প্রাত:ভ্রমণ শেষে পার্ক থেকে বের হয়ে প্রতিদিন দু’একজন ভিখারি যারা বসা থাকে তাদেরকে কিছু খুচরো টাকা দিই। আজকেও (২৪ আগস্ট ২০২১) সেরকম ভিখারির জমায়েত দেখে প্রথমে একজনকে দিলাম। দ্বিতীয় ভিখারিনীর কোলে ছোট্ট একটা বাচ্চা। আমি হাঁটতে হাঁটতে তাকে অন্যমনষ্ক ভাবে টাকাটা যখন সাধছিলাম, দেখি সে নিচ্ছে না। আমি থমকে দাঁড়ালাম। অবাক হয়ে বললাম, ‘‘নো, লবি?” (নিবি না?) এ সময় আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। বিশ বাইশ বছরের এক তরুণী মেয়ে। ভাঙা চেহারা, যেমনটি প্রায় ভিখারিনীদের হয়। পরনেও মলিন বেশবাস। কিন্তু তার মুখে দেখলাম ঘৃণা। আমার হাতে টাকা নয়, যেন মরা ইঁদুর দেখছে এভাবে সারা মুখে ঘৃণার ভাব প্রকাশ করে বললো, “না, আমি কেন নেব?” পাশে একটা সি এন জি দাঁড়ানো ছিলো। ড্রাইভার হেসে বললো, “না, সে এমনি আসছে।” আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। মেয়েটি ভিখারিনী নয়, কোন বাসার কাজের মেয়ে বা বুয়া। ঘরের বাচ্চাটাকে নিয়ে ঘোরাতে বের হয়েছে।
এই ঘটনা দেখলাম আমার মনে প্রবল প্রতিক্রিয়া শুরু করলো। পার্ক থেকে বাসায় পৌঁছানো, লিফট দিয়ে ঘরে ঢোকা, বাথরুমের যাবতীয় কাজ সেরে নাস্তায় বসা, নাস্তা করার সময় দূর-প্রবাসী ছেলের সঙ্গে প্রায় চল্লিশ মিনিট মেসেঞ্জারে লাইভ টক করার সময়ও পার্কের ঘটনাটাই নাটাই থেকে সূতো ছাড়ার মতো পল্লবিত হতে হতে আমাকে ল্যাপটপের সামনে বসিয়ে দিলো। তাই লিখছি।
দেখলাম, মেয়েটিকে যে আমি ভিখারিনী মনে করেছি, এটি এডওয়ার্ড সাইদের প্রাক-ধারণার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। সাইদ তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ “ওরিয়েন্টালিজম” (১৯৭৮)-এ তাঁর বিখ্যাত তত্ত্ব “প্রাচ্যবাদ” বলতে এমন একটি প্রাক-ধারণাকে বুঝিয়েছিলেন যার ফলে পশ্চিমা বুদ্ধিজীবী সমাজের একটি ভুল চর্চার প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেছিলেন তাঁরা প্রাচ্যকে যেভাবে দেখতে চেয়েছিলেন, সেভাবে সাহিত্যে এবং মননশীল রচনায় প্রকাশ করেছেন, যে বর্ণনার সঙ্গে প্রাচ্যদেশগুলোর প্রকৃত রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার কোন মিল নেই। এই বাস্তবতা বিবর্জিত কাল্পনিক, প্রাক-ধারণাপ্রসূত বর্ণনার চর্চাকে তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘প্রাচ্যবাদ’।
আমিও এই প্রাক-ধারণা থেকে এক ভিখারিনীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি মেয়েকে দেখে ভেবেই নিলাম যে সেও ভিখারিনী হবে। । এবং এই মজার ডেভেলপমেন্টটা নিয়েও ভাবলাম। বুয়াটি যখন বাসায় গিয়ে গৃহকর্ত্রীকে বলবে (বলবে কিনা সেটা নির্ভর করছে, বাসার লোকজনের ব্যবহারের ওপর), তারা হয় ভাববে লোকটা একটা অভদ্র লোক, কেন তাদের বুয়াকে ভিখিারিনী মনে করবে! নচেৎ ভাববে, তাদের কাজের মেয়েটিকে আরেকটু বেশবাস বদলে রাস্তায় যেতে বলবে, যাতে কেউ তাকে ভিখারিনী মনে না করে। কিংবা দুষবে তাকে, কেন সে ভিখারিনীদের দলের কাছাকাছি ঘুরছিলো। অথবা আরো সংবেদনশীল গৃহস্বামী বা গৃহ-স্ত্রী হলে ভাববে, তাদের এই আদরের ফুটফুটে বাচ্চাকে দেখেও কেন ঐ (অ)ভদ্রলোকটা বুঝতে পারলো না যে একটা বাসার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে একজন কাজের বুয়া রাস্তার খোলা হাওয়ায় হাঁটতে বের হয়েছে।
সাহিত্যের একটু প্রসঙ্গ টেনে সাইদের প্রাক-ধারণার কথায় আবার আসি। ই, এম, ফর্স্টারের বিখ্যাত উপন্যাস “আ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া” উপন্যাসে ইংরেজ রমণী এডেলা কোয়েস্টেড ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসেছেন শুধু বেড়াতে নয়, ইংরেজ নবীন প্রশাসক রনি হিসলপকে বিয়ে করার জন্যও। ভ্রমণ সূচির এক পর্যায়ে ঠিক হয় এডেলা কোয়েস্টেড, বৃদ্ধা ইংরেজ রমণী মিসেস মুর এবং ভারতীয় মুসলমান চিকিৎসক ডাক্তার আজিজ এবং আরো কতিপয় লোক শহরের কাছে মালাবার কেইভস দেখতে যাবেন। এক পর্যায়ে গুহার অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গায় তরুণী এডেলা কোয়েস্টেড হঠাৎ চিৎকার দিয়ে গুহা থেকে বের হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তখন গুহাভ্যন্তরে তাঁর সঙ্গে ছিলেন ড. আজিজ। দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে বলা হলো যে ড. আজিজ এডেলাকে ধর্ষণ করতে চেয়েছিলেন। এটি অপ্রমাণিত থেকে যায়। কিন্তু পুরো উপন্যাসটি এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভারতীয়দের সঙ্গে ইংরেজ প্রশাসনের ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে সাংঘর্ষিক বিষয় নিয়ে চমৎকার একটি আলেখ্য তৈরি করে। সাইদ কথিত প্রাক-ধারণাটি এখানে কাজ করছে এভাবে যে এডেলা বা তথা ইংরেজদের মনে এই ধারণা কাজ করছিলো যে ভারতীয় পুরুষ মাত্রই নারী দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, এবং মুসলমান পুরুষ হলেতো কথাই নেই। এখানে আজকে আমার ক্ষেত্রে যে ভুল হয়েছে, এডেলার চোখেও সে একই ভুল হয়েছে। আমি যেমন রাস্তায় ভাঙা চেহারার মেয়ে মানুষ দেখলেই ভিখারিনী মনে করি, তেমনি এডেলার চোখে সমস্ত পূর্ব-দেশীয় পুরুষ মাত্রই নারীলোভী। অর্থাৎ, ভারতীয়দের মধ্যে যে সে একজন শিক্ষিত ডাক্তারের সঙ্গে ভ্রমণে বেরিয়েছে, এবং তাঁর সঙ্গী যে সাধারণ ভারতীয়দের চেয়ে শিক্ষায় এবং পেশায় উচ্চতর অবস্থানে আছেন—এই ভিন্নতাটুকু এডেলার চোখে ধরাই পড়েনি। তাঁর কাছে সব ভারতীয় পুরুষ মানেই হচ্ছে এক একজন ধর্ষণাসক্ত পুরুষ, পোটেনশিয়াল রেপিস্ট। ঠিক গতকালই একটা ভিডিও ট্রল হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে ফেরত আসা জনৈক ভারতীয়-বাঙালী সাংবাদিক বলছেন যে তালেবানদেরকে নিয়ে যত প্রচার তার মধ্যে বেশিরভাগই পশ্চিমা মিডিয়ার অপপ্রচার। যদিও তালেবানদের সম্পর্কে আমাদের প্রাক-ধারণার সঙ্গে সাংবাদিকজনের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ মিলছে না, তবুও তাঁর কথাকে গুরুত্ব দিতে হবে, কারণ তিনি একটি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এসেছেন।
