বাংলাদেশকে কোয়াডে যোগ দেওয়ার বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়ে গত সপ্তাহে ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, বেইজিংয়ের বন্ধু হোক বা শত্রু, উপমহাদেশের সকল দেশই এই নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ অর্থাৎ পরাশক্তি চীনের মুখোমুখি হতে হবে। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছেন, বাংলাদেশ কোয়াড বা অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান এবং আমেরিকাকে নিয়ে গঠিত জোটে যোগ দিলে বেইজিংয়ের সাথে ঢাকার সম্পর্কের ‘উল্লেখযোগ্য ক্ষতি’ হবে।
যে দেশে চীনা রাষ্ট্রদূত কর্মরত রয়েছেন সে দেশটির প্রতি তাঁর এতটা রূঢ়তার কারণ কী, যেখানে চীনের সংবেদনশীলতার প্রতি আপত্তিজনক কোনো রেকর্ড নেই সে দেশের। কেউ কেউ অবাক হয়েছেন যে, লি কেন এমন একটি জোটে যোগদানের বিরুদ্ধে ঢাকাকে সতর্ক করছেন যার নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার কোনো পরিকল্পনা নেই। আমি বলব তারা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করছেন না। লি’র অবশ্যই চিন্তাভাবনা না করে এধরনের মন্তব্য করেননি; তিনি কূটনীতিক প্রতিবেদকদের সংগঠনের সাথে সাথে কথা বলছিলেন। আমাদের অবশ্যই ধরে নিতে হবে যে, রাষ্ট্রদূত যা বলেছিলেন তা তিনি আয়োজক দেশকে শোনাতে চান বলেই বলেছেন। তার মন্তব্যের সারবস্তুতে যাওয়ার আগে, আসুন আমরা চীনের নতুন কূটনৈতিক ধরনের প্রতি একটু নজর দিই।
চীন তার সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রশ্নে সব সময় কঠোর ভাষা ব্যবহার করে এসেছে এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের যেকোনো অনুভূত প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোরভাবে পিছু হটেছে। এখনকার আক্রমণাত্মক ধরনটি অনেক বিস্তৃত বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। ১৯৭০ এর দশকের শেষের দিকে যখন দেং জিয়াওপিং চীনের অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করে দেন এবং চীনকে পুনর্নির্মাণের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চান, তখন বেইজিংয়ের কূটনৈতিক দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল বন্ধুত্ব অর্জনে এবং মানুষকে প্রভাবিত করার দিকে। চীনা কূটনীতিকদের এখন বেইজিংয়ের স্বার্থকে সাহসের সাথে রক্ষা করার এবং বর্তমান বিষয়গুলোতে সক্রিয়ভাবে আন্তর্জাতিক ডিসকোর্সকে রূপ দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
নতুন ‘নেকড়ে যোদ্ধা কূটনীতি’ বা ‘উলফ ওয়ারিয়র ডিপ্লোম্যাসি’ জন পরিসরেই চীন সম্পর্কে যেকোনো সমালোচনার প্রত্যুত্তর দেয়। তারা হোস্ট সরকারগুলোকে পরামর্শ দেয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়গুলো তলব করলে সব সময় হাজিরও হয় না। দিল্লিতেও কিছু সময়ের জন্য তাদের এই আচরণ দেখা গেছে- বিশেষত ডোকলাম ও লাদাখের সাম্প্রতিক সঙ্কটের সময়ে। চীনের সরকারি গণমাধ্যমগুলো ভারতকে অপমান করার নিত্যনতুন এবং সৃজনশীল পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। তবে আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীরা, যাদের প্রত্যেকেই চীনের সাথে সুসম্পর্ক উপভোগ করছে তারা সবে বেইজিংয়ের নতুন কূটনৈতিক ওষুধের স্বাদ পেতে শুরু করেছে।
চীনা রাষ্ট্রদূত অবশ্যই অবগত ছিলেন যে, কোয়াড ঢাকাকে জোটে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানায়নি। চীন এই অঞ্চলে মার্কিন নীতির প্রতি খুব ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখে এবং কোয়াড সম্পর্কে আরো বেশি। ঢাকা ও কোয়াডের কথা বলতে গিয়ে রাষ্ট্রদূত কেবল বাংলাদেশের জন্য একটি লক্ষ্মণরেখা টেনেছিলেন।
কোয়াড সম্পর্কে লি’র প্রকাশ্য মন্তব্যগুলির উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে যেকোনো ইন্দো-প্যাসিফিক প্রলোভনে সাড়া না দিতে বলা। আগ বাড়িয়ে কাজ করাটা বেইজিংয়ের কৌশলগত সংস্কৃতির একটি অংশ। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরের ঘটনাগুলো মনে করুন, যখন চীনা গণমাধ্যম বঙ্গোপসাগরে বার্ষিক মালাবার অনুশীলনকে ‘এশিয়ান ন্যাটো’ গঠন বলে উপস্থাপন করেছিল। ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে শুরু হওয়া এই ধারাবাহিক মহড়ার অংশ ছিল যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং সিঙ্গাপুর যেখানে ভারত প্রথমবার যোগ দিয়েছিল।
