নারীদের প্রতি যে আমি দুর্বল এটা সবাই জানে। বিশেষভাবে দুর্বল। এসব নিয়ে অনেকবার লিখেছি। ফেসবুকে পুরুষ বন্ধুর চেয়ে নারী বন্ধু বেশি আমার। বন্ধু রিকোয়েষ্ট নারীরাই বেশি পাঠায় আমাকে। নারীদের বেশি একসেপ্ট করি আমি। এখনও প্রায় হাজার খানেক নারীদের রিকোয়েষ্ট জমে আছে। ১৮ থেকে ৮০ বছর বয়সের বন্ধু আছে আমার। নারীরা আমার লেখার বড় অনুপ্রেরণা, বড় পাঠক। নারীরা আমার লেখায় বেশি মন্তব্য করে। নারীরা আমার বইয়ের বড় ক্রেতা। তারাই অটোগ্রাফ বেশি নিতে আসে। এর কারণ হয়ত এই যে, আমি নারীদের কথা বেশি লিখি, নারীর মনোজগত নিয়ে বেশি চর্চা করি। তাই নারীরা আমার প্রতি ভালবাসা দেখায়, আনুকল্য প্রদর্শন করে। হিসাব অতি সোজা। ভালবাসা সহজ একটা কাজ। পয়সা লাগে না, পরিশ্রম নাই। নারীদের প্রতি সহমর্মী হন, তাদের কথা মন দিয়ে শুনুন, তাদের শ্রদ্ধা করুন। নারীরা যে মানুষ এই বোধ তৈরী করুন। বস্তুতঃ নারী পুরুষের বিভাজনটাই আমার কাছে অপছন্দ। আমি নারীর চেহারা, ঝকঝকে পোশাক, আর্থ সামাজিক অবস্থা দেখে বন্ধুত্ব করি না বা মূল্যায়ন করি না, আমি তাদের মূল্যায়ন করি তাদের হৃদয় দেখে, মনের সৌন্দর্য্য আর ঔদার্য্য দেখে। তারাও ঠিক আমাকে এভাবেই দেখে, আমাকে ভালবাসা দেয়।
আমি আমার মা কে ভালবাসি, আমার স্ত্রীকে ভালবাসি, আমার কন্যাকে ভালবাসি। আমি আমার সব নারী আত্মীয়, নারী বন্ধুদের ভালবাসি। বিপদে পাশে থাকি। সাহায্য করি। বিনিময়ে কখনও কিছু চাইনা। আমি ছোটবেলায় আমার কন্যা অরিত্রিকে বলেছি তুমি এবং অর্ক আমার কাছে সমান। সবকিছু ফিফটি ফিফটি। একদিন অর্ক কাঁদো কাাঁদো হয়ে বলল, তখন অর্কর বয়স সাত কি আট। বাবা, তুমি তো বলছিলা সবকিছু ফিফটি ফিফটি এখন তো দেখছি, সেভেনটি থার্টি। তুমি অরিত্রিকে বেশি ফেভার করছ। আমি খুব হেসেছিলাম। এই সেদিনও অরিত্রিকে আমি এক লক্ষ ডলার গিফট করেছি। অরিত্রি বলল, আমাকে দিতে হবে না। ভাইয়াকে দাও! আমি অরিত্রিকে বললাম, তোমার মনে আছে ছোটবেলার কথা! বলেছিলাম সব ফিফটি ফিফটি ভাগ! অরিত্রি হেসে বলল, হ্যাঁ। বললাম তোমার প্রায়োরিটি আমার কাছে আগে।
আমার মা মারা গেছেন অনেক বছর হয়েছে। এখনও আমি আমার মায়ের জন্য কাঁদি। প্রায়ই স্বপ্নে মা আসে। আমার লেখার টেবিলে মায়ের ছবি আছে। ঘুম ভেঙ্গে আমি মাকে দেখি। মা বাবার জন্য পাঁচবার নামাজ পড়ে দোয়া করি। প্রতিদিন একবার আমি অরিত্রির সাথে কথা বলি। প্রতি সপ্তাহে একবার অন্ততঃ তাকে দেখতে যাই। আমি যখন বরিশালে একটা লাইব্রেরি করার ঘোষনা দিলাম, প্রথমেই আমার একজন নারী বন্ধু