যতখানি মনে পড়ে ১৯৯১ সালের শেষ কি ১৯৯২ সালের প্রথম দিকে আমি তখন আসাহি র্যাপিড প্রিন্টিং কোম্পানিতে প্রবেশ করেছি সরকারি রিক্রুট এজেন্সির মাধ্যমে। রেজিষ্ট্রি করার পর এক মাসের মধ্যেই চাকরিটি হয়ে গেল। কম্পিউটারে অফসেট কালার সেপারেশনের কাজ। অসম্ভব হাই কোয়ালিটি ছাপার জন্য এই কোম্পানিটি টোকিওতে খুবই বিখ্যাত ছিল। কাপাল ভালো যা শিখতে চেয়েছিলাম তাই ঈশ্বর জুটিয়ে দিলেন। আসলে মন থেকে কামনা করলে ঈশ্বর দেবেন না কেন?
কত বিচিত্র ডিজাইনের কাজ: ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ, ক্যালেন্ডার, মোটর গাড়ির জন্য ৫-৬ কালারের ক্যাটালগ, গ্রন্থের প্রচ্ছদ, কালার ন্যুড ফটো অ্যালবাম, পোস্টার, সিডির কভার কতকি! এখানেই হাতেকড়ি আমার অফসেট প্রিন্টিং এর। অবশ্য এর আগে বন্ধুবর গ্রাফিক ডিজাইনার হিরোতা সান শিখিয়ে দিয়েছিল কীভাবে ম্যাগাজিন, পত্রিকা, গ্রন্থ, সিডির কভার ডিজাইন ও লেআউট করতে হয়। কী চমৎকার কাজই না জানত ছেলেটি!
একদিন অনুজপ্রতিম বন্ধু রেজা সেলিম ফোন করে বলল, প্রবীরদা, একটা কাজ করে দিতে হয়। আপনি তো ‘মানচিত্র’ কাগজ প্রকাশ করবেন তাই খুব ব্যস্ত জানি লেআউট নিয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে কাজটা করে দিন।
সেলিম কুমিল্লার ছেলে তাও আবার এলাকার ছোটভাই। আবদার বলি, অনুরোধ বলি ফেলে দেয়া সম্ভব নয়। বললাম, কী কাজ বলে ফ্যাল্?
—আমার এক পরিচিত বড়ভাই, এনামভাই নিউইয়র্ক থেকে এসেছেন একটি সিডি বের করবেন বেবী নাজনীনের।
আমি বললাম, শাকিলা জাফরের নাম জানি, কিন্তু বেবী নাজনীনকে তো চিনলাম না। কিন্তু আমাকে কী করতে হবে?
—আপনাকে সিডির কভারটি করে দিতে হবে ডিজাইন এবং ছাপাসহ। বাংলাদেশে এখনো সিডির কাজ শুরু হয়নি। সিডির কভার নাকি স্পেশাল ফরমেটে ছাপা হয়। গান উনি সিডিতে রেকর্ড করেছেন ব্যাংককে, কিন্তু ব্যাংককেও সিডির প্রচ্ছদের কাজ শুরু হয়নি এখনো।
আমি তখন খুব ব্যস্ত, একে তো চাকরি, তারপর পত্রিকার কাজ চলছে, এছাড়া বঙ্গবন্ধু পরিষদের জাপান শাখা গঠনের পর তার জন্যও কাজ করতে হচ্ছে। এই সময় এই কাজ কতখানি করতে পারবো! বললাম, ঠিক আছে সন্ধের পর তোর বাসায় যাবো। খানাপিনা রেডি রাখিস।
সে হেসে বলল, সে কথা আপনাকে ভাবতে হবে না সব রেডি থাকবে। কাজটা করে দিলে আমার মানসম্মান রক্ষা হয় প্রবীরদা!
সন্ধের পর এনাম সাহেব সঙ্গে সাগর নামে একটি ছেলেকে নিয়ে এলেন। খানাপিনা করতে করতে আলাপ চলল। সেলিমের হাতের তৈরি চিরসুস্বাদু খাসির গোস্ত, মুরগির রোস্ট। খুব জমে গেল আসর। দেশ নিয়েও নানা কথা।
এনাম সাহেব মূলত গানবাজার ব্যবসা করেন বাংলাদেশ ও আমেরিকায়। দারুণ স্মার্ট লোক বুঝতে কষ্ট হলো না। বেশ মালপানি নিয়ে দেশ-বিদেশ ঘোরেন। তিনি বেবী নাজনীনের ছবি, গানের লিস্ট দিলেন। বললেন, প্রবীরদা, এটাই হবে বাংলাদেশের প্রথম সিডি। কাজেই বুঝতে পারছেন আপনি হবেন প্রথম বাংলা সিডি কভার ডিজাইনার!
সত্যবাবুর প্রভাবে আমি তখন আকাশে উড়ছি! তবুও অবাক হয়ে বললাম, তাই নাকি! বাংলাদেশে এখনো সিডি চালু হয়নি!