এই মিডিয়া আক্রমণের পরে পাঁচটি দেশেরই কূটনৈতিক চ্যানেলগুলির মাধ্যমে চীন আনুষ্ঠানিক আপত্তি জানায়। ভারতে ক্ষমতাসীন ইউপিএ জোটের একটি বড় অংশ বাম দলগুলোও চীনের আপত্তির সাথে সুর মিলিয়েছিল। ফলে বিচলিত হয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি অন্য দেশগুলোর সাথে এই জাতীয় বহুপাক্ষিক মহড়া নিষিদ্ধ করেছিলেন।
চীনের আপত্তি ভারতের রাজনৈতিক ও নীতিগত পরিবর্তন এনেছে। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরের পরে, দিল্লি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা গভীরতর করার বিষয়ে সতর্ক হয়ে পড়ে। মালাবার সিরিজটি দ্বিপাক্ষিক রূপে ফিরে আসে যতদিন পর্যন্ত এনডিএ সরকার ২০১৫ সালে জাপান এবং ২০২০ সালে অস্ট্রেলিয়াকে এতে অন্তর্ভুক্ত না করে।
রাষ্ট্রদূত লি’র মন্তব্যগুলিো বেইজিংয়ের পার্টিরই সুর যে, কোয়াড একটি ‘ছোট ভূ-রাজনৈতিক চক্র’ যা এশিয়াকে বিভক্ত করে চীনকে ধরাশায়ী করতে চায় এবং একারণে বেইজিং কোয়াডের সাথে কোনোভাবেই জড়িত হওয়াকে সুনজরে দেখে না। সর্বোপরি, যেকোনো প্রতিরোধমূলক এশিয়ান জোটের উত্থান রোধ করা এখন চীনের জন্য শীর্ষ কৌশলগত অগ্রাধিকার।
দিল্লি দীর্ঘদিন পর শিখেছে যে, উপমহাদেশে খুব বেশি কূটনৈতিক অহমিকা ভারতের আঞ্চলিক লক্ষ্য পূরণকে পেছনে ফেলেছে। চীন, বিশ্বের নবীন পরাশক্তি হিসেবে সম্ভবত ভেবেছে অপেক্ষাকৃত ছোট দেশগুলোকে লক্ষ্মণরেখা এঁকে দিয়ে তার অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক ব্যয়কে সীমাবদ্ধ রাখবে।
দক্ষিণ এশীয় অভিজাতরা সর্বদা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য দিল্লির ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছে এবং বিকল্প হিসেবে চীনের অ-হস্তক্ষেপবাদী নীতিকে তারা স্বাগত জানিয়েছে। ঢাকার বিষয়টি তাদেরকে বেইজিংয়ের অতীত চিত্রকে হালনাগাদ করতে সহায়তা করবে। ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক স্বার্থের তাগিদে চীন এখন আর হস্তক্ষেপ করতে পিছপা হচ্ছে না। বেইজিংয়ের হস্তক্ষেপগুলোও বেশ ঔদ্ধত্যপূর্ণ। এই অঞ্চলে হস্তক্ষেপের বিষয়ে দিল্লি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক। এর মানে এই যে, না ভেবেচিন্তে হস্তক্ষেপ না করাও একটি বুদ্ধিমান নীতি। এছাড়াও দিল্লিও আশপাশের অস্বস্তিকর ঘটনাতেও বেশ ধৈর্য দেখিয়েছে।
আমাদের প্রতিবেশীরা সর্বদা অর্থনৈতিক প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নে ভারতের অদক্ষতা সম্পর্কে অভিযোগ করে আসছে এবং একে চীনের গতি এবং উদ্দেশ্যমূলকতার সাথে তুলনা করেছে। তবে তারা চীনা অর্থনৈতিক দক্ষতার একটি উল্টো দিকও আবিষ্কার করছে- তা হলো সহযোগিতার এমন শর্তাদি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের সক্ষমতা যা হোস্ট দেশের জন্য সব সময় কল্যাণকর নয়।
দিল্লি সম্পর্কে তাদের সমস্ত অভিযোগের বিষয়ে বলব, এই অঞ্চলে সমস্ত শাসনকর্তাদের সময়ে ভারতীয় অভিজাতদের বিভিন্ন বিভাগে প্রবেশাধিকার ছিল এবং আঞ্চলিক নীতি সম্পর্কিত ডিসকোর্সকে আকার দেওয়ার কিছুটা হলেও ক্ষমতা ছিল। তারা শিগগিরই আবিষ্কার করতে পারবেন যে, চীনের বদ্ধ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তাদের মোটেও রাজনৈতিক সম্ভাবনা নেই যা রাষ্ট্রপতি শি’র অধীনে আরো কঠোর হয়ে উঠেছে।
আমাদের প্রতিবেশীরা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বিপরীতে ভারসাম্য বজায় রাখার সুবিধাজনক ও তাৎক্ষণিক বিকল্প সমাধান হিসেবে চীনকে দেখেছে। এখন অবধি, ভারতের বিপক্ষে চীনা সমর্থন বিনামূল্যে পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল। বেইজিং দক্ষিণ এশিয়ায় যত রূঢ় হয়ে উঠবে, চীনের ওপর নির্ভর করার মূল্য ততটাই স্পষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর আগে, ভারত, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং রাশিয়ার সাথে দৃঢ় সম্পর্ক থাকার ফলে বাস্তবে তাদের প্রত্যেকের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র দেশগুলোর দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। ঢাকার কূটনৈতিক বিতর্ক এটিই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে চীন একে এতটা সহজ করে রাখবে না। এটি অবশ্যই এমন কোনো পাঠ নয় যে দিল্লি প্রচার করতে চাইবে; এবং তার প্রতিবেশীরাও তা শুনবে। তবে তাদের প্রত্যেকে নিজের মতো করে দক্ষিণ এশিয়ার নতুন আধিপত্যবাদী শক্তিকে মোকাবেলা করার স্বাদ আবিষ্কার করবে।
চিলামকুড়ি রাজা মোহন : ভারতীয় শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক এবং বিদেশ নীতি বিশ্লেষক