এস.এম.সুলতান -এদেশের শিল্পকলা জগতের এক অবিসংবাদী উজ্জ্বল ব্যাক্তিত্ব। প্রত্ন- বাঙালীর ঐতিহ্যবাহী জীবন চিত্রায়ণের বিষয় যে রূপ ও রঙ তিনি প্রয়োগ করেছেন তা তাঁকে যেমন এনে দিয়েছে স্বাতন্ত্র্যময় গৌরব তেমনি এদেশের শিল্প ভুবনে সংযোজন করেছে নতুনতর মাত্রা।
তাঁর সমগ্র জীবন ও যাপনে ছিল এক আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া। যার ছিল নিজস্ব ধরন, গড়ন এবং দর্শন। যার চিন্তার জগতের পুরোটুকু জুড়ে ছিল গ্রামীণবাংলা এবং বাংলার দরিদ্র ও নিপীড়িত কৃষক সমাজ।
আমাদের সভ্যতার প্রাণ কৃষি আর কিষাণ হল সভ্যতার নাট্যমঞ্চের একক কুশীলব।সুলতান যদি বাংলার বদলে আরবদেশে জন্ম নিতেন,মরুচারী বেদুইনদের ছবি আঁকতেন।যদি জন্মাতেন নরওয়ে,সুইডেনে তাহলে সমুদ্রচারী জেলেদের সভ্যতার পথিকৃৎ হিসেবে আঁকতেন।বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছেন বলেই এই কৃষক সভ্যতার জনপ্রিয়তা, তাদের জীবন ধরণকে আতস্থকরণ করতে পেরেছেন।সুলতানের আঁকা মানুষ যেন শুধু এই বাংলাদেশের মানুষই নয়, তারা যেন এই গোটা বিশ্বের মানব সমাজকেই প্রতিনিধিত্ব করছে,মানব উন্মেষের আদিপিতা আদমের চেহারায় যেন তারা উপস্থিত।যেখানেই মাটি শ্রমশীল কর্মিষ্ঠ মানুষের শ্রমে-যত্নে প্রসন্ন হয়ে ফুল-ফসলের বর দিয়েছে,উপহার দিয়েছে শান্ত-স্নিগ্ধ গৃহকোণ, সেখান থেকেই ত ইতিহাসের গতিচঞ্চল পথ পরিক্রমার সূচনা হয়েছে।
নাগরিক জীবনে কোনঠাসা ইট-পাথরের দালানের ভীড়ে খুজে পাওয়া একটু খানি ওই আকাশে যদি এসে আছড়ে পড়ে সমুদ্রের নীল জলরাশি,যদি সেই আকাশে সাঁতরে বেড়ায় দানবীয় নীলতিমি,বিশ্বধরার অন্তরের এই স্বপ্নঘোরে থাকা মানুষ যেমনি বিস্ময়াবিষ্ট নয়নে দৃষ্টিপাত করত,তেমনি চোখেই মানুষ আজ দেখছে সুলতানের চিত্রসন্তানদের,যেন বিমোহিত হয়ে শিল্পরূপ তৃষ্ণায় দেখছে বোহেমিয়ান এই কালজয়ী শিল্পীর শিল্পকর্ম।যেন সকল অস্পষ্টতাকে ঠেলে দিয়ে চিত্রদর্শকের দিকে সুলতানের চিত্রসন্তানেরা যেন আহবান করে,দেখ আমাদের।বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে এবং মজেছে।
যেন চিরচেনা আঁকাবাঁকা মেঠো পথের বাঁকে বাঁশ-কাঠে কিষাণের সরল আটচলা,সাথে তাদের আহ্লাদী বাছুর,পরিণতবয়স্ক গবাদিপশু। কখনো যেন নিজের ভিটে রুখতে বুক ভর দম নিয়ে উদ্ধত সুঠামকান্তি কিষাণ,সৃজনলীলায় সর্ব্যত্রই যেন ব্যস্ত,।গোটা জনপদের জনজীবনে প্রসারিত উৎপাদন শৃঙখলে আবদ্ধ সভ্যতার অভিযাত্রী অপরাজেয় মানুষ,যুগ থেকে যুগান্তর পেরিয়ে অনন্তের পথে অগ্রসর হয়েই চলেছে সর্বস্ব দিয়ে।
