বাংলাদেশে তামাক পণ্যের মূল্যের ওপর যে করারোপ করা হয় তা শতাংশ হিসেবে অথবা অ্যাডভেলোরেম পদ্ধতিতে এটি অত্যান্ত ত্রুটিযুক্ত যা যথাযথ র্কাযকর না। যার ফলে কাঙ্খিত রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। অনাকাঙ্খিতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তামাক কোম্পানির মুনাফা এবং কর ফাঁকি দেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ থেকে যাচ্ছে তামাক কোম্পানির। এর ফলে প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে তামাক কোম্পানি। একই সঙ্গে এ পদ্ধতির কারনে তামাকজাত পণ্য সহজলভ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছে। বিশ্বে তামাক নিয়ন্ত্রণে সফল দেশগুলোর মতোই অ্যাডভেলোরেম পদ্ধতি থেকে পরির্বতিত হয়ে সুর্নিদিষ্ট করারোপ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে হবে।
বাংলাদেশে প্রচলিত আইন অনুসারে তামাকজাত পণ্যের ওপর সুর্নিদিষ্ট কর রোপ করা যায়। মূল্য সংযোজন কর ও সম্পুরক শুল্ক আইন-২০১২ এর ধারা ১৫(৩) ও ৫৮ তে এই বিষয়টি উল্লেখ করা আছে। আইনটির উর্পযুক্ত ধারাসমূহ অনুযায়ী সব ধরণের তামাকজাত পণ্যে সুনির্দিষ্ট করারোপ করা সম্ভব। সুনির্দিষ্ট কর পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা হলে করের পরিমান নির্ণয় ও কর আদায় করা সহজ হবে। এতে সরকারের রাজস্ব আয় যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি সব ধরণের তামাকজাত পণ্যের মূল্যও বৃদ্ধি পাবে। ফলে তামাক কোম্পানির কর ফাকি দেওয়ার সুযোগ কমবে।
বাংলাদেশে তামাকজাত পণ্যের দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির হার মূল্য স্ফিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় এটি মানুষের কাছে আরও সহজলভ্য হয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিগত ১০ বছরে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের তুলনায় তামাকজাত পণ্যের দাম বেড়েছে খুবই কম হারে। তাই র্কাযকর তামাক নিয়ন্ত্রণ এবং সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করতে প্রতি বছর মূল্য স্ফিতির চাইতে অধিকহারে তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি এবং সঠিক পদ্ধতিতে করারোপ করা বঞ্চনীয়। কারণ তামাকজাত পণ্যে উচ্চ করারোপ করা হলে সেটা যে তাৎক্ষনিকভাবে ক্রেতাদের ওপর প্রভাব পড়ে তা বিভিন্ন সময়ের গবেষনায় প্রমাণিত।
তামাক ব্যবহার জনিত রোগে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লক্ষ ২৬ হাজারের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। গবেষণায় দেখা গেছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারজনিত রোগের কারণে দেশে অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। একই সময়ে তামাক খাত থেকে রাজস্ব আয় ছিলো ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত সময়ের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ পেতে হলে তামাকের ব্যবহার প্রতি বছর গড়ে ১.৫% হারে কমিয়ে আনতে হবে। ২০৪০ সালের মধ্যে লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাবনা বাড়বে যদি আরও আগেই তামাক ব্যবহারের প্রবণতা ব্যাপক হারে কমিয়ে আনা যায়। এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ২০২১ সালের মধ্যে বর্তমান তামাক ব্যবহারের প্রবণতা ২৮.৪% কমানোর লক্ষ্য স্থির করতে হবে।
তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মীরা ‘২০২১-২২ অর্থ-বছর’ এর জন্য সব ধরণের তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য ও কর প্রস্তাব সরকারের কাছে পেশ করেছে। এই প্রস্তাবে-সিগারেটের ক্ষেত্রে সকল ব্রান্ড ও মূল্যস্তরের সিগারেটে অভিন্ন করভার (চুড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৬৫%) নির্ধারণসহ সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কের প্রচলন করে স্তরভিত্তিক নিম্নোক্ত মূল্য ও কর নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে-নিম্ন স্তরের, প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৩২.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক করারোপ করা। মধ্যম স্তরের, প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৭০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক করারোপ করা।
উচ্চ স্তরের, প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১১০ টাকা নির্ধারণ করে ৭১.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক করারোপ এবং প্রিমিয়াম স্তরের, প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১৪০ টাকা নির্ধারণ করে ৯১ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক করারোপ করা। বিড়ির ক্ষেত্রে, ফিল্টারযুক্ত ও ফিল্টারবিহীন বিড়ির অভিন্ন করভার (চুড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৪৫%) নির্ধারণসহ সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কের প্রচলন করে, ফিল্টারবিহীন বিড়ির ২৫ শলাকার খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১১.২৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক এবং ফিল্টারযুক্ত বিড়ির ২০ শলাকার খুচরা মূল্য ২০ টাকা নির্ধারণ করে ৯.০০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা।
জর্দা ও গুলের ক্ষেত্রে, জর্দা ও গুলের কর ও দাম বৃদ্ধিসহ সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক ব্যবস্থার প্রচলন করা, প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৪৫ টাকা নির্ধারণ করে ২৭.০০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক (৬০%) আরোপ করা, এবং প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১৫.০০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক (৬০%) আরোপ করা। সকল তামাকপণ্যের খুচরা মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ পূর্বের ন্যায় বহাল রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
উপরোক্ত প্রস্তাবে তামাকজাত পণ্যের ওপর করারোপে এতদিন বিদ্যমান অ্যাডভেলোরেম পদ্ধতির পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট করারোপ পদ্ধতি প্রচলনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণ অ্যাডভেলোরেম পদ্ধতিতে করারোপের ফলে সরকারের রাজস্ব উল্লেযোগ্য হারে বাড়েনা কিন্তু তামাক কোম্পানি অনাকাংখিতভাবে লাভবান হয়। পণ্যের ওপর সুনির্দিষ্ট করারোপের মাধমে একইসাথে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি, তামাকের ব্যবহার এবং তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব। সারা বিশ্বে ২০১৯ পর্যন্ত ৬৯% দেশে সুনির্দিষ্ট করারোপ ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, শ্রীলংকা, তিমুর, ভারত ও থাইল্যান্ডে দেশে সুনির্দিষ্ট করারোপ ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। এখানে কেবলমাত্র বাংলাদেশে এককভাবে অ্যাডভেলোরেম পদ্ধতিতে করারোপ করা হয়।
তামাকজাত পণ্যের উপর্যুক্ত মূল্য বৃদ্ধি এবং করারোপের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে ১১ লক্ষ প্রাপ্ত বয়স্ক ধূমপায়ী ধূমপান ছেড়ে দেবে এবং ৮ লক্ষ তরুণ নতুন করে ধূমপান শুরুকরতে নিরুৎসাহিত হবে। পাশাপাশি ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে। এতে দীর্ঘ মেয়াদে ৮ লক্ষ তামাক ব্যবহারকারীর জীবন রক্ষা হবে। একই ভাবে রাজস্ব আয় প্রায় ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বৃদ্ধি পাবে। তাই আমাদের দাবী উপর্যুক্ত প্রস্তাব অনুযায়ী তামাকজাত পণ্যের করারোপ করুন, এতে মানুষের জীবন বাঁচবে, রাজস্ব আয়ও বাড়বে।
লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক- গাংনী প্রেসক্লাব ও তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মী।