মগধের অধিপতি পরাক্রমশালী রাজা বিম্বিসার একটি জরুরী কাজে এসেছেন তার পার্শ্ববর্তী রাজ্য বৈশালীতে। গৌতম বুদ্ধের আমলে (৫৬৩-৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্ব) প্রাচীন ভারতের আর্যভূমি ষোলটি জনপদে বিভক্ত ছিলো। মগদ ও বৈশালী সেই ষোলটি রাজ্যের মধ্যে অন্যতম দু’টি রাজ্য বিম্বিসার কে কালই ফিরে যেতে হবে মগধে। কিন্তু তিনি মনে মনে ভাবলেন বৈশালীর অন্যতম আকর্ষণ, যার রূপের কথা তিনি শুনে শুনে বিমোহিত হয়েছেন অজস্র বার। সেই আম্প্রালির সঙ্গে সাক্ষাৎ না করেই কি ফিরে যাবেন তিনি। এটা কি করে হয়। আম্প্রালি বৈশালির নগরবধূ অর্থাৎ বারঙ্গনা। নগরবধূ হলেও আম্প্রালি রূপে গুনে, সঙ্গীত ও নৃত্যকলার এক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত রেখেছেন সমগ্র আর্যবর্তে। নগরের উপকণ্ঠে একদিন আম বাগানে একটি শিশুকন্যা কুড়িয়ে পেয়ে লালন পালন করেছিলেন সন্তানহীন এক দম্পতি, আম্প্রালি নামটিও সে কারণেই। মাত্র এগারো বছর বয়সেই তার রূপের খ্যাতি সাড়া ফেলেছিলো নগরীর শান্ত জীবনযাত্রায় আর এ জন্যই বৈশালীর তরুনদের মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছিল পারস্পরিক ঈর্ষা ও দ্বন্দ। এ কারণেই বৈশালীর সব গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সবদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেন যে কারও গৃহবধূ নয়, আম্প্রালি হবেন বৈশালীর নগরবধূ। রাজা বিম্বিসারের দেখা পেয়ে আম্প্রালিও ধন্য হলেন।
আম্প্রালির সঙ্গে রাত্রিযাপন শেষ করে বিম্বিসার পরদিন ফিরে গেলেন মগধে। তবে বিম্বিসার কথা দিয়ে গেলেন আম্প্রালির কাছে বারবার ফিরে আসবেন তিনি। কিছুদিন পর রাজা বিম্বিসার আবার এলেন আম্প্রালির কাছে। ততদিনে আম্প্রালি অন্তসত্তা হয়ে পড়েছে। আম্প্রালির গর্ভে রাজা বিম্বিসারের সন্তান। বিম্বিসার আম্প্রালিকে অনুরোধ করলেন সন্তান হলে নাম রাখতে বিমল কোন্দন্ন। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য রাজা বিম্বিসার আর কোনদিন আম্প্রালির কাছে ফিরে এলেন না। এরপর কেটে গেছে বহু বছর। বিমলও বড় হয়েছে। মগধের সিংহাসনে বসেছেন অজাতশত্রু। ক্ষমতালোভী প্রিয় পুত্রের ইচ্ছায় রাজগৃহের কারাগারে অনাহারে মৃত্যু হয়েছে বিম্বিসারের। রাজা অজাতশত্রু গৌতমবুদ্ধকে পছন্দ করেন না বলে গৌতমবুদ্ধ আশ্রয় নিয়েছেন আম্প্রালির আম্রকুঞ্জে। গৌতমবুদ্ধের শান্তির বানীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আম্প্রালি ও তার ছেলে বিমল বৈষয়িক সুখ ত্যাগ করে হয়ে যান বৌদ্ধ ভিক্ষুণী। তারা দুজনেই যোগদেন গৌতমবুদ্ধের সংঘে। বৈশালীর সেই নগরবধূ আম্প্রালির নাম অনুসারেই আমের একটি প্রজাতির নাম আম্প্রালি।
বাংলাদেশ থেকে যদি কোন উপন্যাস বিশ্ব সাহিত্যে স্থান করে নেয়ার মতো হয় তবে আমার মতে সেটি হওয়া উচিৎ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখিত ‘খোয়াবনামা’। ঠিক তেমনি বাংলাদেশ থেকে যদি কোন ফল বিশ্বদরবারে পেশ করা হয় তবে সেটা অবশ্যই হওয়া উচিৎ আম। আমার মতের সঙ্গে দ্বিমত করবেন এমন মানুষের সংখ্যা বোধকরি অঙ্গুলীমেয়। বিশ্ব বিখ্যাত পর্যটক ভাস্কো দ্য গামা ভারতবর্ষে এসেছিলেন ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি যখন তার দেশ পর্তুগালে ফিরে গেলেন তখন তিনি ভারত সম্পর্কে নানা গপ্পে মসগুল। তার দেখা বহুবিধ জিনিসের উপর মসলার প্রলেপ লাগিয়ে এসব গপ্প তিনি বলে বেড়ান যত্রতত্র। আর এজন্য বোধকরি রাজা ফিলিপও একদিন ভাস্কো দ্য গামাকে জিজ্ঞেস করলেন- আচ্ছা আপনি আমাদের খুলে বলুন তো ভারতের কোন কোন বস্তু আপনাকে চমৎকৃত করেছে। ভাস্কো দ্য গামা বললেন- বলতে গেলে বলতে হয় আমাকে মুগ্ধ করেছে অনেক কিছুই। তবে আম ও চন্দন কাঠ অবশ্যই ভারতের দু’টো উৎকৃষ্ট জিনিস। তবে রাজা ফিলিপ এটা জানতেন কিনা আমি বলতে পারব না, ইউরোপে কিন্তু আম পৌঁছে গিয়েছিল আরো অনেক আগে।
যেহেতু আম একটি পচনশীল ভোগ্যপণ্য সেহেতু আমকে আচারে রূপান্তরিত করে তারপর রপ্তানি করা হতো। আর এই আমকে ইউরোপ, আফ্রিকা কিংবা অন্যত্র বিশ্বজনীন করে তোলার মতো কাজ গুলো সাধারনত করেছিলেন আরব বণিকেরা। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে ভাস্কো দ্য গামার ভারত আগমনের বহু পূর্ব থেকেই স্থলপথে আরব বণিকেরা মসলা থেকে শুরু করে নানা ধরনের পণ্য ভারত থেকে বিভিন্ন দেশ-বিদেশে আমদানী ও রপ্তানী করতেন। সেই সুবাদে আমের আচার পৌঁছে গিয়েছিলো ইংল্যান্ডেও। কথিত আছে ইংরেজ রাজা জন মাঝে মধ্যে আমের আচার দিয়েই নাকি তিনি তার মধ্যাহ্ন ভোজ কিংবা রাতের আহার সম্পন্ন করতেন। আম যে স্টেপল ফুড অর্থাৎ মানুষের প্রধান খাদ্য হতে পারে সে তথ্য কিন্তু আমরা জানতে পারি বিখ্যাত সাহিত্যিক রাজ শেখর বসুর (যার ছদ্মনাম পরশুরাম) আপন সহদর, লেখক শশিশেখর বসু লিখিত ‘আম শাস্ত্র’ লেখাটি থেকে। তিনি লিখেছেন- আমকে স্টেপল ফুড বলছি এ কারণে যে, কোলকাতার বিবেকানন্দ রোডে একদিন দেখলাম একটি লোক ফুটপাতের কিনারায় শুয়ে বেহুশে ঘুমাচ্ছে। মাথার কাছে সতেরটারও বেশি আমের খোসা ও আমের প্রাণপনে চোষা আঁটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেল চব্বিশ ঘন্টা লোকটি নাকি ভাত-তরকারি স্পর্শ করেনি।