সুলতানের ছবিতে এই অকল্পনীয় সুঠামদেহী কিষাণ,আবেগঘন, আবেদনময়ী,স্বাস্থ্যবতী কর্মিষ্ঠা নারী আর সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা নিসর্গ,তালতমাল বৃক্ষরাজির সারি,দীঘল বাঁকের নদীতীরের দৃস্টি-শোভন চর তুলির আঁচড়ে মূর্ত করে তোলার শিল্পচেস্টা তাঁর একক প্রয়াসের ফল বললে ভুল হবে।এই শৈল্পিক প্রয়াসের অনুপ্রেরণা যেন রক্তক্ষয়ী একাত্তর, ঘুমন্ত বাঙালীর উপর বুলেট ছুড়ে কাপুরুষ মত সকল ঐশ্বর্য দখল করতে চাইলেও মাথা চারা দেয়া উদ্ভিদ মত সব কিছু থেকে যেন ফুঁড়ে বের হয়েছে নিজের অস্তিত্ব কে টিকিয়েছে,বুলেট, বোমা কামানের হুংকারে যে অতিপ্রতিরোধ্য তেজ উপলব্ধি করিয়ে জাগরণ ঘটিয়েছে সেই প্রাণশক্তি,সম্মিলিত সৃস্টিশক্তি যেন সুলতানের চিত্রপটে অস্তিত্বের জানান দেয়।মুক্তিযুদ্ধের সবটুকু আবেগ,জীবনোল্লাস,সবটুকু স্পর্ধা, অজেয় দুঃসাহস ছবিগুলো ধরে রেখেছে।
সুলতানের কৃষকেরা জীবনের সাধনায় নিমগ্ন।তারা যেন পেশিশক্তি দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গম করে প্রকৃতিকে ফুল-ফসলে সন্তানবতী হতে বাধ্যকরে।এখানেই ত জীবনের সব সংগ্রাম,সাধনা,আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন মিলে মিশে এক হয়েছে।সুলতানের এই কৃষক নেহাতই কাঙাল নয়,তারাই বাংলার প্রকৃত সন্তান,তাদের জন্যই বাংলা টিকে রয়েছে,ছবির এই মানুষ গুলোর পাখা থাকলে দেবদূতের মত আকাশে উড়াল দিত।কিন্তু তারা যেন এই মাটিকে গর্ভবতী করা,ফসলশালিনী করার ব্রতে নিয়োজিত আছেন।
সুলতান যেন অনন্য এক প্রাকৃতিক মানব।সামাজিক শৃঙ্খলার সজল বন্ধন তিনি অস্বীকার করেছেন-প্রত্যাখ্যান করেছেন ভূ-সম্পত্তি ও জাগতিক প্রতিপত্তি অর্জনের মোহ,সংসার বন্ধন ও সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে আপন অধিকারের সীমানা নির্ধারণ কিংবা পদক পুরুষ্কারের প্রতি র্নিমোহতা।এক বিশ্বজনীন মানবিক বোধ ও স্বদেশপ্রেম তাঁকে তাড়িত করেছে সেজন্যই ত ভবঘুরে বাউন্ডুলে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন ভারতবর্ষের পথে প্রান্তরে।এই চিত্র-সন্তান জন্ম দেয়ার একাগ্রপ্রায় সাধনায় নিযুক্ত থাকতে হয়েছে সারাজীবন।আর এখানেই শেখ মোহাম্মদ সুলতানের অনন্যতা।
সুলতানের জন্ম ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট নড়াইল জেলার চিত্রা নদীর পাড়ে মাছিমদিয়া গ্রামে।শিল্পী হবার মত যথেস্ট প্রেরণা বা পরিবেশ কোনটাই তার অনুকূলে ছিল না।তারপর ও তাঁর মননে শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রেই তার পিতাই তার প্রাথমিক প্রেরণা কারণ নড়াইলের দেয়ালগাত্রে তার রাজমিস্ত্রি পিতার খোদাইকৃত নকশা অবশ্যই তার মনে শিল্পসৃষ্টির বীজ বুনেছিল।
