শুনতে পাই পৃথিবীতে আঠারো হাজার সৃষ্ট জীব। স্রষ্টার সৃষ্টির সেরা মানুষ। শারীরিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ এবং জৈবিকতার বহু রকমের মিল বিভিন্ন প্রজাতির জীবের সঙ্গে রয়েছে মানুষের। অমিলও আছে। সম্ভব পৃথিবীতে একমাত্র মানুষ চিৎ হয়ে ঘুমায়, উচ্চস্বরে হাসে, সুখ ও দুঃখের অনুভূতি বহুমাত্রিক ভঙ্গিতে অপরের কাছে প্রকাশ করতে পারে। একমাত্র মানুষই জেগে- ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে। সৃষ্টিশীল চিন্তাশক্তি আছে, মূল্যবোধ ও যুক্তিবিচার সম্পন্ন প্রাণি মানুষই। কিন্তু জীবজগতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের শ্রেষ্ঠ প্রামানিক ও অনন্য নিদর্শন তার বাচনিক সক্ষমতা- ভাষা। অন্যান্য প্রাণীর বাকযন্ত্র থাকলেও বাগার্থ নেই। শুধুমাত্র মানুষ অর্থবহ ধ্বনি সহযোগে অন্তরের গভীরের অনূভবকেও বাহিরের কাছে প্রকাশ করতে পারে। অর্থাৎ একমাত্র মানুষেরই আছে ভাব প্রকাশের উৎকৃষ্ট মাধ্যমে ” ভাষা। ”
পবিত্র কোরআনে সূরা ‘ আর রহমান ‘ এর তৃতীয় ও চতুর্থ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন-“খ্বলাক্বল ঈনছান : য়াল্লামাহুল বাঈয়ান ” (সৃষ্টি করেছেন মানুষ : তাদের দিয়েছেন বাচনিক শিক্ষা)। অর্থাৎ মানুষের ভাব ও ভাবনা প্রকাশে বাকযন্ত্রের মাধ্যমে মুখনিঃসৃত অর্থবহ ধ্বনি উচ্চারণে মানুষের সক্ষমতা স্রষ্টার বিশেষ অনুকম্পা যা কেবলই মানুষকে বিশেষত্ব দান করেছে, শ্রেষ্ঠ করেছে, মহামান্বিত করেছে। তাই শুধু মানবিক ও পাশবিক বৃত্তিতে ও আঙ্গিক ভিন্নতায় নয় বরং ভাষার জন্য, বাচনিক সক্ষমতার জন্যই মানুষ বিশেষ, অন্যেরা নির্বিশেষ। একজন মানুষ, যে মূক – শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ কিন্তু যার বাকযন্ত্র নিষ্ক্রিয় তার জীবনের মূল্য কি? তাহলে কথার কত দাম! অথচ আমরা রক্তে কেনা ভাষাকে কতটুকু মর্যাদাবান করার প্রয়াস পাই? বাংলাদেশে বহু উপজাতিদের বাস। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। তাদের ভাষা স্থানিক ও পারিবারিক পরিমন্ডলেই সীমাবদ্ধ। এদের মধ্যে কোনো কোনো ভাষার নিজস্ব বর্ণমালাও রয়েছে কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ও বিকাশের ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি বলে এবং সাহিত্যে প্রয়োগে উপেক্ষিত হয়েছে বলে সে সকল ভাষাসম্পদ বিলুপ্ত প্রায়।
বাংলাদেশে অঞ্চলভেদে ভাষার প্রায়গিক ভিন্নতা রয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বোধ ও অভ্যাস, পরম্পরা লালন, কিছু ক্ষেত্রে মাটি ও জলবায়ুর ভিন্ন বৈশিষ্টের কারনে এবং তজ্জন্য দৈহিক গঠনরুপ কিছুটা ভিন্ন বিধায় আঞ্চলিক ভাষার শাব্দিক ব্যবহার, উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যরুপও আলাদা। এই ভিন্ন স্বাদের কথামালায় সাহিত্য চর্চা হতে পারে কিন্তু সেই সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চান না উঁচু দরের সাহিত্যিকেরা কারণ পাঠক মহলে কাটতি কম হবার