আমার চাচা কবি ওহীদুল আলম (১৯১১-১৯৯৮) প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক ছিলেন। তিনি খুব হাঁটতেন, আর হাঁটার সময় রাস্তার যাবতীয় দেয়ালগাত্রের লিখন, সাইন বোর্ডের লেখার বানান এবং বাক্যের ভুল ধরে মজা পেতেন। তিনি খুব রসিক লোক ছিলেন আর পারিবারিক পর্যায়ে এই ভুলগুলো নিয়ে সরস গল্প জুড়তেন। একদিন বললেন, তাঁর সাথে হাঁটছিলেন সালেহ কার্পেটের মালিক সালেহ সাহেব। তাঁরা পরষ্পর বন্ধুস্থানীয় ছিলেন। সালেহ সাহেব ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ‘ওহীদ, তোমার এই সব বানান ভুল ধরে লাভ কী?’
যখনই বানান সমস্যা নিয়ে আমার মাথায় চিন্তা চক্কর দিয়ে ওঠে, তখনই এ গল্পটা আমার মনে পড়ে। এখন মনে হয় করোনার মহামারির সঙ্গে সঙ্গে বানান ভুলের মহামারিতে জাতি একটি বিশাল স্নানে আছে। সালেহ সাহেবের অর্ধৈযতা এখন পুরো জাতির মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। বুদ্ধদেব বসু তাঁর “আমার যৌবন” শীর্ষক আত্মকথায় লিখছেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে যখন তিনি এম, এ পরীক্ষার লিখিত পর্ব শেষ করে মৌখিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলেন, তখন একজন পরীক্ষক তাঁর একটি খাতা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তুমি এ বানানটা ভুল লিখেছো কেন?’ বুদ্ধদেব বসু দমবার পাত্র নন। বললেন, ‘ইটনের হেডমাস্টারও বানান ভুল করেন।’ সাথে সাথে পরীক্ষক গর্জে উঠে বললেন, ‘বাট, হি ডাজন্ট ফাম্বল’। অর্থাৎ, ভুল বানান নিয়ে তাঁর বিভ্রান্তি থাকে না।
প্রায় ছাব্বিশ/ সাতাশ বছর আগে ঢাকার বাংলা বাজার থেকে আমার প্রথম একটি বই প্রকাশের প্রস্তুতিকালে যখন প্রকাশক সম্পাদিত পান্ডুলিপিটি আমাকে একবার চোখ বুলানোর জন্য ফেরত পাঠালেন, আমি দেখে অবাক হয়ে গেলাম যে পুরো পান্ডুলিপি লাল কালির সংশোধনে ভরা। এতো ভুল আমি করলাম–বাক্য গঠনে, বানানকরণে ! মুষড়ে পড়লাম। যাঁরা লেখালেখি করেন তাঁরা জানেন, প্রতিটা ভুল লাল বিষ পিঁপড়ার কামড়ের মতো বোধ হয়। তখন মনে হয়, ‘ধুৎ, লেখাপড়া কিচ্ছু শিখলাম না।’ এই অশান্তি থেকে শান্তি পেলাম বহু বছর পরে, যখন আমার ভাগ্যে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসের একটি প্রকাশিতব্য গ্রন্থের পান্ডুলিপি অনলাইনে পড়ার সুযোগ হয়। অবাক হয়ে দেখলাম বিশ্বের নাম করা অনেক লেখকের লেখার ওপর অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা দপ্তরের পেশাধারী সম্পাদনা বিভাগ এমন নির্মমভাবে জোর কাঁচি চালিয়েছেন যে এমনকি পাঠক হিসেবে আমারই মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। বুঝলাম যে পশ্চিমা প্রকাশনা সংস্থার সম্পাদনার দপ্তরগুলো কেমন উচ্চ পর্যায়ের সম্পাদনার মান ধরে রাখেন।
তখন মনটা সহজ হলো, এবং এখন সম্পাদনার কাটা-ছেঁড়া আর পিঁপড়ার কামড় মনে হয় না। লিখলেই বানান ভুল হবে, বাক্য ভুল হবে, এবং সম্পাদনা লেখক নিজেও করতে পারেন, বা সম্পাদনা পরিষদও করতে পারেন। তবে একজন পাচক যেমন তাঁর রান্নার শ্রেষ্ঠটি পরিবেশন করতে চান, তেমনি একজন লেখকও চান তাঁর লেখাটি সর্বাংশে নির্ভুলভাবে ছাপাতে।
