করোনার আগের আগের কথা। সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে আমন্ত্রণ পেলাম শেক্সপিয়ারের ওপর একটি বক্তৃতা দিতে। নির্দিষ্ট দিনে ইউ এস বাংলার সকালের ফ্লাইটে ঢাকা পৌঁছালাম। কানেকটিং ফ্লাইট ধরে সিলেট যাবো। প্লেন থেকে সিলেটের দিকে নামার সময় ল্যানস্কেপ খুব সুন্দর দেখায়। বিকেল হচ্ছে হচ্ছে। চড়াই-উৎরাইয়ের দৃশ্য উপভোগ করতে করতে এক সময়ে ভ্রমণ শেষ হলে প্লেন থেকে নামলাম। এয়ারপোর্ট থেকে হেঁটে এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে ঢুকবো, মনে হলো ট্রাউজারটা কোমরে থাকছে না। বারবার নীচে নেমে আসছে। কোমরে হাত দিয়ে বুঝলাম, বেল্টটা ঢাকা এয়ারপোর্টে সিকিউরিটি চেক করার সময় কোমর থেকে যে খুলে রানিং ট্রেতে দিয়েছিলাম, সেটা নিতে ভুলে গেছি। আর সেদিন সকাল থেকেই আমার বিখ্যাত সর্দিটা শুরু হয়েছে। সৈয়দ মুজতবা আলীর বিখ্যাত রম্য গল্প “বেঁচে থাকো সর্দি-কাশি”-র দুই জার্মান নদী রাইন আর ওডারের বদলে আমার দু’নাক দিয়ে সুরমা আর কুশিয়ারা বইয়ে যাচ্ছে। আমাদের চবি’র ইংরেজির একদা ছাত্র মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, তখন সাস্টের ইংরেজির সহকারী অধ্যাপক, আমাকে রিসিভ করতে আসলে, এক বিরাট হ্যাঁচ্চো দিয়ে তাকে ‘হ্যালো’ বললাম।
এক দিকে নাক, আরেক দিকে কোমর, দু’টোর নাজুক অবস্থার মধ্যে ‘কাম হোয়াট মে’ করে ঝাড়া এক ঘন্টার একটা বক্তৃতা দিলাম। কিছু প্রশ্নোত্তরও হলো। মনে হলো, ভালোভাবে উৎরে গেলাম। সর্দি তেমন বাগড়া দিলো না। বক্তৃতা শেষে শফিককে বললাম, শফিক, চলো, আমাকে একটু কোন মার্কেটে নিয়ে চলো, বেল্ট লাগবেই। এক রাত্রের থাকা। একটা মাত্র ট্রাউজার। সর্দিটা না হয় পিল খেয়ে বাগে আনা যাবে। শফিক বললো, চলেন স্যার। সাস্ট ক্যাম্পাস শহর থেকে একটু বাইরে। আমরা একটা অটো ঠিক করবো, তখন নীচে নেমে আসছিলেন ইংরেজি বিভাগেরই আরেকজন শিক্ষক, সহযোগী অধ্যাপক ড. আফরোজা খানম। তিনি বললেন, তিনি শহরে ফিরবেন, তিনি আমাদেরকে রাইড দিতে ইচ্ছুক। আমরা ক্যাম্পাস থেকে মেইন রোডে পৌঁছাবো, আবার শুরু হলো আমার সেই হাঁচি। তখন আফরোজা শফিককে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা মার্কেটে কী কাজে যাচ্ছি, আর রাত হয়ে গেছে মার্কেট বন্ধও হয়ে যেতে পারে। শফিক বললো, স্যারের বেল্ট ফেলে এসেছেন ঢাকা এয়ারপোর্টে, একটা বেল্ট কিনতে হবে তাই। আফরোজা এক মিনিট ভেবে বললেন, স্যার, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমার হাজব্যান্ড এই ধরনের অনেক গিফট পান। আমি স্যার আপনার জন্য কালকে সকালেই ঐখান থেকে একটা বেল্ট নিয়ে আসবো। আমি সাথে সাথে রাজি হলাম। আমার ভয় হচ্ছিলো, সর্দিটা যদি জ্বরের দিকে যায়, রাত কাটানো আমার জন্য কঠিন হবে। আফরোজার স্বামী পেশায় হৃদযন্ত্রের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের কার্ডিওলোজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