অন্যদিকে সে সময়ে কোলকাতায় বাঁশরী নামে একটি মাসিক পত্রিকা ছিল। সেটার সম্পাদক আম এতো ভালোবাসতেন যে চার দিন ল্যাংড়া খেয়েই ছিলেন। পঞ্চম দিনে হঠাৎ মুর্ছা গেলেন তিনি। ডাক্তারকে ফোন করতেই ডাক্তার উপদেশ দিলেন- ভাতের সঙ্গে মাছের ঝোল চটকে তাকে খাইয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। শশিশেখর বসু আরো লিখেছেন- এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। রবিনসন ক্রুশোও অতিরিক্ত আঙ্গুর খেয়ে চৈতন্য হারিয়েছিলেন। তবে অনেকে আবার আম না খেলেও শরীরের সৌন্দর্য্য বর্ধনে এটি ব্যবহার করতেন। মিশরীয় রানী ক্লিওপেট্রা মুখের ফেসিয়াল হিসেবে শুকনো আমের পিন্ড বানিয়ে মুখে লাগাতেন। আজকাল মেয়েরা নানাবিধ ফলের যে ফেসিয়াল ব্যবহার করেন তার গোড়াপত্তন সম্ভবত হয়েছিল দুই হাজার বছর আগে রানী ক্লিওপেট্রার হাত ধরেই। তবে ভূবনখ্যাত বীর আলেকজান্ডারও কিন্তু বেশ সৌন্দর্য্য সচেতন মানুষ ছিলেন। তিনি সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে আমের কোমল পিন্ড ব্যবহার করতেন কিনা সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই। তবে ইতিহাস থেকে এটা জানা যায় যে, দুধের চৌবাচ্চায় প্রচুর পরিমাণ জাফরান মিশিয়ে সেখানে তিনি ডুবে থাকতেন গোসলের পূর্বে বেশ কিছু সময়। সে হিসেবে কিন্তু আলেকজান্ডারের সঙ্গে ক্লিওপেট্রার আবার বেশ মিলঝুল পাওয়া যায়। কারণ ক্লিওপেট্রাও দুধের সঙ্গে জাফরান মিশিয়ে গোসল করতেন নিয়মিত।
ভাস্কো দ্য গামার বদৌলতে ইউরোপবাসীর জন্য ভারতের দরজা যখন খুলে গেল তখন অন্যান্য আকর্ষণীয় ভোগ্য পণ্যের মতো আমেরও এত্তো এত্তো গল্প শুনে শুনে ইউরোপবাসীও টাট্কা আমের স্বাদ আস্বাদনে ব্যাকুল হয়ে উঠলো। গামার ভারতে আগমনের পূর্বে আরব বণিকেরা যে আম শুকিয়ে কিংবা আচার বানিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চালান দিতো সে কথা আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি। এখানে প্রসঙ্গক্রমেই বলতে হয়, ভারতবর্ষের লোকেরা কিন্তু প্রাচীনকাল থেকেই আচার তৈরিতে ওস্তাদ।
হাফেজখানার নথিপত্র ঘেটে দেখা যায় যে, এখন থেকে চার হাজার বছর পূর্বে আচার তৈরির কলাকৌশলও আবিস্কার করেছিলাম এই আমরাই। সে সময় আচার হিসেবে যে বস্তুটি ইতিহাসে প্রথম প্রক্রিয়াজাত করা হয়েছিল সেটি ছিল শশা। সে যা হোক সতেরশ শতকের দিকে ইউরোপের বণিকেরা ভারতের এই রসালো ফল আমকে কিভাবে নিয়ে যাবেন তাদের দেশে এই নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা করতে লাগলেন। অবশেষে তারা লক্ষ্য করলেন যে সকল প্রজাতির আমের মধ্যে একমাত্র ল্যাংড়াই অনেকদিন টেকে। বিশেষ করে ইংরেজরা ল্যাংড়া আমের বোঁটাতে গালামোহর লাগিয়ে সেই আমগুলো তারা পাঠাতে শুরু করলেন ইংল্যান্ডে। ইংরেজ ব্যবসায়ীদের ধারনা ছিল আমের বোঁটার মধ্য দিয়েই বাতাস কিংবা পোকা ঢুকে আমে পচন ধরায়। এই যে ভারত থেকে আম ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য এতো মাতামাতি। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে যেসব সাহেব-সুবোরা এ দেশে আসতেন তাদের বেশিরভাগই কিন্তু আবার আম ভক্ত হয়ে উঠতে পারেন নি। বরং কেউ কেউ ছিলেন আম বিদ্বেষী। সে কথা আমরা জানতে পারি শশিশেখর বসুর লেখা থেকেই। তিনি নিজেও ব্রিটিশ আমলের মানুষ। তার কথাতো আর উপেক্ষা করা চলে না। তিনি লিখেছেন- বেশিরভাগ ইংরেজরাই আমে তারপিনের গন্ধ বলে এই ফল পছন্দ করতেন না।