আশংকা! কিন্তু আমার মনে হয় তাঁরা এক আধবার ঝুঁকি নিতে পারেন এবং তাঁদের শঙ্কা- সফলতায় পরিনত হতে পারে। গ্রামীণ জনজীবন সমাজ ও সংস্কৃতি সাহিত্যের উপজীব্য হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় বলে মনে করতেন প্রমথ চৌধুরী। নাকি তাঁরাও ভূগছেন বীরবলী উন্নাসিকতায় ? অলংকার শিল্পীরা খাঁটি সোনার সাথে খাদ মিশিয়ে অনেক উঁচু দরের আকর্ষনীয় অলংকার তৈরি করেন। তা সাহিত্যেও সম্ভব।
আমাদের নিত্য গ্রামীণ জনজীবন- জীবনাচার, দৈনন্দিন অভ্যাস ও সংস্কৃতি নিয়েও সাহিত্য চর্চা সম্ভব। তাতে বাংলা লৌকিক ভাষাশ্বৈর্যের সমৃদ্ধি ঘটে এবং শ্রীবৃদ্ধি হয়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মাতৃভাষার প্রতি অপ্রীতি ও অবজ্ঞা ছিল একসময় (কাব্য লক্ষী স্বপ্নে আদেশ করে ফিরিয়ে এনেছেন স্বদেশী ভাষায়)! স্বার্থক বাংলা উপন্যাসের জনক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ধর্মীয় পক্ষপাত প্রদর্শন করেছেন সাহিত্যে, প্রমথ চৌধুরী উন্নাসিকতা প্রকাশ করেছেন গ্রামীণ জীবন চরিত নিয়ে। অথচ পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের “নক্সী কাঁথার মাঠ” সোজন বাদিয়ার ঘাট” কী অনন্য উচ্চতায় আসীন! তাঁর কবর কবিতায়-
” এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে
গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনা মুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে–”
পাঠকের চোখে জল এনে দেয়। আমাদের গ্রামীণ জনজীবনের নিত্য ব্যবহার্য আথাল, মাথাল, গোয়াল, ডানকানা মাছ, এমনকি সামান্য ‘ঘুটে’কেও তিনি অসামান্য করে তুলেছেন তাঁর কবিতায়। আমাদের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় নাটক “নূরুল দীনের সারা জীবন” আঞ্চলিকতার প্রভাবকে অতিক্রম করে সাহিত্যিক আবেদন অর্জনে সক্ষম হয়েছে। আর ঐ একটি আহ্বান, একটি স্লোগান ” কোনঠে বাহে জাগো সবায়—-। এটি শুধু সংলাপ নয়, একটি আন্দোলনের মশাল , একটি ইতিহাস। আর তাঁর “পরানের গহীন ভিতর” কবিতা গুচ্ছে আঞ্চলিক শব্দ অনবদ্য ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। নাট্য সাহিত্যের বরপুত্র সেলিম আল দীন” হাত সদাই” তে ব্যবহার করেছেন গ্রামীণ শব্দ সম্ভার কিন্তু তা স্বার্থকতার কতক্ষানি উচ্চতায় অধিষ্ঠিত যে মঞ্চায়নে বহু দর্শক উপস্থিতিই প্রমাণ করে।
এছাড়াও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের” চিলে কোঠার সেপাই” ও “খোয়াব নামা” বগুড়ার স্থানিক ভাষায় অনন্য সৃষ্টি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ধ্রুপদী উপন্যাস লালসালু- র ” আপনারা জাহেল, বেআলেম, আনপাড়াহ্, একটা মোদাচ্ছির পীরের মাজার এভাবে ফেলি রাখছেন?” মজিদ, খালেক ব্যাপারী, হাসুনির মা, রহিমা আমেনা চরিত্রগুলো বাংলার গ্রাম্য এবং আরবি, ফারসি, উর্দূ ভাষার শব্দ উচ্চারণ করলেও তা আর্ন্তজাতিক সাহিত্য হিসেবে নন্দিত। লালসালু উপন্যাস ১৯৬৭ সালে ইংরেজি ভাষায় এবং কলিমুল্লাহ উর্দু ভাষায়, আ্যান-মারি-থিবো ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। বলা বাঞ্ছনীয়, ১৯৬১ সালে এ মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের জন্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার পান।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ” পদ্মা নদীর মাঝি” গ্রামীণ ধীবর শ্রেণির মানুষের জীবন গাঁথা নিয়ে রচিত বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। নুকূল্যা কি লো হারামজাদি, জ্যাঠা কইবার পার না ‘ বাবা নিজের মেয়েকে এভাবে ভদ্রতা শেখানোর দৃষ্টান্ত জেলে পল্লীতেই চলে। কারণ ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে ভদ্রপল্লীতে জেলে পাড়ায় তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় না! ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হবার পর এ উপন্যাস ভারতের একাধিক প্রাদেশিক ভাষা সহ ইংরেজি, চেক, হাঙ্গেরিয়ান, লিথুয়ানিয়ান,সুইডিশ, রুশ, নরওয়েজিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তারা শংকরের “হাঁসুলী বাঁকের ইতিকথা” অদ্বৈত মল্লবর্মণের “তিতাস একটি নদীর নাম” শামসুদ্দিন আবুল কালামের “কাশ বনের কন্যা” ও “সমূদ্র বাসর ” হাসান আজিজুল হকের “আগুন পাখি” পুরোটাই খাঁটি আঞ্চলিক ভাষায় লেখা। তাহলে বর্তমানে কেন এমন স্বার্থক সাহিত্য আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হচ্ছে না। ঔপনিবেশিকতার প্রভাব? ঠিক তাই। আমরা শেকড়ের, রক্ত এবং অস্তিত্বের বন্ধনকে ছিন্ন করার বহুধা ঐতিহাসিক নিদর্শন স্থাপন করেছি। আমরা যে বাঙালি! উফ্, গাঁও -গেরাম? কী লজ্জা! কী লজ্জা!
আমাদের নোয়াখালী, লক্ষীপুর, ফেনী জেলার আঞ্চলিক ভাষা তো ঐ জেলা বাসীর কাছে মাতৃস্তন স্বরুপ। আমাদের বাংলা ভাষার প্রানৈশ্বর্য বিভিন্ন অঞ্চলের আদিশব্দ, গ্রামাঞ্চলের লেখাপড়া না জানা মানুষের নিত্য ব্যবহৃত শব্দ, পথকবি- লোক কবিদের হৃদয়ের স্পন্দন ঐ শব্দ সম্ভারেই অর্ন্তলীন। ইংরেজি অর্থনৈতিক ও বিশ্ব যোগাযোগের ভাষা আর বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা, অস্তিত্বের ভাষা। তাই বৈচিত্রময় আমাদের ভাষার সকল রুপবৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের বিদগ্ধ সাহিত্যিকদের, লেখকদের এবং বাংলা একাডেমীর। নইলে সংস্কৃত ভাষার মতো বাংলাও বৈচিত্র সংকটে পড়ার আশঙ্কামুক্ত থাকবে না বলে মনে করি। যে দেশের আশি শতাংশ মানুষের জন্ম গ্রামে এবং তাদের পিতামহদের পঁচাত্তর শতাংশ এবং পিতা-মাতার ন্যূনপক্ষে পঁয়তাল্লিশ শতাংশ স্কুলের চৌকাঠ মাড়ায়নি তাদের উত্তরসূরী যদি ভাদাল, বোহরি , ভাট্যেলা, তপন, আঁদল, মলন, না চেনে তাহলে কাকের কোকিল হবার শখ বৈ নয়। অন্যথা এই আত্মপ্রবঞ্চনার অন্য নাম- রুচির দূর্ভিক্ষ!—- সমাপ্ত
লেখক : অধ্যক্ষ- মোহাম্মদ আব্দুল বাছেত (বাচ্চু)
সাতবাড়ীয়া ডিগ্রি কলেজ, সুজানগর, পাবনা।
ই-মেইল: baset4971@gmail.com
ফেসবুক পেইজ: https://www.facebook.com/groups/215504006789824