এখন মূল কথায় আসি। এই যে সম্পাদনা পরিষদ বললাম, এটা কে বা কারা? প্রুফটা কে বা কারা দেখবে? বুঝলাম প্রতিটা প্রথম শ্রেণির প্রকাশনা সংস্থার হয়তো পেশাদারীত্ব নিয়ে সম্পাদনা করার পর্ষদ আছে। হয়তো বাংলা একাডেমি আছে। আমার বন্ধু বিশিষ্ট লেখক মোরশেদ শফিউল হাসান তাঁর বাংলা বানান সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে রচিত পরপর দু’টো লেখায় বানানরীতির কোন গ্রহণযোগ্য একক নীতি গৃহীত না হওয়াতে তাঁর খেদ প্রকাশ করেও মতামত দিয়েছেন মোটামুটিভাবে বানানের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির অভিধানগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে। যদিও ‘ঈদ’কে ‘ইদ’ লেখা আমার মতো তিনিও গ্রহণ করতে পারেন নি। এই ক্ষেত্রে মোরশেদ প্রচলিত বানান ব্যবহারের পক্ষপাতি, এবং আমিও তাই।
কিছুদিন আগে ফেইসবুকে আমার টাইমলাইনে একটি ঘোষণায় বলেছিলাম যে “সাহিত্যপাঠ: তত্ত্ব ও তালাশ” শীর্ষক আমার একটি প্রবন্ধগ্রন্থের পান্ডুলিপি আমি তৈরি করছিলাম। তৈরি করতে গিয়ে ‘নত্ব-বিধান’, ‘সত্ব-বিধান’ নিয়ে যেমন মুশকিলে পড়লাম, তেমনি ক্রিয়াপদের বানান নিয়ে মহা ফ্যাসাদে পড়লাম। ‘গোপন’ শব্দটা এখনো বারবার আমার অভিধান দেখে ঠিক করে নিতে হয়। আমার মন চাই ‘গোপণ’ লিখতে—যেন ‘ণ’-এর আলাদা কোন আঁতাত আছে গোপনীয়তার সঙ্গে!
সে যাই হোক, আমার আগের বইগুলোতে আমি মোটামুটি আকার-ওকার ছাড়া ক্রিয়াপদ ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলাম। যেমন, ‘করল’, ‘বলল’, ‘ভুলল’, ‘ছিল’, ‘করেছিল’, ‘লিখল’ ইত্যাদি। অন্যদিকে ‘দাঁড়াল’, ‘বানাল’, ‘নামাল’ ইত্যাদি। বা আরো অন্যদিকে ‘হত’, ‘হন’ ইত্যাদি। শেষের দু’টো বানান নিয়ে সুব্রত বড়ুয়া দাদা একদিন বলেছিলেন, ‘হত’ ক্রিয়াপদ হলে ‘হত’ (নিহত)-র সঙ্গে বিভ্রান্তি হয়। আবার ‘হন’কে ‘হোন’ লিখলে খুব বেমানান শোনায়। তাই আমি ‘হত’-কে ‘হতো’ লিখলেও, ‘হন’-কে ‘হোন’ করলাম না। কিন্তু ‘ভাল’-কে ‘ভালো’ এবং ‘মত’-কে তুলনার অর্থে ‘মতো’লিখলাম।
আবার মীর মোশাররফ হোসেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম-এঁরা সবাই ‘বলল’, ‘চলল’ লিখেছেন, কিন্তু সবাই আবার ‘ভালো’, আর ‘মতো’লিখেছেন। বুদ্ধদেব বসু অবশ্য ‘বললো’, ‘চললো’ লিখেছেন।
লেটার প্রেস থেকে কম্প্যুটার যুগে আসার ফলে লেখার সঙ্গে সময়ের সম্পর্কটা পুর্নবিন্যাসিত হবার সুযোগ বেড়েছে। এখন একজন লেখক ঘন্টায় লেখার তোড়ে থাকলে কতো (রবীন্দ্রনাথের বানান ‘কত’) শব্দ ঢোকাতে পারেন তার একটা হিসাব নীচের বারেই ফুটে ওঠে। (যেমন এই লেখাটা লিখতে বসেছি সকাল দশটায়। এখন ঠিক এগারোটা। অর্থাৎ এক ঘন্টায় এ পর্যন্ত ৬২১ শব্দ ঢুকেছে দেখতে পাচ্ছি। অবশ্য চিন্তা ইত্যাদি সব মিলিয়ে এই হিসাবের তারতম্য একই লেখকের ক্ষেত্রে বা বিভিন্ন লেখকের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হবে, তা’তে সন্দেহ নেই।) তাই আকার-ওকার বর্জন করাটাই সময়সাশ্রয়ী ব্যাপার হবে। ‘চলল’ টাইপ করলে যে সময়টা যাবে, ‘চললো’ লিখলে তার চেয়ে বেশি যাবে।