—না না কোত্থেকে হবে! এর প্রযুক্তি সবকিছুই তো আলাদা। এত ছোট্ট রেকর্ড, তার কেইসটাও ভিন্ন, কভার ছাপানোর ফরমেট সম্পুর্ণ আলাদা—এসব বাংলাদেশে কে করবে? এশিয়ায় এই প্রযুক্তি এখন মাত্র চালু হয়েছে জাপানে। জাপানে সিডির কাজ খুব ভালো হয় নিউইয়র্কে শোনার পর এখানে চলে এলাম। আফটার অল সিডি ডেভেলপ করেছে জাপানের সোনি কোম্পানি। একটা বিশ্বজয়ী কাণ্ড! কভার, অ্যালবাম মুদ্রণের বিষয়টিও বড় বড় ডিজাইন ও প্রিন্টিং কোম্পানি উদ্ভাবন করেছে সেই অনুযায়ী। মারাত্মক এক বিপ্লব সাধন করেছে সোনি। ভবিষ্যৎ বাণিজ্য চিন্তাই করা যায় না! দাদা, সত্যি এই বেটেখাটো মানুষগুলোর ব্রেইনই আলাদা!
আমি বললাম, ঠিক আছে সাত দিন সময় দিন। করে দিচ্ছি। আমার ডিজাইনের পয়সা লাগবে না। খুব যে আহামরি ডিজাইন হবে তা বলবো না, কারণ সত্যি কথা বলতে কী একটি পত্রিকার কাজ চলছে সেটা নিয়ে ব্যস্ত সেলিম জানে, সেও জড়িত। জাপানের প্রথম বাংলা কাগজ প্রকাশ করতে যাচ্ছি এ টু জেড অ্যাপল ম্যাকিনটস কম্পিউটারে। আমার পারিশ্রমিক লাগবে না এ রকম একটি শুভকাজে সহযোগিতা করতে চাই। তবে ছাপার খরচ যা লাগে দেবেন।
এনাম সাহেব রাজি হলেন। পাঁচ দিনের মাথায় একটা ডিজাইন দাঁড় করিয়ে নিলাম। ছবি মাত্র দু-তিনটি তার ওপর খুবই সাধারণ ছবি এসব দিয়ে ডিজাইন করা যায় না। ডিজাইন দেখে খুব খুশি হলেন এনাম ও সাগর সাহেব, ব্যবসায়ী জুটি। দুদিন পরেই পাঁচ হাজার কপি কভার ছাপিয়ে দিলাম আমার কোম্পানিতে ম্যানেজার চিবা সানকে অনুরোধ করে। এত ছোট কাজের অর্ডার কোম্পানি নেয়ার প্রশ্নই আসে না কিন্তু করে দিল আমার কারণে। কাজ দেখে এনামভাই জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে বিয়ারের গ্লাসে বাড়ি মারলেন সন্ধেবেলা সেলিমের বাসায়। প্রচ্ছদ ঘুরেফিরে বার বার দেখছিলেন আর বলছিলেন, কী দারুণ হয়েছে ডিজাইন! কী দামি কাগজ আর উজ্জ্বল ছাপা! মাইরি, তুলনা মেলা ভার! সত্যি প্রবীরদা, জাপানে প্রিন্টিং এর কাজ শিখেছেন আপনি বটে!
মনে মনে হেসে বললাম, এই এক পুঁচকে কাজ দেখে বাঙালি আঁতকে ওঠে, এ জাতির ভবিষ্যৎ নেই!
যাকগে, এর কয়েক মাস পর এনাম সাহেব আবার এলেন। বললেন, সিডি আমেরিকাতে সব বিক্রি হয়ে গেছে! সামান্য কিছু বাংলাদেশে কারণ সিডি প্লেয়ার নেই! তিনি এবার এলেন খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লার সিডি প্রকাশ করবেন বলে। তখন আমি ‘মানচিত্র’ পত্রিকা বের করেছি’, সেটা নিয়ে, বঙ্গবন্ধু পরিষদ নিয়ে খুবই ব্যস্ত। সামনে ১৫ই আগস্ট উপলক্ষে অনুষ্ঠান হবে, ঢাকা থেকে আসছেন বিচারপতি আবদুস সোবহান। অনুষ্ঠানের কিছু মুদ্রণের কাজও আমার হাতে। কিন্তু কী আর করা! রুনা লায়লা বলে কথা! বাংলাদেশের আন্তর্জজাতিক শিল্পী, তাঁর প্রথম গানের সিডির কভার আমাকে করতে হবে, এটা তো সম্মানজনক কাজ! একটা ইতিহাস! তাড়াহুড়োর মধ্যে আগের মতোই কাজ করে দিলাম আমার কোম্পানি থেকেই। এনাম সাহেব দ্রুত ফিরতে চান আমেরিকায়, জাপানে থাকলেই প্রচণ্ড খরচ!
আমাকে দুজন শিল্পীরই চারটি সিডি সৌজন্য হিসেবে দিয়েছিলেন। তবে, আসলেই জানি না এ দুটোই বাংলাদেশে প্রথম গানের সিডি কিনা? তখন তো শুধু টেপ ক্যাসেটেরই রাজত্ব। যাই হোক, দুটো কাজ করে দিতে পেরেছিলাম তাতেই আমি খুশি।
কিছু স্মৃতি মৃত্যুহীন যেমন বেবী নাজনীন ও রুনা লায়লার প্রথম সিডির কভারের ইতিহাস।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক
টোকিও ১৮.৩.২০২১