মার্চ মাস বাঙালি জাতির জীবনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সময়। এই মাসে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি জাতীয় দিবস। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। ১৭ই মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস। এরকম ঘটনা খুব একটা পরিলক্ষিত হয় না বিশ্বের কোনো দেশেই। এটাই মার্চ মাসের বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। আমরা সাধারণত ২৬ শে মার্চ দিনটিকেই বেশি স্মরণ ও গুরুত্ব দিয়ে থাকি। কিন্তু জাতি হিসেবে আমাদেরকে তিনটি দিবসই ঘটা করে উদযাপন না করলে নয়। এই গৌরবময় তিনটি দিবসই বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য এবং শিক্ষামূলক। এদের প্রকৃত ইতিহাস আমাদের সকলের জানা অত্যন্ত জরুরি। যদি বিদেশি কোনো নাগরিক আমাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, ৭ই মার্চ জাতীয় দিবস কেন ? কী ঘটেছিল এই দিনে ? আমরা যদি সঠিক উত্তর দিতে না পারি তাহলে লজ্জার সীমা থাকবেনা। তাই আমাদের প্রত্যেককেই জাতীয় জীবনের বিশেষ দিনগুলো সম্পর্কে নির্ভুল তথ্য জেনে রাখতে হবে। এখানে ব্যক্তিগত আবেগ এবং শ্রদ্ধামিশ্রিত থাকলেও নিরপেক্ষ ইতিহাস শিক্ষার ক্ষেত্রে মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এই বিষয়ে দলীয়, ব্যক্তিস্বার্থ ও পক্ষ পাতিত্বের কোনো সুযোগ নেই। কারণ এগুলো ঐতিহাসিক ঘটনা যা জাতীয় জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত।
তেমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন ১৭ই মার্চ। এই দিনটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান নেতা এবং স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। ১৯২০ সালের এই দিনে তিনি ফরিদপুরের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন। কেন আমাদের এই মানুষটির জন্মদিন উদযাপন না করলে নয় ? কারণ তিনি সাধারণ মানুষ ছিলেন না । সাধারণ রাজনৈতিক নেতাও ছিলেন না । শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন শত-শত বছরের বহির্দেশীয় শাসকদের দ্বারা শাসিত, পরাধীন বাঙালি জাতির প্রথম মুক্তিদাতা। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বেই বাংলাদেশ শোষক পাকিস্তানের দখলদারিত্ব থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছিল—যে স্বাধীনতার জন্য বাঙালিরা কয়েকশ’ বছর ধরে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং ক্রমাগত সংগ্রাম করে এসেছে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।
তাঁর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিনি স্পষ্টতই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, রাজনীতির বুলি আউড়িয়ে স্বাধীনতা লাভ করা যায় না তার সঙ্গে প্রয়োজন সশস্ত্র লড়াইও। ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় গোপনে গিয়েছিলেন তাঁর আদর্শ নেতা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর মতোই বহির্বিশ্ব থেকে চাপ সৃষ্টি করে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে পরাধীন মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য। যদিও বা তা সফল হয়নি । ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তাঁর প্রস্তাব বা আবেদন গ্রহণ করেননি। এই ঘটনা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (১৯৬৮) নামে পরিচিত। কিন্তু তিনি মোটেই হতাশ হননি। সেই মামলায় তিনি লড়েছেন এবং জয়ী হয়েছেন। বাঙালির স্বাধীনতার জন্য তিনি মনে প্রাণে অটল ছিলেন।
