১০১!?
চিন্তার কথা! এটা গতকালের (১৬ এপ্রিল ২০২১) হিসাব। কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা হয়তো আরো বাড়বে। কোন কোন পরিসংখ্যান সংস্থা আগাম ধারণা করছে যে মে মাসে দিনে ৯০০ পর্যন্ত লোক মারা যেতে পারে।
কী করতে পারে বাংলাদেশ?
আমার একটা ধারণা হচ্ছে, রিভার্স মোড বা উল্টো পন্থা অবলম্বন করলে কেমন হয়!
সমাজে সরকার, শিক্ষক এবং বাবা-মা বা অভিভাবক এরা হচ্ছে রেগুলেটরি বোর্ড বা নিয়ন্ত্রণকারী অংশ। আমার দীর্ঘ শিক্ষকতার জীবন থেকে এ অভিজ্ঞতা হয়েছে যে শিক্ষার্থীদের পড়তে বললে, সাধারণত পড়ে না, লিখতে বললে সাধারণত লেখে না, কিছু না বললেই বরঞ্চ পড়ে বা লেখে। বা পরীক্ষা আসলেই কিছুটা লেখাপড়া করে। বাবা-মা-দেরই প্রায় একই অবস্থা। বাবা-মা পড়তে বললে, সাধারণত সন্তানেরা পড়ে না, লিখতে বললে সাধারণত সন্তানেরা লেখে না, বরঞ্চ কিছু না বললেই বরঞ্চ সন্তানেরা লেখে বা পড়ে। ইংরেজিতে বলে, দ্য বেস্ট গভর্ননেন্স ইজ নন-গভর্ননেন্স—অর্থাৎ শাসনের অনুপস্থিতিই শাসন নিশ্চিত করে। অর্থাৎ, সাধারণভাবে মানুষ মাত্রই কর্তৃপক্ষীয় শাসন-না মানার চেতনা থেকে বড় হতে থাকে। সে সরকার মানতে চায় না, সে শিক্ষক মানতে চায় না (সামনাসামনি নয়, পেছনে), সে বাবা-মা মানতে চায় না। এই এ্যান্টি-ইনকামবেন্ট এ্যাটিচিউড লক ডাউন না মানার ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হচ্ছে। অনেকে বলছে এটা সচেতনতার অভাব। আমিও মনে করি, এটা ঠিকই সচেতনতার অভাব, তবে এটার ব্যাখ্যাটা হচ্ছে, মানুষ করোনাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে পুলিশকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে। সে ঘরের বাইরে কেন এসেছে সেটি পুলিশকে একটা মিথ্যা কথা বলে যখন সে পার পেয়ে যাচ্ছে, সে আত্মতৃপ্ত হচ্ছে, ভাবছে যে পুলিশকে কেমন ঠকালাম। কিন্তু প্রকারান্তরে সে যে নিজের ফুসফুসকে ঠকালো এ সচেতনতা তার মধ্যে আসছে না। বরঞ্চ, পুলিশকে চোখের সামনে না দেখলেই সে হয়তো আসল প্রতিদ্বন্দ্বীকে চিনতে পারবে।
তাই ভাবছি, এমন পরামর্শ দেওয়া যায় কী না যে লক ডাউন যেহেতু চরম অর্থনৈতিক সংকট বা জীবিকার প্রশ্নে সাধারণভাবে মানানো যাচ্ছে না তখন সব ধরনের লকডাউন তুলে দিলেই হয়। আমজনতা মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে দেখলে আপনাতেই ভয় পাবে, ও বাধ্য না হলে ঘর থেকে বের হবে না। (তবে, বাংলাদেশের মুখব্যাদানরত দারিদ্রের মুখে মানুষ বের হতে বাধ্য হবেই সেটি নিশ্চিত।) তারপরও গণমনস্তত্ত্ব করোনার সংক্রমণের চেয়েও ভয়াবহ। মানুষের মনে যদি একবার গেঁথে যায় এই ভীতি যে ঘর থেকে বের হলেই বিপদ, তা হলে আর পুলিশ লাগবে না, সে আর বের হবেই না, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তার যাই হোক না কেন। সংক্রমণ অনুসরণকারী সংস্থাগুলো বলছে, সপ্তাহ দুয়েক কোনভাবে লোক চলাচল বন্ধ রাখতে পারলেই সংক্রমণ ঠেকানো যাবে।