স্কুল জীবন শেষের আগেই তৎকালীন নড়াইলের জমিদার ধীরেন্দ্রনাথের উৎসাহ -প্রেরণায় কলকাতা যাত্রা ও কলকাতায় বিশিস্ট শিল্প-সমালোচক শাহেদ সোহরাওর্দীর পৃষ্ঠপোষকতায় আর্ট স্কুলে ভর্তি।গন্ডিবন্ধ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-দীক্ষা যেন তাকে হাঁপিয়ে তুলেছিল, তাই ত তিনি সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে নিরুদ্দেশের পথে পা বাড়ান এমনকি সোহরাওর্দী পরিবারের স্নেহ্নশীল অভিভাবকত্ব, পরিবারের গরিমা কিছু তাকে আটকে রাখতে পারেনি।
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল।ভবঘুরে এই বাঙালি যুবক ঘুরে বেড়াচ্ছেন কাশ্মীরের পথে-প্রান্তরে, পাহাড়ে-জঙ্গলে। আদিবাসীদের সঙ্গে দারুণ সখ্য তাঁর। তাদের সঙ্গেই থাকেন, খান, ঘুরে বেড়ান আর ছবি আঁকেন। ভয়-ভাবনা নেই,দায় দায়িত্ব,আছে শুধু সুন্দরের প্রতি সুতীব্র আকর্ষণ আর ছুটে চলার গতি।এ সময় তার আঁকা ছবি গুলো কি হয়েছে,কি এঁকেছেন এগুলোর কোনো উল্লেখ্যযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না।জানা যায় এ সময় ই তার প্রথম চিত্রপ্রদশর্নী হয় সিমলায়।
ভারত ভাগ হয়। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের করাচিতে এবং ১৯৪৯ সালে লাহোর ও করাচিতে বেশ কয়েকটি চিত্র প্রদর্শনী হয় সুলতানের। ১৯৫১ সালে চিত্রশিল্পীদের একটি আন্তর্জাতিক সম্মিলনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিতে তিনি আমেরিকায় যান। এরপর সুলতান আবার নড়াইলের মাটিতে ফিরে আসেন। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! পৈতৃক ভিটায় তার জায়গা না হলে তিনি ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের চিন্তা করেন। তৎকালীন ঢাকার নামকরা শিল্পীদের পাশে তিনি স্থান পাননি। ১৯৫৩ সালের অক্টোবরে তিনি আবার নড়াইলে ফিরে আসেন।নাগরিক সমস্ত সুযোগ প্রত্যাখান করে শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেকে স্থায়ী ভাবে স্থিত করেছেন পল্লীজীবনে।এখানে তাঁর দুটি আকর্ষণ শিশু ও প্রাণিজগৎ। শিশুকালেই তিনি মানবিক উৎকর্ষ রোপনের প্রকৃস্ট সময় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।প্রকৃতি,প্রাণী ও শিল্পকলার স্পর্শের মধ্যে তাদের বিকাশকে আর্দশতম মনে করেছেন।শিশু শিক্ষা কার্যক্রমে সংযুক্ত করতে চেয়েছেন নান্দনিক অনুশীলন, শিশুস্বর্গ নামক স্বপ্নে ছিল যার সম্পূর্ণতা প্রাপ্তির পরিকল্পনা।শিশুর শিল্পবিকাশে সুলতান বলেন-