এছাড়া আঁটি চোষার সময় যে শব্দ হয় সেটা নাকি আবার এটিকেট বিরুদ্ধ। পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরের এক ইংরেজ ম্যাজিষ্ট্রেট একবার ব্রাহ্মনভোজন দেখে বিলেতে তার মেম কে পত্র লিখেছিলেন- “মাই ডারলিং, দুইশত হাফ নেকেড পন্ডিত ক্ষীরের সঙ্গে বোম্বাই আম ও লুচি চটকে সেকি ভয়ানক শব্দ করে খেল। চক্ চক্ চক্। তাদের এই আমের আঁটি চোষার দৃশ্য যদি বিলেতে কুড়ি শিলিং টিকেট করে দেখানো যেত তবে সেখানে সম্ভবত ভয়ানক রকম হুড়োহুড়ি পড়ে যেত।” তবে আমার ব্যক্তিগত ধারনা কোলকাতার সাহেবেরা আম পছন্দ করতো না মূলত দু’টি কারণে। প্রথমত, ইংল্যান্ড থেকে চাকরি-বাকরি নিয়ে যেসব সাহেব-সুবোরা ভারতে আসতো তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল বেরসিক, অসভ্য ও বর্বর। তা না হলে কি আমের মতো এমন ঐশ্বরিক একটি ফল না খেয়ে থাকতে পারে! দ্বিতীয়ত, আম খেতে হাত ব্যবহার করতে হয়। তারা আম খাওয়ার জন্য হাত ব্যবহার করতে সম্ভবত একেবারেই অনিচ্ছুক ছিল। তবে শশিশেখর বসুর লেখা থেকেই জানা যায়- সাহেবেরা আম পছন্দ না করলেও তাদের মেমরা কিন্তু ঠিকই লুকিয়ে চুকিয়ে আম খেতেন। মাঝে মধ্যে তাদের সাহেবদের কারণে ঘরের ভেতর আম খাওয়ার সুযোগ না পেয়ে তারা নাকি গোসলখানায় ঢুকে দামি দামি পোশাক পরিচ্ছদ গুলো সব পরিত্যাগ করে আমের আঁটি চুষতেন।
আম শুধু যে ইংরেজরাই অপছন্দ করতেন তা কিন্তু নয়। আমার মনে হয় কবিরাজ-বদ্যিদেরও আম খুব একটা পছন্দ নয়। তা না হলে কি কিছু বিশ্রি রোগের সঙ্গে আমকে যুক্ত করে দেন। যেমন- আমরক্ত, আমাশয়, আমবাত, আমফোঁড়া, আমবুলানস। আবার অন্যদিকে কিছু অপদার্থ ফলের সঙ্গে আমকে যুক্ত করে তাদের জাতে উঠানো হয়েছে- আমরুল, আমাদা, আমানি, আমসন্দেস, আমলকি, আমড়া, সাদিআম (পেয়ারা) ইত্যাদি। অন্যদিকে আমের বিভিন্ন প্রজাতির নামকরনেও দেখা যায় খাম খেয়ালীপনা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যপূর্ণ আচরণ। অনেকে হয়তো বলবেন, প্রত্যেকটি নামের পেছনেই তো একটি ইতিহাস আছে। নাম গুলো তো সেই ইতিহাস ধরেই প্রচার পেয়েছে। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে তাহলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাজটা কি। আমের মধ্যে ল্যাংড়া হচ্ছে মহারাজ। অথচ এর নাম ল্যাংড়া। মহারাজ তূল্য এই জাতের আমটির উদ্ভব ভারতের বেনারসে। সেখানকার এক খোঁড়া বা ল্যাংড়া ফকিরের নামে আমটির নামকরন করা হয়েছে। পাগল এই ল্যাংড়া ফকিরের আস্তানা থেকেই নাকি আমের এই জাতটি প্রথম সংগ্রহ করা হয়েছিল। সীতা ভোগ নামটির উদ্ভবও বেশ বিচিত্র। আমভক্ত হনুমান এতো রামভক্ত ছিলেন যে লংকার বাগানে গাছে বসে ভালো ভালো আমের আঁটি গুলো সব অযোধ্যায় ও সীতার বাপের বাড়ি মিথিলায় ছুড়েছিলেন। আর সেজন্য মিথিলায় জন্মানো আম গুলোকেই বলে সীতাভোগ। উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদে দ্বারভাঙ্গা নামক স্থানে সম্রাট বাবর সহস্রাধিক আম গাছ রোপন করেছিলেন। সেখানকার আমকে তাই বলে দ্বারভাঙ্গা আম। সেই পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের ঘটনা পানির অভাবে রংপুর অঞ্চলে আম গাছের গোড়ায় এক কৃষক হাড়ির তলায় ফুটো করে সেচের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু রাত্রিবেলা কিছু দুষ্ট ছেলেপুলে হাড়ি গুলো ভেঙ্গে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় ঐ গাছের আমই মিষ্টি ও সুস্বাদু। তখন ঐ কৃষক এই আমের নাম দেন হাড়িভাঙ্গাঁ।
এবার আম নিয়ে একটু আমার ভিন্ন ভাবনার কথা বলি। কয়েকদিন আগে মিরপুরের এক আমপট্টিতে গিয়েছিলাম কিছু আম কিনতে। আমার সঙ্গী হয়েছিলেন লেখক আব্দুল্লাহ ওমর সাইফ ও জনপ্রিয় কবি জুননু রাইন। সাইফ আমাকে বলল- ভাই জানেন নাকি বাজারে এসেছে বঙ্গবন্ধু আম। খেয়ে দেখতে পারেন ভালো হবে নিশ্চয়ই। আমি ভাবলাম সাইফ হয়তো রসিকতা করছে আমার সঙ্গে। কিন্তু কয়েকদিন পর সত্যি দেখলাম কয়েকটি অনলাইন পত্রিকা নিউজ করছে- ‘এবার বাজারে এলো বঙ্গবন্ধু আম’। নিউজ পড়ে জানলাম বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট নাকি বঙ্গবন্ধু নামে নতুন প্রজাতির একটি আম উৎপন্ন শুরু করেছে। আমি মনে মনে ভাবলাম হায় খোদা! তোষামুদির তো একটা সীমা পরিসীমা থাকা দরকার। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নামক দেশটির মহানায়ক। তার নামে হাসপাতাল হতে পারে কিংবা হতে পারে সেতু ও বড় বড় স্থাপনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আম! আমাদের দেশে প্রচলিত বেশীর ভাগ আমেরই তো কেমন বিকৃত ও অশ্লীল নাম। আম্প্রালির কথা তো আমি আমার লেখার শুরুতেই বলেছি। আমটির নাম করন করা হয়েছে একজন নগরবধু অর্থাৎ বেশ্যার নামে। তাছাড়া ল্যাংড়া, সীতাভোগ, রানীভোগ, দ্বারভাঙ্গাঁ, হাড়িভাঙ্গাঁ, হিমসাগর এগুলো কি আদৌ কোন মহান কিংবা মহিমান্বিত নাম, এসব আমের পাশে বঙ্গবন্ধুর নামে আম সত্যি বেমানান নয় কি? এ প্রসঙ্গে দু’টি গল্প মনে পড়ে গেল। গল্প দু’টি এখানে প্রাসঙ্গিক বলেই বলছি। মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর তখন সিংহাসনে। মোঘল স¤্রাটের মধ্যে বেশীর ভাগই ছিলেন বিচক্ষণ ও রুচিশীল। সব কিছুতেই ছিলো তাদের নব নব উদ্যোগ।
নতুন নতুন খাবার দাবার সৃষ্টিতেও তাদের দৃষ্টি ছিলো প্রশস্থ ও নতুনত্বে ভরা। মোঘল হেঁসেলে নাম করা সব পাচক আসতো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে। সে হোক ইরান তুর্কি কিংবা উজবেকস্থান। হাল আমলের খিচুরি নামক উপাদেয় খাদ্যটি নাকি আকবরের নির্দেশেই কোন এক ইরানী পাচক তার জন্য তৈরি করেছিলেন। আকবরেরও বেশ পছন্দ হয়েছিল খিচুরি নামক খাবারটি। তো সম্রাট জাহাঙ্গীরও তার বিখ্যাত সব পাচকদের নির্দেশ দিলেন ভালো কিছু মিষ্টান্ন ধরনের খাবার প্রস্তুত করতে। এবারও একজন ইরানী পাচক উদ্ভাবন করলেন নতুন এক মিষ্টান্ন যার নাম- জেলেবি। আমরা যাকে বলি জিলাপী। জেলেবি শব্দটি ফার্সী শব্দ যার অর্থ আড়াই প্যাঁচ। জেলেবি মিষ্টান্নটি স¤্রাট জাহাঙ্গীরের অসম্ভব পছন্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে কিছু চাটুকার ও তোষামোদকারীও জুটে গেল তার পেছনে। বলল- জাঁহাপনা এই জেলেবির নামটি বদলে আপনার নামে এর নামকরন করা হোক। স¤্রাট জাহাঙ্গীরও মনে মনে এটাই চাচ্ছিলেন তিনি বেশ খুশি হলেন এবং জেলেবির নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলেন। রাজ দরবারে কিছু বিচক্ষণ আমির ওমরাও জাহাঙ্গীরকে বোঝালেন- জেলেবির অর্থ হচ্ছে আড়াই প্যাঁচ। নামটি বেশ গোলমেলে।
জেলেবির নাম যদি হয় জাহাঙ্গীর তাহলে জনগণ ভাববে আপনার মন ও চিন্তা ভাবনাও এই জেলেবির মতোই প্যাঁচালো ও জটিল। জাহাঙ্গীর বিচক্ষণ ছিলেন। তিনি জেলেবির নাম আর পাল্টালেন না। দ্বিতীয় কাহিনীটি হলো- লর্ড ক্যানিং ভারতে বড় লাট হয়ে আসেন সিপাহী বিদ্রোহের এক বছর আগে অর্থাৎ ১৮৫৬ সালে। সেটা অবশ্য সিপাহী বিদ্রোহের পরের ঘটনা। লর্ড ক্যানিং-এর জন্মদিনে তাকে খুশী করতে কিছু চাটুকার লোকজন সিদ্ধান্ত নেন যে, একটি নতুন ধরনের মিষ্টির নামকরন তারা করবেন লর্ড ক্যানিং-এর নামে। ক্যানিং তাদের প্রস্তাবটি শুনে বেশ গম্ভীর হলেন। তিনি ছিলেন অক্সফোর্ড থেকে পাস করা মানুষ। তিনি জানতেন এসব তুচ্ছ খাবার দাবারের নাম ভবিষ্যতে টিকবে না। বরঞ্চ ভবিষ্যতে এসব নাম বিকৃত ও পরিবর্তিত হয়ে যাবে। লর্ড ক্যানিং-এর আবার তার স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা ছিল না। তাই তিনি মওকা বুঝে আয়োজকদের বললেন- মিষ্টির নামটি আমার নামে নামকরন না করে বরং আমার স্ত্রীর নামে করুন এতেই আমি বেশি খুশী হব। জন্মবার্ষিকীর সেই অনুষ্ঠানে লর্ড ক্যানিং সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন। তারই সম্মানে একটি জাম্বোসাইজের (দশ সের) একটি পান্তয়া তৈরি করে সেটার নাম দেওয়া হয়েছিল লেডিকেনি। কিন্তু আফসোস এই নামে আজ আর কোন মিষ্টান্ন খুঁজে পাওয়া যায় না।
লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ।