্রকল্পের মাধ্যমে চলনবিল অঞ্চলে গত ১২ বছরে ১১৪ কিলোমিটার খাল পুনরায় খনন করেছে বিএডিসি। এতে করে অতিরিক্ত ৫০ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। আগামী দিনে চলনবিল অঞ্চলে খাল পুনরায় খনন শেষ হলে সুফল পাবে সাধারণ কৃষকরা।