“যে শিশু সুন্দর ছবি আঁকে, তার গ্রামের ছবি আঁকে, সে সুন্দর ফুলের ছবি আঁকে, তার জীবজন্তুর ছবি আঁকে, গাছপালার ছবি আঁকে, সে কোনোদিন অপরাধ করতে পারে না, সে কোনোদিন কাউকে ব্যথা দিতে পারে না।”
এরপর সুলতান প্রদর্শনী করেন ১৯৭৬ সালে ঢাকায়।১৯৫৩ সালে নির্বাসনে যাওয়ার পর এই ২৩ বছরে তিনি কি করেছেন?সুলতানের নিজের বয়ানেই তিনি বলেছেন তিনি ছবি আঁকেননি বললেই চলে।বলা যেতে পারে এই সময়কাল তার গর্ভযন্ত্রণাকাল,যথার্থ শিল্পভাষা,শিল্পরস অনুসন্ধান,আত্ন-আবিষ্কারের রক্তাক্ত সাধনার কাল।
পল্লীজীবনে তার পল্লীমানস ই যেন মেনে নিতে চায় না তাঁকে।কারণ তিনি ত তথাকথিত প্রথায় সম্পৃক্ত নন।রহস্য আবরণে নিজেকে এক সন্ত,দরবেশ, খ্যাপাটে বৈরাগী হিসেবেই যেন উপস্থাপন করেন তিনি।গ্রামীণ পরিমণ্ডলেও সবাইকে সাথে নিনিয়েও যেন তিনি বহিরাগত।
তারপরও, এ নন্দিত শিল্পী তার বিরাট রাজত্বের রাজধানী হিসেবে শহরকে বেছে নেননি। শহুরে বিলাসিতা ছেড়ে চলে যান তার শৈশবের নদী চিত্রা নদীর কাছে, নড়াইলের গ্রাম্য জীবনে, পশু-পাখির মাঝে।
যেখানে তিনি প্রকৃতির সন্তান, প্রকৃতির সুর তোলেন বাঁশিতে আর তুলির আঁচড়ে আঁকেন মানবজীবন। ১৯৮৭ সালে জার্মান কালচারাল ইনস্টিটিউটে ১০০টিরও বেশি ছবি নিয়ে আরও একটি একক চিত্র প্রদর্শনী হয় সুলতানের। তখন তিনি শিল্পে বিশ্বশাসনে মশগুল। এ প্রদর্শনী পরিদর্শন করে ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা জেভিটস বলেছিলেন, ‘এ উপমহাদেশের গুটিকয় অসামান্য শিল্পীর মাঝে সবচেয়ে জমকালো সুলতান। তিনি এশিয়ার কণ্ঠস্বর। সুলতানের শক্তির উৎস তার টিকে থাকার ক্ষমতায়। যেসব মানবমূর্তি তিনি রচনা করেছেন, তারা জীবনযুদ্ধে মানুষের টিকে থাকার বার্তাবহ। বাংলাদেশ আর বাংলাদেশিদের টিকে থাকার ক্ষমতা ছাড়া তেমন আর কিছু নেই। তার ছবিতে এ জাতির স্বকীয়তার প্রতীক শনাক্ত করা যায়।
আজ সুলতানের ৯৭ তম জন্মবার্ষিকী। সুলতান বাংলার চিত্রকর্মে বীর প্রতিষ্ঠাকারী।আগামীতে যাদের সাধনায় সংগ্রামে বাংলার ইতিহাস পাবে গতি,সেই অনাহারক্লিষ্ট, রোগগ্রস্ত, ন্যুজদেহী কিষাণ-কিষাণীকে আকলেন বীর করে,অপরাজেয় বীরের সৌন্দর্য সৌষ্ঠব চারিয়ে দিয়েছেন সুলতান কিষাণ কিষাণীর শরীরে। অমর হয়ে থাকুক বাংলার চিত্রকলার অদম্য বিষ্ময় সুলতানের চিত্রসন্তানেরা।
লেখক : চিত্র শিল্পী ।