একটা বিষয় খুবই পরিষ্কার যে, ভারত বিভাগের পর থেকেই তিনি মুসলিম লীগ ত্যাগ করেছিলেন। তিনি সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন হিন্দু-মুসলমান দ্বিজাতি তত্ত্বের ধুয়া তুলে ভারত ভাগ ছিল মস্ত বড় ভুল। তখন কার অগ্রজ নেতাদের মতো শেখ মুজিবুর রহমানও স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছিলেন যে, মুসলিম লীগ নেতা পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে চরম হঠকারিতা করেছিলেন । কাজেই শেখ মুজিব পশ্চাৎপদ, রক্ষণশীল ও কুসংস্কারে নিমজ্জিত মুসলিম লীগ ত্যাগ করে উদারমনস্ক নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি, মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে মনোনিবেশ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি ৩৩ বছর বয়সে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পূর্ব বাংলা আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন জাতিকে । মাত্র ৫৫ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি কিন্তু ঘটনা বহুল তাঁর জীবন। শুধু এটুকুই বলতে হয়, তিনি রাজনৈতিকভাবে বিচক্ষণ ছিলেন ঠিকই মানসিকভাবে ছিলেন বাংলার জল কাদা দিয়ে তৈরি নরম চরিত্রের মানুষ। তাঁর মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনে সেই ছাপ পড়েছিল সত্যি, তাই বলে তাঁকে সপরিবারে হত্যা করার কোনো পটভূমি বা কারণ ছিলনা । রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর শাসনামল সফলতা ও ব্যর্থতা দুই-ই ছিল। তিনি ভগবান ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানুষ। উল্লেখ করতে হয় যে, স্বাধীনতার পর বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতা বিরাজ করে থাকে কিছু কালের জন্য। তখন বড় বেশি প্রয়োজন হয় সরকারকে প্রভাবশালী নাগরিকদের নিঃস্বার্থ সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান। কিন্তু নিদারুণ দুঃখ জনক হলেও সত্যি যে, বঙ্গবন্ধু সরকারের ক্ষেত্রে তা হয়নি। এটা সত্যি দুর্ভাগ্য যে, আমরা একবারও ভাবিনি যে, যে মানুষটা আমাদের আরাধ্য স্বাধীনতা এনে দিলেন তার পর আমাদেরই উচিৎ ছিল স্ব স্ব ক্ষেত্রে দেশ গঠনে ঝাঁপিয়ে পড়া । কেননা দেশটা তো আমাদের নিজেদেরই। এই দেশাত্ববোধ তথা জাতীয়তাবোধ যত টুকু ছিল আমাদের তাও তাঁকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে গেছে। জাতি নেতৃত্বহীন হয়েছে, দিক শূন্য বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েছিল দীর্ঘ বছর। কিন্তু বাঙালির সৌভাগ্য যে, ছলে-বলে-কৌশলে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা লক্ষ্যহীন দেশ ও জাতিকে টেনে এনে উন্নয়নের সড়কে দাঁড় করিয়েছেন। এখন আমাদের উচিত তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা এবং তাঁর অবর্তমানে দেশকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে নিঃস্বার্থ কাজের মধ্য দিয়ে ক্রমশ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। স্বদেশ তথা মাতৃভূমি আমাদের সকলের শেষ আশ্রয়।
এটাও সত্যি যে, বঙ্গবন্ধু যতটুকু করেছেন দেশ ও জাতির জন্য ততটুকুই ছিল তাঁর ক্ষমতা এবং বাঁধা সময়। ইতিহাস তাঁকে সেই টুকু দিয়েই সুবিচার করবে আর সেটা এশিয়া মহাদেশের সিংহ হৃদয় নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবেই চিরস্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত থাকবেন। সুতরাং আজ না মানলেও বুদ্ধিমান সচেতন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাঁকে ঠিকই মূল্যায়ন করবে, উদযাপিত হবে ঘরে ঘরে ১৭ই মার্চ এই বাঙালি মহানায়কের জন্ম দিবসটি । ঐতিহাসিক ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসের সঙ্গেও তাঁর রয়েছে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, যা কিছুতেই ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। তাঁর প্রদত্ত ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়েছে প্রধান বিরোধী দল। সত্যকে স্বীকার করে নিয়ে সম্মান প্রদর্শন করা মানবিক গুণের বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং ৭ , ১৭ এবং ২৬ শে মার্চ আমাদের বাঙালি জীবনে গৌরব, অহংকার এবং অগ্রগামিতার প্রতীক স্বরূপ তিনটি দিবস। দেশ থেকে বেরিয়ে বিদেশের যেখানেই যাই আমরা যেন বুক ফুলিয়ে বলতে পারি: মহান মার্চ মাস মানেই বাংলাদেশ। যদি প্রতিপক্ষ জিজ্ঞেস করে“ কেন”, তাহলে যেন যথার্থ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে পারি। তাই, আপনার শিশুকে পরিবারেই এই তিনটি দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে শিক্ষাদিন।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক