পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরে বাংলাদেশের প্রথম পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। এই রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে উত্তরণে মিশ্র জ্বালানী নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা উন্নয়নে শক্তিশালী প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে। রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্ভরযোগ্য ও নিরবিচ্ছিন্নভাবে এবং অন্যান্য বিকল্প শক্তির উৎস অপেক্ষা সাশ্রয়ী মূল্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।পরমাণু শক্তি প্রকল্পে দুটি ইউনিট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যার প্রাত্যেকে ১.২ GW ক্ষমতা সম্পন্ন। ভারত ও পাকিস্তানের পরে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার তৃতীয় দেশ হিসেবে তাদের শক্তির মিশ্রণে পারমানবিক শক্তি যুক্ত করতে যাচ্ছে। আজ, পারমাণবিক শক্তি বিশ্বের বিদ্যুতের প্রায় ১০% সরবরাহ করে এবং এটি স্বল্প-কার্বন নিঃসরণ করা শক্তির উৎসের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম, প্রথমটি হাইড্রোপাওয়ার। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে ব্যবহৃত VVER-1200 চুল্লিগুলি বিশ্বের কয়েকটি উন্নত পারমাণবিক চুল্লির মধ্যে রয়েছে। এই VVER-1200 উন্নত প্রযুক্তিগত এবং অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত ৩+ প্রজন্মের রিঅ্যাক্টরগুলি নিখুঁত ক্রিয়াকলাপের সুরক্ষা নিশ্চিত করে এবং IAEA- ফুকুশিমা পরবর্তীসুরক্ষা মানকে সম্পূর্ণ মেনে চলে। VVER-1200 প্রকল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্যটি সক্রিয় এবং নিষ্ক্রিয় সুরক্ষা সিস্টেমগুলির একটি অনন্য সংমিশ্রণ যা টর্নেডো, হারিকেন, ভূমিকম্প এবং এয়ার ক্র্যাশ সহ বহিরাগত এবং অভ্যন্তরীণ প্রভাবগুলিতে সর্বাধিক স্থিতিস্থাপকতা সরবরাহ করে।
PC:http://www.rooppurnpp.gov.bd/
সমীক্ষা অনুসারে জানা যায় পারমাণবিক শক্তি, বাদামী কয়লার তুলনায় ৯৯.৮% কম মৃত্যুর কারণ হয়; কয়লার তুলনায় ৯৯.৭% কম; তেল থেকে ৯৯.৬% কম; এবং গ্যাসের তুলনায় ৯৭.৫% কম। অন্যদিকে, একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছে যে, জীবাশ্ম জ্বালানী জ্বালিয়ে সৃষ্ট বায়ুদূষণ (বায়ুবাহিত সূক্ষ্ম কণা বিষয়গুলির একটি প্রধান উৎস) বিশ্বব্যাপী বায়ু দূষণ জনিত মৃত্যুহার এবং রোগের মূল অবদানকারী। আরও একটি সমীক্ষা প্রকাশ পেয়েছে যাতে বলা হয়েছে যে, জীবাশ্ম জ্বালানি জ্বালানোর জন্য ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী ৮.৭ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বললে, জীবাশ্ম জ্বালানির জ্বলনের ফলে বায়ু দূষণের কারণে সমস্ত লোকের মধ্যে পাঁচ জনের মধ্যে এক ব্যক্তি মারা যায়।
পারমাণবিক শক্তি কেবল ঐতিহ্যবাহী জীবাশ্ম জ্বালানির তুলনায় তুলনামূলকভাবে নিরাপদ নয়, এটি সবুজ শক্তির একটি দীর্ঘমেয়াদী উৎস, যা বাংলাদেশকে একটি কম-কার্বন নিঃসরণ পদক্ষেপ অর্জন করতে সাহায্য করবে।পারমাণবিক বর্জ্য নিষ্কাশনের জটিলতার কারণে এটিকে পরিবেশগতভাবে বিপজ্জনক শক্তির উৎসহিসাবে মনে করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি শক্তির একটি শূন্য-নির্গমন বিশুদ্ধ উৎস এবং তাই এটি সম্পূর্ণ পরিবেশগতভাবে টেকসই ও নিরাপদ। IAEA-এর ২০১২ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৫০ বছরে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের ফলে CO2 নির্গমনের পরমান ৬০ গিগাটন হ্রাস পেরেছে যা প্রায় দুই বছরের বৈশ্বিক শক্তি সম্পর্কিত নির্গমনের সমান। কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে প্রতি বছর তিন মিলিয়ন টন কয়লা থেকে সাত মিলিয়ন টন CO2 এবং ০.৩ মিলিয়ন টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন করে,যেখানে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম বছরে মাত্র এক টন রেডিও-সক্রিয় বর্জ্য উৎপাদন করেবছরে ২৭ টন UO2 থেকে। এই রেডিও-অ্যাক্টিভ বর্জ্য পুনরায় প্রক্রিয়াজাত করা যায় এবং পারমাণবিক জ্বালানী হিসাবে আবার ব্যবহার করা যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র শূন্য গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করে যা বাংলাদেশকে তার পরিবেশ রক্ষায় সহায়তা করবে।পরিবেশ বান্ধব হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেবিশ্বে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবহার বাড়ছে।
কেবল এটিই নয় পারমাণবিক শক্তির আরেকটি সুবিধা হল এটি অন্যান্য পরিষ্কার-বায়ু উৎসের তুলনায় কম জমিতে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউক্লিয়ার এনার্জি ইনস্টিটিউট তথ্য অনুসারে,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি আদর্শ 1,000MW পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালাতে গড়ে প্রায় 1 বর্গমাইলেরও বেশি জায়গা প্রয়োজন হয়। পক্ষান্তরে, একটি বায়ু খামারে একই পরিমাণ বিদ্যুৎ এবং সৌর ফটোভোলটাই-এ একই পরিমাণবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে যথাক্রমে ৩৬০গুণ এবং ৭৫৫ গুণ বেশি জায়গা প্রয়োজন। সুতরাং, বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশের জন্য, যেখানে খোলা জমির জায়গাগুলি সন্ধান করা প্রায়শই একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়, পারমাণবিক শক্তিকে কার্যকর বিকল্প হিসাবে সন্ধান করা যেতে পারে।
একটি প্রচলিত ভুল ধারণাও রয়েছে যে পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র স্থাপন একটি ব্যয়বহুল প্রস্তাব এবং তাই এটি খুব ব্যবহারিক নয়। তবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি নির্মাণ করা যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি চালানো তুলনামূলক সস্তা। পারমাণবিক শক্তি বনাম জীবাশ্ম জ্বালানীর পক্ষে মতামত বিবেচনা করার সময় ব্যয়টি গুরুত্বপূর্ণ। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির অপারেটিং ব্যয় অন্য বিদ্যুৎ উৎপাদক শক্তি উৎসগুলির ব্যয় ছাড়িয়ে গেলেও মোট ব্যয় বেশিরভাগের তুলনায় কম। বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় মোট ব্যয়ের মধ্যে অপারেশন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং জ্বালানি অন্তর্ভুক্ত। যে জায়গাগুলিতে জীবাশ্ম জ্বালানী সহজেই পাওয়া যায় না, সেখানে পারমাণবিক শক্তি জীবাশ্ম জ্বালানীর সাথে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যম হিসাবে প্রতিযোগিতামূলক প্রমাণিত হয়। অধিকন্তু, জীবাশ্ম জ্বালানির সামাজিক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ব্যয়কে বিবেচনায় নিলে পারমাণবিক শক্তির প্রতিযোগিতা বহুগুণে উন্নত হবে।
পারমাণবিক জ্বালানীর একটি পেলেটের ওজন প্রায় ০.১ আউন্স (৬ গ্রাম)। এই একটি পেলেট ইউরেনিয়াম থেকে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ পাওয়া যায়, তাপ্রায় এক টন কয়লা, ১২০ গ্যালন তেল বা ১৭,০০০ ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস দ্বারা উৎপাদিত বিদ্যুতের সমান পরিমাণ। এইভাবে পারমাণবিক জ্বালানীকে চেয়ে জীবাশ্ম জ্বালানীর আরও দক্ষ করে তোলে।২০১৭ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী,পারমাণবিক উৎসগুলোর শক্তি উৎপাদন করার দক্ষতা ৯২% (সবচেয়ে বেশি) যেখানে অন্যান্য উৎসগুলোর দক্ষতা অনেক কম (কয়লা-৫৪%, প্রাকৃতিক গ্যাস-৫৫%, বায়ু জেনারেটর-৩৭%, সোলার প্লান্ট-২৪% এবং হাইড্রোপাওয়ার-৩৯%।
জীবাশ্ম জ্বালানীর তুলনায় পারমাণবিক শক্তি এগিয়ে কারন জীবাশ্ম জ্বালানীর উৎস ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে, সম্ভাব্য বৈশ্বিক ঘাটতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ইউরেনিয়াম পৃথিবীর অন্যতম প্রতুল শক্তি উৎস। জীবাশ্ম জ্বালানীর চেয়ে পারমাণবিক শক্তির অন্যতম সুবিধা ইউরেনিয়াম পুনরায় প্রসেস করা যায় এবং ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানীগুলি অ-নবায়নযোগ্য। জীবাশ্ম জ্বালানীর উপর মানুষের নির্ভরতার কারণে জ্বালানী সংরক্ষণাগারে দ্রুত কমে যাচ্ছে।
