আমার এক সময়ের রাজনৈতিক জীবনের সাথী প্রিয় নাসিম ভাই আজ আর নেই, চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করছি । তাঁর দুঃখ কষ্টের সাথী ছিলাম আমি, হৃদয় বিধারক অনেক ঘটনাই আলোড়িত করছে আজ আমার মনকে ।
পাবনা জেলার স্বাধীনতাত্তোর ছাত্রলীগ, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা পরবর্তী ছাত্রলীগ, যুবলীগ, বাকশাল ও আওয়ামীলীগের রাজনীতি পথপরিক্রমায় আমি ও নাসিম ভাই ছিলাম এক ও অবিচ্ছেদ্য অস্তিত্ব। ১৯৭৫ এর ১৫ই আগষ্টে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের পর তিনি জীবন রক্ষার্তে চলে যান ভারতে। ভারত থাকাকালীন তাঁর পিতা জনাব মনসুর আলী সহ জাতীয় চার নেতাকে কারাগারের ভেতরে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা নির্মমভাবে হত্যা করে। আর আমি খুনি মোস্তাকের রোষানলের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হই। সেনা ও পুলিশ দ্বারা চরম দৈহিক নির্যাতনের শিকার হই।
তিন বছর কারাভোগের পর মুক্তি লাভের সাথেসাথেই কলাকাতা চলে যাই নাসিম ভাইকে দেখতে। সেখানে তাঁর সাথে কিছুদিন অবস্থান করে দুর্দিনের সাথী হই। আমি দেশে আসতে চাইলে তিনি তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ ভাবী ও কলাকাতায় জন্ম নেওয়া দ্বিতীয় পুত্র সন্তান তমালকে সাথে নিয়ে ঢাকায় পৌঁছে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। বাংলাদেশের পরিস্থিতি রিস্কি হওয়া সত্বেও আামি ও আমার স্ত্রী তাতে সহসাই রাজি হয়ে যাই। যদিও তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা আমাদের প্রতিকূলে ছিল। বেনাপোল সীমান্ত পার হয়ে আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নাসিম ভাইয়ের পরিবারকে ঢাকা নিয়ে আসি। কিছুদিন পরে নাসিম ভাই হূলিয়া মাথায় নিয়ে ঢাকা এসে গ্রেপ্তার হন। তখন জিয়ার শাসনামল ছিল। কারাগারে থাকার কিছুদিন পরেই তাঁকে আদালত কর্তৃক প্রদত্ব অর্থদন্ডের ২৫০০০/- টাকা আমরা পাবনা বাসিরা যোগাড় করে কোষাগারে জমা দিলেই তিনি কারামুক্ত হন। কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে তখন তিনি সক্রিয় হয়ে পড়েন এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার ছায়াতলে নিজগুনে জাতীয় নেতায় পরিনত হন। রাজনীতির আঁকেবাকে নির্যাতন ও অত্যাচারের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আমি জীবন রক্ষার্থে সক্রিয় রাজনীতির মাঠ হতে ১৯৮২ সনে বিদায় নেই। আমি তখন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক। পরে বিসিএস ক্যাডারে উত্তির্ন হয়ে আমি ও আমার স্ত্রী ড. রেবেকা সুলতানা জর্জ ও ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি করতে থাকি। মন পড়ে থাকে রাজনীতির মাঠে ।
১৯৯০ এ এরশাদ বিরোধী গনঅভ্যুত্থানের সময় আমি আইন মন্ত্রনালয়ে ও আমার স্ত্রী ভূমি মন্ত্রনালয়ে কর্মরত থাকাকালীন, কাকরাইল স্থ ভাড়াবাসায় হূলিয়া মাথায় নিয়ে একদিন নাসিম ভাই রাতে আমার বাসায় এসে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি ও আমার স্ত্রী উভয়ে সরকারি চাকুরে হওয়া স্বত্বেও পরিনতির কথা চিন্তা না করেই রাজি হয়ে যাই। পরে তিনি ৭ দিন সার্বক্ষনিক আমার বাসায় অবস্থান করেন। পাশেই থাকতেন কমিউনিস্ট নেতা কমরেড ফরহাদ । প্রতি রাতেই সেখানে চলত পুলিশের তান্ডব। আমরা রাতজেগে গভীর আতংকে নাসিম ভাইকে আগলে রেখে সময় পার করতাম । তাঁর প্রতি ভালবাসার কারনে আমরা কখনো চাকরির তোআক্কা করিনি । এমন আরো অনেক ঘটনা কালের সাক্খী আামি । আমি নাসিম ভাইয়ের দুঃসময়ের সাথী ছিলাম, সুসময়ে থাকার সুযোগ আমার হয়নি ।
মোহাম্মদ নাসিম বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের এক গৌরবোজ্জ্বল সৈনিক। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্হা ছিল তাঁর । জননেত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন তিনি একজন সহযোদ্ধাকে হারালেন। মোহাম্মদ নাসিম কর্মীবান্ধব মহৎ হৃদয়ের একজন দেশপ্রেমিক নেতা ছিলেন । তাঁর তুলনা শুধু তিনিই। তাঁর পরিবারের প্রতি আমার রইল গভীর সমবেদনা। আল্লাহ তাঁকে বেহেস্ত নসিব করুক, আমিন।
ছবি দুটি বঙ্গবন্ধুর সাথে আমিও নাসিম ভাইয়ের, একটি ১৯৭৪ সনে গনভবনে অপরটি ১৯৭৫ এ ধানমন্ডির ৩২ নং বঙ্গবন্ধু ভবনে ।
সাহাবুদ্দিন চুপ্পু : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও দুদকের সাবেক কমিশনার ।