তবে আকার-ওকার দিলে শব্দে শব্দে বিভ্রান্তি কমে সেটা ঠিক। যেমন ‘বানান’লিখলে ‘বানানো’ ক্রিয়াপদ না বুঝে, বিশেষ্যপদ ‘বানান’বোঝার ঝামেলা আছে। কিন্তু ‘বানানো’ (তৈরিকৃত অর্থে ) বললে অর্থের ভুল হবার আশংকা নেই।
আরেকটা ভুল আমরা প্রায়শই করি। সেটি হচ্ছে সমাপিকা ক্রিয়া আর অসমাপিকা ক্রিয়ার মধ্যে ধন্ধ। যে কাজটি নিত্য বর্তমান হিসেবে সম্পাদিত হয় সে কাজটির বর্ণনায় বানান হবে, ‘ওঠে’, ‘জোটে’, ‘ফোটে’, ‘লেখে’ ইত্যাদি। যেমন ‘সূর্য সকালে ওঠে’, ‘কাজ করলে খাদ্য জোটে’, ‘ফুল ফোটে’, ‘কী লেখে সে এতো?’ কিন্তু অন্যদিকে, ‘সূর্য উঠে গেল’। ‘খাদ্য জুটে গেল।’ ‘ফুল ফুটে গেল।’ ‘সে লিখে ফেললো’ ইত্যাদি। এই ক্রিয়াপদগুলো অসমাপিকা, সেগুলোকে সম্পন্ন করতে দ্বিতীয় একটি ক্রিয়াপদ লাগে। (এখানে লক্ষ করার আরো বিষয় হলো আমি ‘গেল’ লিখলেও ‘ফেললো’ লিখেছি। অথচ ধারবাহিকতা অনুসারে আমার লেখা উচিত ছিলো হয়, ‘গেলো’ এবং ‘ফেললো’ নচেৎ ‘গেল’ এবং ‘ফেলল’।
‘লক্ষ’ শব্দটা ওপরে ক্রিয়াপদ ‘দেখার’ অর্থে এসেছে। আর এর বিশেষ্যপদ হচ্ছে সংখ্যাবাচক ‘লক্ষ’, আর এর সঙ্গে য-ফলা জুড়ে দিলে হয় অভীষ্ট=লক্ষ্য। যেমন নকীব খানের গান–‘যদি লক্ষ্য থাকে অটুট।’ তাই লক্ষণীয় বিষয়, লক্ষ্যণীয় বিষয় নয়।
আমার অগ্রজসম কবি-বন্ধু স্বপন দত্ত (স্বপন দা) (কবি আবুল হাসানের একদা গৃহীত রীতি ও পরে বর্জিত) অনুসারে লেখেন, ‘যখোন’, ‘এখোন’, ‘তখোন’–অর্থাৎ তিনি উচ্চারণ অনুসারে বানান লেখার পক্ষপাতি, যদিও এটা দুর্বল যুক্তি। বস্তুত ইংরেজিতেও দেখি, উচ্চারণ অনুসারে বানান লেখা হয় না।
আমার একজন অনুজপ্রতিম বন্ধু দেবব্রত বিষ্ণু চক্রবর্তী একটি প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকায় কর্মরত। সেখানে ছাপানো আমার সব লেখায় সম্মানসূচক ‘চন্দ্রবিন্দুর’ ব্যবহার বর্জিত। পড়তে গিয়ে কান্না আসে। যেমন ‘বঙ্গবন্ধু, তাঁর স্বপ্ন’নয়, ‘বঙ্গবন্ধু, তার স্বপ্ন’–কেমন লাগে! বিষ্ণুকে বলি, ‘এই মিঞা, এটা কী হইলো?’ সে চাপা হাসে। জানে যে, স্যারতো খ্যাতি-প্রত্যাশী। লেখা দেবেনই।
বাংলা বাজারের এক সিনিয়র প্রকাশক বললেন, তাঁরা উহ্য চিহ্ন (’) আর ব্যবহার করেন না। যেমন, ‘দু’জনের’ জায়গায় তাঁরা গ্রহণ করবেন, ‘দুজন’, ‘তা’তে-র জায়গায় ‘তাতে’ ইত্যাদি।
যে কোন ভাষায় বানান কিন্তু একটা মজার বিষয়।
এই মজায় মজে থাকতে আমার মজ্জাগত ইচ্ছা।
সবাইকে একটা বাহারী বানানের শুভেচ্ছা দিয়ে আজকের বানান-বিষয়ক বানানো লেখাটি বানিয়ে পরিবেশন করলাম।
বানানটি নয়, শব্দটি এসেছে নারায়ণ গঙ্গ্যোপাধ্যায়ের ‘টেনিদা’ সিরিজের কোন একটি গল্প থেকে। টেনিদাকে মধ্যমণি করে একটা ঘরে দারুণ আড্ডা জমেছে। কেউ একজন উচ্চারণ করলো, ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’–আর শব্দটা উচ্চারণের সাথে সাথে ঘরের চালা ধুম করে মাথার ওপর ভেঙ্গে পড়লো।
বানান নিয়ে আমিও কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
=শেষ=
৩ সেপ্টেম্বর ২০২১