উপরের বিষয়গুলো থেকে এটা পরস্কার যে জীবাশ্ম জ্বালানীর তুলনায় পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করা ভালো। কিন্তু একটা প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মনে জাগে, “পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কি পরিবেশের ও আশেপাশের জনগণের জন্য নিরাপদ?; নিউক্লিয়ার তেজস্ক্রিয়তা থেকে কি প্রাণী ও পরিবেশ রক্ষা পাবে?”। আমরা জানি পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই আমাদের প্রকৃতিতে তেজস্ক্রিয়তা বিদ্যমান। আমাদের খাবার, পানি এবং শ্বাস গ্রহণ করার বাতাসসহ সব কিছুর মধ্যে তেজস্ক্রিয়তা বিরাজমান। আমদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা প্রতিনিয়ত যা ব্যবহার করছি যেমন বিনোদনের জন্য মোবাইল, টেলিভিশান, ল্যাপটপ, আইপ্যাড; খাবার গরম ও রান্নার জন্য মাইক্রোওয়াভে এবং চিকিৎসার এক্সরে ও সিটি স্ক্যান করার মাধ্যমে তেজস্ক্রিয়তা গ্রহণ করছি। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশে আজীবন বসবাস করলে একজন মানুষ মোট যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা গ্রহণ করবে, তা একবার এক্সরে থেকে প্রাপ্ত তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণের চেয়ে অনেক কম। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ খুব কম এবং তা প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত তেজস্ক্রিয়তার শতকরা ১ ভাগেরও কম। বিমানে যাতায়াত করার ফলে আমাদেরকে প্রচুর তেজস্ক্রিয়তা গ্রহণ করতে হয় এবং সেটা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তেজস্ক্রিয়তার থেকে অনেক কম। একজন ব্যক্তি জাপানের টোকিও শহর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বিমানে যাত্রা করলে যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা গ্রহণ করবে তা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশে আজীবন বসবাস করা একজন ব্যক্তির গৃহীত তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণের চেয়ে ১০ গুন বেশি হবে।
তারপরও আমাদের রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে থাকছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিশিষ্ট ৩ প্লাস (৩+) জেনারেশনের রিঅ্যাক্টর। পাশাপাশি পরিবেশকে ক্ষতিকারক বিকিরণ থেকে রক্ষা করার জন্য পাঁচটি স্তর রয়েছে। এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে তেজস্ক্রিয়তা (প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট) যেন কোন ভাবেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্যানিটারি সুরক্ষা অঞ্চলের (৩০০ মিটার রেডিয়াস) বাহিরে যেতে না পারে তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা থাকবে, এবং আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আন্তর্জাতিকভাবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকায় তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা সার্বক্ষনিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে, যাতে এই এলাকার তেজস্ক্রিয়তার সহনশীলতার মাত্রা অতিক্রম করতে না পারে। সুতরাং আমরা বলতে পারি এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি এই অঞ্চলে বসবাসকারী জনগণের জন্য কোন ধরনের বিপদবা আতঙ্কের কারন হবে না এবং পরিবেশের জন্য হুমকি হবে না। এটা বরং এই অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান বাড়াবে এবং আমরা কম দামে সবাই বিদ্যুতের সুবিধা পাবো। এবং এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা উন্নয়নে শক্তিশালী প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাহচ্ছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র শূন্য গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গত করে যা বাংলাদেশকে তার পরিবেশ রক্ষায় সহায়তা করবে।
লেখক : ড. প্রীতম কুমার দাস, সহযোগী অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা, বাংলাদেশ।