এ চিঠির গায়ে কোন খাম নেই, নেই কোন সরকারী ষ্ট্যাম্প, তাই কোন ডাকবাক্সে ফেলে আসা গেলোনা। তাকেই লেখা আমার এই চিরকুট, যিনি ডানা ভাঙ্গা এক শালিকের কাছে হৃদয়ের দাবী রেখেছিলেন। প্রিয় বন্ধুকে বলেছিলেন আগুনের কথা। আর বাড়ীতে ফিরেনি কোন এক অভিমানে, নির্দিষ্ট কোন বাড়ীই নেই যাঁর তাঁর জন্য রুদ্র রেখে গেছে এক মস্তবড় খোলা আকাশ।
এই চিঠি তেমনই একজন আকাশ পুত্রকে লেখা।
যেদিন খবর এলো তুমি নেই। অসংখ্য মানুষ যারা হৃদয়ে বাবুই পাখির মত তোমার জন্য গড়েছিলো এক নিপুন ভালোবাসার ঘর, সেইসব ঘরে বেনো জলের মত ঢুকে গেলো কান্না। তুমি ছিলে সেদিন হিম ঘরে আর আমি ছিলাম একটা কান্না ভেজা সকালের ভিতর। এ কান্না ভেজা সকাল আমার ভালো লাগেনি।
হে প্রিয় আউলা চুলের সুপুরুষ আপনি জানেন কি? আপনার গানে আমার নাগরিক রঙ্গীন জীবনে আউলা বাতাস খেলে। বহমান এ জীবনে আপনাকে মনে পড়ে প্রায়ই। এই পাথুরে শহরে যখন কেউ দুঃখ দেয়, আপনাকে মনে পড়ে। চেনা মানুষগুলো যখন ভিষণ ভাবে কাঁদায় আপনাকে তখন খুব মনে পড়ে।
বুক জুড়ে এই বিজন শহর/ হাহা শূন্য আকাশ কাঁপাও / আকাশ ঘিরে শঙ্খচিলের / শরীর চেরা কান্না থামাও।
সঞ্জীব’দা চোখটা এতো পোড়ায় কেন? প্রচন্ড অভিমানে আপনাকে মনে পড়ে। প্রচন্ড রকম সর্বহারা জীবনের বাঁকে আপনাকে মনে পড়ে। গাইতে হয় আপনাকে, সেইসব কথা শব্দকে, যেগুলো জীবনের কাছ থেকে সুনিপুণ ভাবে তুলে এনেছিলেন। আর আমাকে দেখালেন দেখ, জীবনের এইসব দ্রোহ- কষ্ট মান অভিমানের কালগুলোকে দেখ। আপনার শব্দগুলো সময়ের দেয়ালে পেরেক হয়ে ফুটে আছে লাল রক্ত জবার মত।
আজ একটা গোপন কথা বলে ফেলি সঞ্জীব’ দা যেসব কষ্টের কথা বলতে লজ্জা হয়, অস্বস্তি লাগে, সেইসব কথা অনায়াসে গুনগুন বলে যাই আপনার মাঝে। এই শহর ;-নাগরিক শহর আপনাকে শুধু গান হিসেবেই জানে, ওদের কাছে শুধুই গান,আমার আরও অনেক কিছু । ঠিক যেমন ওদের কাছে আপনি শুধুই গায়ক কিন্তু আমার কাছে এক মেঘ আবেগ আর রহস্যময় একটা মস্তবড় আকাশ। যতদৃর দৃষ্টি যায় তার শেষ সিমানায় তুমি দাড়িয়ে আছো।
ভালো থাকবেন দাদা। আমি ভালো নেই, ভালো থাকার কিছু নেই।
— ইতি আপনার অযোগ্য এক ভক্ত – নিশান।
পৃথিবীতে কিছু অভিমানী মানুষ এসেছিলেন অল্প কিছু দিনের জন্য । তাদের সৃজনী ক্ষমতা এবং সমুদ্রসম মন আশপাশের মানুষের হৃদয়কে আন্দলিত করে অবিরাম । আমরা কেউ কেউ সে সব মহাপুরুষদের সংস্পর্শ পেয়েছে কেউ পাইনি । এমন একজন প্রচার বিমুখ মানুষ ছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী । পেশায় সাংবাদিক হলেও আমরা মূলত তাঁকে চিনি একজন মহান গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে। তাঁর গায়কি ছিলো অসাধারণ । রাজনীতি সচেতন ও অকুতভয় দেশ প্রেমিক মানুষটি তাঁর গানে যেমন দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন,তেমনি উপহার দিয়েছেন সবচেয়ে আবেগী ও হৃদয়স্পর্শী প্রেমের গান । সাদাসিদে ও সব সময় হাসিখুশী থাকা সঞ্জীব মাঝে মাঝে হয়ে যেতেন মারাত্মক বিদ্রোহী । যাঁর হাতে হারমোনিয়াম এলে নতুন সুরের জন্ম হতো সেই হাত ঘুষ নিতে দেখে ট্রাফিক পুলিশের গায়ে উঠতেও দ্বিধা করতো না । আবেগী এই মানুষটা মাঝে মাঝে চলে যেতেন বুড়ি গঙ্গায় । সারা দিন নৌকোয় করে ভেসে বেড়াতেন আর কোন এক পার্বতীর জন্যে কেঁদে বুক ভাসাতেন । সন্ধ্যায় ফিরতেন নতুন এক গান পকেটে করে ।
একজন সঞ্জীব চৌধুরী একজন নতুন কবির জনক । তাঁর জন্য একটি কবি সত্তা জন্ম নেয় ।
সঞ্জীব চৌধুরীর কণ্ঠে জনপ্রিয়তা পাওয়া গানগুলোর মধ্যে রয়েছে-
গাড়ি চলে না, বায়োস্কোপ, আমি তোমাকেই বলে দেবো, কোন মেস্তিরি বানাইয়াছে নাও, আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ, সাদা ময়লা রঙিলা পালে, কথা বলবো না, এই নষ্ট শহরে, রিকশা, চোখটা এতো পোড়ায় কেন প্রভৃতি। গায়কীর তুলনায় সঞ্জীবের লেখা ও সুরের প্রশংসা ছিল বেশি। কারণ তার রচিত গান আর সৃষ্ট সুর অন্যদের থেকে একদমই আলাদা ছিল। একটা মন মাতানো আবহ ছিল সেসব সুরে।
বিষন্নতার খেরোখাতা থেকে উঠে আসে স্বপ্ন-সম্ভাবনার বার্তা। স্বপ্ন খেলা করে সঞ্জীবের ঢিলেঢালা শার্টে, অবিন্যস্ত চুলে। পুরুষ্ঠ গোঁফের আড়াল থেকে ঠিকরে বের হয় মহাকালের স্টেটমেন্ট- প্রেম থেকে দ্রোহ, বিচ্ছিন্নতা থেকে জমায়েত। তাঁর গান তাই হয়ে ওঠে সময়ের আশ্চর্য দলিল।
— জাহিদ হাসান নিশান।