আবার, সংক্রমণ ঠেকানো বা জীবন বাঁচানো সরকার সহ স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর অবশ্যই নৈতিক দায়িত্ব, কিন্তু এটি তাদের সক্ষমতার দায়িত্ব নয়। কোন সরকারের পক্ষেই প্রত্যেক লোকের পেছনে পুলিশ নিয়োগ করা সম্ভব নয়, বা জনঘনত্বপূর্ণ দেশ বাংলাদেশে কারফিউ দিয়েও লোক ঠেকানো সম্ভব নয়। বস্তুত এটা কাম্যও নয়। ঠিক যেমন শিক্ষকের পক্ষে শিক্ষার্থীদের মানুষ করানো নৈতিক দায়িত্ব, কিন্তু তাঁর সক্ষমতাভিত্তিক দায়িত্ব নয়। শিক্ষার্থী পড়াশুনা করতে না চাইলে শিক্ষকের কিছু করার থাকে না। অনুরূপ বাবা-মা বা অভিভাবকের নৈতিক দায়িত্ব সন্তান মানুষ করা, কিন্তু সন্তান নিজে থেকে পড়াশুনা করতে না চাইলে, উদ্যমী না হলে, নেতিবাচক হলে, বাবা-মা’র সক্ষমতার সীমানাকে সে ছাড়িয়ে গেল, তখন বাবা-মা’র কিছুই করার থাকে না। মনে রাখতে হবে মানুষ মাত্রই নিজস্ব জিনবৈশিষ্ট্য দ্বারা পরিচালিত। এবং ১৪ বছর থেকেই তার মানসিক গঠনে নিজস্বতা ফুটে উঠতে শুরু করে। সেখানে মানা না মানার দ্বন্দ্বগুলো শুরু হতে থাকে।
সরকার এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো যেটি করতে পারেন আমার মনে হয়, সেটি হলো মাঠ পর্যায়ে পত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের আবশ্যকতার প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা না করে, ভারচুয়াল বা ডিজিটাল সম্প্রচারের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানোর দিকে যেতে পারেন। এখনও চলছে এ কাজগুলো, এগুলোকে আরো উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে হবে। এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নামাজ, প্রার্থনার সময় মাইক যোগে মানুষকে ঘর থেকে বের না হবার পরামর্শ ঘন ঘন দিতে হবে। আমি বলতে চাই যে, প্রত্যেক পূর্ণবয়ষ্ক মানুষ ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্বটা নিক। ওদেরকে আর শিশুর মতো জ্ঞান না করে, ওদের ওপরেই দায়িত্বটুকু ছেড়ে দেওয়া হোক। উল্টো পন্থা অবলম্বন করে দেখা যেতে পারে।
সরকারকে দেখতে হবে দরীদ্র জনগোষ্ঠী কাজবিহীন হয়ে পড়লে তারা যেন বেঁচে থাকার জন্য প্রণোদনা পান সেটি নিশ্চিত করা। আর, কম্যুনিটি হাসপাতালগুলোকে (থানা, এমনকি সম্ভব হলে ইউনিয়ন পর্যায়ে) দ্রুত করোনা-মোকাবেলার জন্য চিকিৎসা সামগ্রী আর চিকিৎসক দিয়ে পরিপূর্ণ করা। এই ব্যবস্থা একবার হয়ে গেলে ভবিষ্যতেও সারা দেশ জুড়ে চিকিসার মাঠ পর্যায়ে একটি শক্ত ভিত্তি দাঁড়িয়ে যাবে। আর সম্ভবত লাশ সৎকারের জায়গা বাড়াতে হবে ও সাথে সাথে সৎকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকবল বাড়াতে হবে, যেটির নিম্নতম রেখা হবে—বেওয়ারিশ লাশ যেন রাস্তায় পড়ে না থাকে।
১৭ এপ্রিল ২০২১
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সুবর্ণ জয়ন্তীর দিনে সবাইকে শুভেচ্ছা।