পাঁচলক্ষ টাকা ডোনেশন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল। কোনো শর্ত ছাড়াই। আমার বিপদে সবসময় নারীদের পাশে পেয়েছি। বিশ্ববিদ্যলয়ে পড়ার সময় যখন আমার অনেক টানাটনি, লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম তখন শামীম আপা, বানী আপা এবং জেসমিন আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল।
অতএব নারীকে ভালবাসুন। নারীকে শ্রদ্ধা করুন। শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা হাত ধরাধরি করে চলে। যেকোনো রিলেশনই রেসিপ্রোকাল। গিভ এন্ড টেক। আমি কখনও কোনো নারীকে অসম্মান করিনি। কষ্ট দেইনি। নিজে অনেক ক্ষতি মেনে নিয়েছি কিন্তু কখনও তাদের ছোট করিনি।
মনে পড়ে একবার ঢাকা থেকে বরিশাল যাচ্ছি লঞ্চে। শীতের রাত। আমার প্রবল জ্বর উঠল সেই রাতে। এদিকে আমার পকেটে পয়সা নাই। গরম কাপড় নাই। আমি জ্বরে কোকাচ্ছিলাম। আমি তখন ছাত্র। মাকে দেখতে যাচ্ছিলাম। মা অসুস্থ্য ছিলেন। সেই রাতে একজন দরিদ্র হিন্দু নারী আমাকে খেতে দিয়েছিলেন, গায়ে কাঁথা দিয়েছিলেন। ২০১০ সালের কথা। মা মারা যাওয়ার পর আমি দেশে যাচ্ছি। খুব আপসেট। টরন্টো থেকে লন্ডন, সেখান থেকে দুবাই, তারপর ঢাকা। কাকতলীয়ভাবে তিনবারই আমার আমার সহযাত্রী ছিল নারী। তার মধ্যে একজন স্কটিশ, একজন ভারতীয়, আহমেদাবাদের, একজন ঢাকার নবাবগঞ্জের মেয়ে। আমি নীরবে কাঁদছিলাম, খাবার খাচ্ছিলাম না। তারা আমার প্রতি পরম মমতা প্রদর্শন করেছিলেন। ব্যাথিত হয়েছিলেন।
এ রকম অনেক ঘটনাই আমার জীবনে আছে যেখানে নারীরা আমার সহায়ক শক্তি হয়েছে। আমার জীবনের অনেক কিছুই নারীময়। ধর্ম বর্ণ নির্শেষে নারীরা আমাকে আনুকল্য দিয়েছে, অনুরাগ দিয়েছে। আমার ফ্যামিলি ডাক্তার একজন নারী, আমার ডেন্টিস্ট নারী। এই যে পরীমনিকে নিয়ে যেটা ঘটেছে সেটা নিন্দনীয়। শুধু নিন্দনীয় না শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রিবাট শাস্তি। পরীমনি আমার কেউ না। আমি তার কোনো সিনেমাও দেখিনি। কিন্তু সে একজন নারী। যখনই কোনো নারী নির্যাতিত হয় আমি তার প্রতিবাদ করি। বিচার চেয়ে সোচ্চার হই। সবসময় যে সঠিক বিচার হয় তা না। কখনও আদৌ বিচার হয় না। ক্ষমতার কাছে বিচার চাপা পড়ে যায়। এবার আমি আশাবাদী যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেহেতু বিচার প্রার্থনা করা হয়েছে তাই কারো পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে বলেই আমি মনে করি। অপরাধীরা যত ক্ষমতাবানই হোক এর বিচার হতে হবে।
টরন্টো ১৫ জুন ২০২১