নিজস্ব প্রতিনিধি : মিষ্টি জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের স্বার্থে আখের পাশাপাশি অন্যান্য চিনিশস্য যেমন তাল, খেজুর, গোলপাতা, স্টিভিয়া, যষ্টিমধু এবং মধুর ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিগত ৯ নভেম্বর ২০১৫ খ্রি. থেকে বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ সুগারক্রুপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) রাখা হয়।
প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তনের পর থেকে সকল ধরনের চিনিশস্যের গবেষণার মান উন্নয়ন এবং মাঠ পর্যায়ে প্রযুক্তি সম্প্রসারণের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়সহ অধিনস্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্যান্য শিল্প কারখানার সঙ্গে চিনিকলগুলো জাতীয়করণ করেন যাতে আখ চাষীদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হয়।
কিন্তু স্বল্প মেয়াদী ও উচ্চ-মূল্যের ফসলের প্রভাবের কারণে দিন দিন মিল এলাকায় আখের চাষের জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। আখের ফলন বৃদ্ধি এবং আখ চাষের নতুন অঞ্চল সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সুগারক্রুপ গবেষণা ইনস্টিটিউটে গবেষণার মান উন্নয়নের পাশাপাশি প্রশাসনিক বিভিন্ন কার্যক্রমে গতিশীলতা আনা হয়েছে।
বর্তমান মহাপরিচালক ড. মো: ওমর আলী মহোদয় গত এক বছরে বিএসআরআই এর গবেষণা বিভাগের বার্ষিকী কর্মসম্পাদন চুক্তি অনুসারে যে সকল গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে সেগুলো নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে। বিএসআরআই এ কর্মরত সকল স্তরের বিজ্ঞানী, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং শ্রমিকদেরকে বীজ উৎপাদন, কীটনাশক ও আগাছা দমন, সার এবং সেচ ব্যবস্থাপনাসহ নানাবিধ বিষয়ে নিয়মিত পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। গবেষণা মাঠের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বৃদ্ধি এবং প্রতিটি গবেষণা প্ল টের সাইনবোর্ড হালনাগাদ করা হয়েছে।
বিএসআরআই হতে ইতোমধ্যে ৪৮ টি আধুনিক আখের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং নতুন করে আরো দুটি উচ্চ ফলনশীল আখ জাত অনুমোদনের অপেক্ষায়। বিগত রোপন মৌসুমে (২০২২-২৩) রোগমুক্ত পরিচ্ছন্ন বীজ উৎপাদন কর্মসূচি এবং সাথী ফসল প্রকল্পের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশের মিল এবং মিল-বহির্ভূত এলাকায় প্রায় ২২০০ এর অধিক সংখ্যক আখের প্রদর্শনী প্লট বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং আনুমানিক ১৫ লক্ষ সংখ্যক বীজ আখ উৎপাদন করে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ, মাঠ দিবস, সেমিনার এবং ওয়ার্কশপ এর মাধ্যমে বিএসআরআই এর উদ্ভাবিত প্রযুক্তি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করেছে প্রায় ৫০০০ জন কৃষক এবং আনুমানিক ২০০ জন কর্মকর্তা। আরবীয় খেজুর গাছ এর প্রায় ৫০ টি আধুনিক জার্মপ্লাজম সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে নতুন খেজুর বাগান নির্মাণ করা হয়েছে যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে
বাংলাদেশে আরবীয় খেজুরের জাত মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নির্দেশনাকে সামনে রেখে বিএসআরআই খামারের আওতাভূক্ত আখের জমিসমূহের শস্যবিন্যাসে পরিবর্তনের ফলে ফাঁকা জায়গাগুলোতে ধান এবং ডালসহ নানা জাতীয় ফসলের চাষাবাদ করা হচ্ছে এতে করে অভ্যন্তরীণ উৎস হতে আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে চাল এবং ডাল ফসলের চাহিদা পূরণে অবদান রাখা সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি ডাল জাতীয় ফসলের চাষের ফলে মাটির মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। মধু গবেষণার মান উন্নয়নের জন্য আধুনিক মৌ-বক্স মৌ-চাষীদের মাঝে সরবরাহ করা হয়েছে যার ফলে পূর্বের তুলনায় বৈজ্ঞানিক এবং স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মৌ-চাষীরা অধিক মধু আহরণ করতে পারছে যাতে তাদের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। বিএসআরআই এর প্রধান কার্যালয়ে প্রায় এক লক্ষ তালের চারা উৎপাদন করা হয়েছে যার মধ্যে ৭০ হাজার তালের চারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় বিতরণ করা হয়েছে।
চিনির বিকল্প ফসল স্টিভিয়ার গবেষণার মান উন্নয়নের জন্য মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের মাঝে স্টিভিয়ার প্রদর্শনী প্লট দেয়া হয়েছে। তাছাড়া স্টিভিয়া চাষাবাদ সংক্রান্ত নিয়মিত মাঠ দিবস এবং প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হচ্ছে যার মাধ্যমে কৃষকরা স্টিভিয়া চাষাবাদে আগ্রহী হচ্ছে যা আগামী দিনে চিনির বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হবে। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় হতে শিক্ষা সফরে আগত শিক্ষার্থীদের মাঝে চিবিয়ে খাওয়া আখের রস সরবরাহ করা হচ্ছে এবং কোমলমতি স্কুল-কলেজের ছাত্রদের মাঝে মিষ্টি জাতীয় খাদ্য চাহিদা পূরণে আখ চাষের অর্থনৈতিক গুরুত্ব সস্পর্কে ধারণা দেয়া হচ্ছে।
মহাপরিচালকের নেতৃত্বে গবেষনার পাশাপাশি বিএসআরআই এর ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বিএসআরআই এর মেইনগেট যেটি যানবাহন চলাচলের জন্য ত্রুটিগ্রস্ত ছিল সেটিকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে যার ফলে যানবাহন চলাচলে স্বাভাবিকতা এবং নান্দনিকতা উভয়ই ফিরে এসেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য বিএসআরআই এর প্রশাসনিক ভবনে বঙ্গবন্ধু কর্নার নির্মাণ করা হয়েছে যা ১৫ ই আগষ্টে, ২০২৩ খ্রি. এ উদ্বোধন করা হয়। বঙ্গবন্ধু কর্নার এ তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস এবং এর সাথে জড়িয়ে থাকা জাতির পিতার সংগ্রামী জীবনকে। এছাড়া বিএসআরআই এর ২ নং গেটের সম্মুখ অংশকে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে যেখানে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী উক্তি প্রদর্শন এবং স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের মাধ্যমে শোভা বর্ধন করা হবে। খামারের গবেষণা প্লটগুলো তদারকি করার জন্য অভ্যন্তরীণ কাঁচা রাস্তাকে পাকা রাস্তায় রূপান্তর করা হয়েছে। এছাড়া গেস্ট হাউজ এবং প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর বিভাগের পুরাতন কক্ষগুলোকে টাইলস সংযোজনের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। নামাজের সুবিধার্থে বিএসআরআই জামে মসজিদের অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয়েছে। বিএসআরআই এর অব্যবহৃত পুকুরগুলো সংস্কার করে পুকুরগুলোতে
রুই, কাতলা, মৃগেলসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ ছাড়া হয়েছে। তাছাড়া দেশী-বিদেশি ফুল এবং সৌন্দর্যবর্ধনকারী বিভিন্ন জাতের বৃক্ষ রোপন করার মাধ্যমে বিএসআরআই ক্যাম্পাসে এখন মনোরম পরিবেশ বিরাজ করছে।
বিএসআরআই এর নতুন আঞ্চলিক কেন্দ্র সুবর্ণচর, নোয়াখালী যেটি ১০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত সেখানে মাটি, কীটপতঙ্গ, পোকামাকড় ও সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন সমস্যার উপর ভিত্তি করে গবেষণা কার্যক্রম বর্তমানে চলমান রয়েছে। ‘কৃষক পর্যায়ে আখের রোগমুক্ত পরিচ্ছন্ন বীজ উৎপাদন ও বিস্তার” শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় কৃষকদের বীজের মান উন্নয়নে আখের ভিত্তি বীজ প্লট স্থাপন করা হয়েছে। বিএসআরআই উদ্ভাবিত ৩০ টি আধুনিক আখের জাত নিয়ে মিউজিয়াম প্লট স্থাপন করা হয়েছে। চিনির বিকল্প জিরো ক্যালরি স্টেভিয়ার সম্ভাবনা যাচাইয়ের জন্য স্টেভিয়ার গবেষণা এবং প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে সে বিবেচনায় বিভিন্ন মৌসুমী সবজি চাষাবাদ এবং ফলজ বৃক্ষ রোপন করা হয়েছে। বজ্রপাত প্রতিরোধক প্রায় ১০০০০ পলিব্যাগ তালের চারা উৎপাদন করা হয়েছে এবং সরকারী, আধা-সরকারী ও এনজিও প্রতিনিধির সহায়তায় সেগুলো নোয়াখালী অঞ্চলের উপযুক্ত বিভিন্ন জায়গা বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে।
একইভাবে বিএসআরআই এর গাজীপুর এবং ঠাকুরগাঁও আঞ্চলিক কেন্দ্রের গবেষণার মান উন্নয়নে জোর দেয়া হচ্ছে। এছাড়া নতুন প্রতিষ্ঠিত গাইবান্ধা এবং বান্দরবান উপকেন্দ্রে বিএসআরআই এর সকল বিভাগ হতে বিষয়ভিত্তিক গবেষণা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। পরিচ্ছন্ন বীজ বিতরণ কর্মসূচি এবং আখের সাথে সাথী ফসল প্রকল্পের আওতায় চাষীদের নিজস্ব জমিতে আখের বিভিন্ন জাতের প্রদর্শনী প্লট দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে উপকেন্দ্রেগুলোতে আখ, স্টেভিয়া ও তালের চারা উৎপাদন ও চাষাবাদ কলাকৌশল বিষয়ে মাঠ দিবস ও কৃষক প্রশিক্ষণ আয়োজনের মাধ্যমে কৃষকদের হাতে কলমে আখ, স্টেভিয়া ও তাল চাষে উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দেয়া হচ্ছে। এতে করে উপকেন্দ্র আওতাভূক্ত এলাকায় আখসহ অন্যান্য মিষ্টি জাতীয় ফসলের ফলন যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি চিনি শস্যের নতুন নতুন অঞ্চল সৃষ্টি হচ্ছে।
গবেষণার পাশাপাশি বিএসআরআই এর প্রশাসনিক বিভিন্ন কর্মকান্ডে গতিশীলতা ফিরে এসেছে। দীর্ঘদিনের জটিলতা নিরসন করে ৫ জন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাকে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। তাছাড়া ২৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। নতুন করে ১৫ জন কর্মচারী এবং চারজন বিজ্ঞানীর নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়েছে। বিএসআরআই এর ১৬ টি মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলে (বিএআরসি) দুইবার ডিপিসি আয়োজন করা হয়েছে, কিন্তু মামলা সংক্রান্ত জটিলতায় পদোন্নতি প্রদান করা সম্ভব হয়নি। মামলা নিষ্পত্তি এবং দ্রুত পদোন্নতির লক্ষ্যে মামলার বাদী-বিবাদী, কৃষি মন্ত্রণালয় এবং বিএআরসি এর সাথে আলোচনা চলমান রয়েছে। বিএসআরআই এর বিজ্ঞানী, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং শ্রমিকদের পেনশনের আওতায় আনার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে বিএসআরআই এর সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী অচিরেই পেনশনের আওতাভুক্ত হবে।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ক্ষুধা এবং দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে বিএসআরআই নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতেও চিনিশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তায়, পুষ্টি নিরাপত্তায় এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে অসামান্য ভূমিকা রাখবে এটা আশা করাই যায়। তবে চিনিশস্য সম্প্রসারণ ও গবেষণার মান উন্নয়নে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়সহ অধিনস্ত অধিদপ্তগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।