আবার প্রাক-ধারণা থেকে কী হয়, সেটি চার্চিলের মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে উক্তি নিয়ে বোঝা যায়। প্রহসণসহকারে গান্ধীকে চার্চিল ডেকেছিলেন, দ্য ন্যাকিড ফকির অব ইন্ডিয়া (ভারতের ন্যাংটা ফকির)। অথচ সে ন্যাংটা ফকিরই ভারতের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর শুধু তহবন পরে নগ্ন হাঁটু ও চপ্পল পরে ১৯৩১ সালে রাজা জর্রজের সঙ্গে শীতের সময়ে দেখা করতে যাওয়াটা পুরো পশ্চিমা মিডিয়াকে বিস্ময়ের চূড়ান্তে নিয়ে গেছিলো, কেননা গান্ধীর বেশবাস ছিলো পশ্চিমা শীতের প্রেক্ষাপটে প্রাক-ধারণার বাইরে, যেখানে উপস্থিত সবাই ভারী ওভারকোট পরে শীত ঠেকাতে ব্যস্ত, সেখানে গান্ধীজী ছিলেন নিতান্তই ক্ষীণ পরিচ্ছেদধারী। আর প্রাক-ধারণা থেকে উৎসকৃত একটা হাস্যরসমূলক গল্প বলে আজকের প্রসঙ্গের ইতি টানবো।
চীনের এখনকার মহাক্রমশালী অগ্রযাত্রা দেখে এক আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ মহিলা বেইজিং গেছেন বেড়াতে। তিনি একটা পার্কে গেলেন, এবং একটু ভালো সময় কাটাবেন এই ভেবে একজন চীনা যুবকের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতালেন। এক কথা থেকে আরেক কথায় গড়াতে গড়াতে চীনা যুবক ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে মহিলাকে তার ফ্ল্যাটে দাওয়াৎ দিলো। মহিলা সাগ্রহে দাওয়াৎখানি গ্রহণ করে যুবকের ফ্ল্যাটে উপস্থিত হলেন সন্ধ্যার পরপর। দুজনের মধ্যে অনেকক্ষণ গল্প চললো, ডিনার হলো, এবং মহিলার মন চাইলো আরো আনন্দ। এই বলে তাঁরা যুবকের শয়নকক্ষে ঢুকলেন। প্রথমবার আনন্দের কাজটি সারার পর যুবক বলল, আমি একটু আসি। এ বলে সে খাটের তলার এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে এলো। মহিলা খুশি, কারণ আনন্দ দ্বিতীয়বার হলো। যুবক আবার মহিলার অনুমতি নিয়ে খাটের তলার এক পাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বের হলো। আবার আনন্দ হলো। আবার যুবক খাটের তলার এক পাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বের হলো। আবার আনন্দ। আবারো যুবক সেই একই ভাবে খাটের এক পাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বের হয়ে এলে আবার আনন্দ। এভাবে পাঁচবার আনন্দ শেষ হলে, ষষ্ঠবারের সময় মহিলার সন্দেহ হলো। এত আনন্দ কীভাবে হয়! তখন মহিলা খাটের নীচে উঁকি দিয়ে দেখলেন, ছয়জন চাইনিজ যুবক খাটের নীচে শুয়ে আছে।
ভদ্রমহিলার এই বিপর্যয়টুকু ঘটলো প্রাক-ধারণা থেকে। এখানে প্রাক-ধারণার ভিত্তি হচ্ছে শারীরিক। কারণ, চাইনিজদের নাক সাধারণত বোঁচা হয়। ভদ্রমহিলা এক বোঁচা নাকের সঙ্গে আরেক বোঁচা নাকের পার্থক্য ধরতে পারেন নি, যেমন এডেলা পারেননি ডাক্তার আজিজকে আলাদা করে দেখতে, বা আমি পারিনি ভিখারিনী থেকে বুয়া বা কাজের মেয়েকে আলাদা করে দেখতে। আমাদের অধিকাংশ সমস্যা, তা হোক না কেন ব্যক্তিগত, বৈবাহিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রীক, সব সমস্যাই এই প্রাক-ধারণা থেকে উৎসারিত।
=শেষ=
২৪ আগস্ট ২০২১