সে রাত সাস্টের গেস্ট হাউজে আমার জঘন্যতম একটি রাত গেল। আমি হাঁচি-সমৃদ্ধ লোক। কিন্তু সে রাতে মনে হয় দুয়ারগুলি আমার ভাংলো হাঁচিতে। সর্দিতে আমার ক্যারি করা সব রুমাল ভিজে একাকার। এক ফোঁটা ঘুম এলোনা অনেক রাত অবধি। এটা ভাবলাম, ঐটা পড়লাম মোবাইলে, ফেবুতেও খানিকটা কিচিরমিচির করলাম। কিন্তু রাত আর কাটে না। যাই হোক ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে নীচে নাস্তার টেবিলে বসেছি। দেখি আফরোজা সত্যি সত্যি হাজির। সাথে তাঁর স্বামী। দু’জনকেই এক পলক এক সাথে দেখে মনে মনে রায় দিলাম, দে আর আ হ্যাপি কাপল। আফরোজা বেল্টের বদলে পুরো একটা গিফট প্যাকেট নিয়ে এসেছেন। ইতালির বিখ্যাত চামড়ার পণ্য প্রস্তুতকারী গুচ্চির গিফট প্যাকেট। সাপের চামড়ার একটি বেল্ট, একটি টাই, টাইয়ের রোল, আর একটি একই বাদামী রঙের চামড়ার মানি ব্যাগ। সাথে সাথে আমি বেল্টটা কোমরে পরে নিলাম, বেইজ্জতি থেকে রক্ষা পেলাম। এর পর আবার ইংরেজি বিভাগে গিয়ে একটা মডারেশনের কাজ ছিলো, সেটাতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থিত থাকলাম। আফরোজার গিফট প্যাকেট থেকে টাইটা খুব কায়দা করে পরলাম, একটু বেশবাসে চটক আনার জন্য। তারপর লাঞ্চ হলো। তারপর বিদায়।
সিলেট থেকে ঢাকার ফ্লাইট দুপুরে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের ফ্লাইট রাত ন’টায়। ঢাকায় পৌঁছে ভেবেছিলাম শহরে বের হবো। কিন্তু দেখলাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিম সেদিন বাংলাদেশে খেলতে এসেছে, তাই এয়ারপোর্ট রোডে হাই সিকিউরিটি থাকাতে ট্রাফিক জ্যামে পড়বো ভেবে আর বের হলাম না। তখন মনে হলো, অনুসন্ধান করে দেখি না, গতকাল যে বেল্ট ফেলে গেছিলাম সেটি ফেরত পাওয়া যায় কিনা। সিকিরিউটি বেল্টের কাছে দাঁড়ানো নিরাপত্তা অফিসার (প্লেইন ড্রেস)-কে বললাম যে গতকাল সিলেট যাবার সময় আমি বেল্ট খুলে আবার পরতে ভুলে গেছিলাম। তিনি আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন, ক’টার ফ্লাইটে কোথায় গেছিলাম জেনে নিলেন, আমার টেলিফোন নম্বর রাখলেন। এবং যখন জানলেন যে আমি চট্টগ্রামের রাতের ফ্লাইটের জন্য এয়ারপোর্টে অপেক্ষমান থাকবো, তখন তিনি বললেন, প্যাসেঞ্জারদের ফেলে যাওয়া জিনিষ সিকিউরিটির একটি দপ্তরে জমা হয়, এবং অনুসন্ধানের ভিত্তিতে খুঁজে দেখা হয়। তিনি আশ্বাস দিয়ে বললেন যে আমি ইনকুয়্যারি দিয়েছি। রেজাল্ট পজিটিভ হবে আশা করি। সন্ধ্যার দিকে খুঁজে পাওয়া জিনিষের একটা লট আসে, সেখানে আপনার বেল্টটা থাকলে অবশ্যই ফেরত পাবেন। কী কালার? আমি বললাম, বাদামী।
সেবার সিলেট ভ্রমণে আমি বাদামী জুতো পরে গেছিলাম। আর তার সঙ্গে ম্যাচ করে বাদামী বেল্টটা পরেছিলাম। লুজারস সাইকোলোজি হচ্ছে, যে জিনিষটা হারায় সে জিনিষটা না হলে যেন তার চলে না, সেরকম একটা মনোভাব। আমারও মনে হলো, হায় রে দু:খ, এই বাদামী বেল্টটা না হলে যেন আমি কোথাও যেতে পারবো না। এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে ঘন্টা কয়েক বসতে হবে। আমি লোকের মেলা দেখতে লাগলাম। অনলাইন চেস খেলছিলাম, কিন্তু বেশিক্ষণ খেললাম না। চার্জ চলে গেলে আরেক বিপদ। যদিও দু’টো চার্জারই আমার ব্যাগে। ছ’টা পার হলো, সাতটা পার হলো, আটটাও পার হলো। ভাবলাম হাজার হলেও এটা আমার বাংলাদেশ, কে কার দায়িত্ব পালন করে! ঠিক ইউ এস বাংলা যখন বোর্ডিং এনাউন্স করলো, তখন উক্ত অফিসার হন্তদন্ত হয়ে আমার হাতে একটা রোল করা বেল্ট দিয়ে বললেন, দেখুনতো স্যার, এটা আপনার বেল্ট কিনা। আমি এক নজর দেখেই বললাম, হ্যাঁ, এটাইতো। খপ করে তাঁর হাত থেকে বেল্টটা নিয়ে ঐ গুঁজানো অবস্থায় আমার ল্যাপটপের সামনের পকেটে চালান করে দিলাম।
রাত্রে বাসায় ফিরে গোসল করে খেয়ে শুতে গেলে খুকুকে পুরো গল্পটা বললাম। ও জানে যে আমার জীবনে প্রায় টুটকা-ফাটকা ঘটনা এরকম ঘটে যায়। সকালে প্রিমিয়ারের অফিসে যাবো। রবীন্দ্রনাথের একটা গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাদামী বেল্টটা পরবো। দেখি, বেল্টটা বেড়ে আসে না। আনমনে ছিলাম মনে করে আবার চেষ্টা করলাম। দেখি যে আবার বেড়ে আসে না। কী ব্যাপার! বেল্টটা খুলে চোখের সামনে ধরলাম। আমারই বেল্ট। বাকলস, ছেদার পরিসর, ছেদার দিকে রং একটু ফেঁসে যাওয়া, সব ঠিক–আমারই বেল্ট। কিন্তু? কিন্তু কী? দেখলাম, বেল্টটার মাথার দিকে বেশ কয়েক ইঞ্চি কেটে ছোট করা হয়েছে, যেন একটা বাচ্চা ছেলের কোমরে ফিট হয়।
তখন আমার চোখ দিয়ে দরদর করে পানি বের হয়ে আসতে লাগলো। হায় রে, আমি কেন হারানো জিনিষ এভাবে খুঁজে পেতে চাইলাম। বিমানবন্দরের সিকিউরিটির যে লোকটি এই বেল্টটা পেয়েছিলেন তিনি হয়তো এটি আর কেউ ফেরত চাইবে না মনে করে নিজের শিশুপুত্রের কোমরের মাপের সমান করে ছেটে নিয়েছিলেন। আমি নিজে ছেলের বাবা, আর আমি কিনা এই অপরিচিত বাবার পুত্রস্নেহের ওপর এরকম না জেনে হলেও এতো বড় আঘাত দিলাম। আল্লাহ্ যেন আমায় ক্ষমা করেন। তবে মানুষের মন। অফিসে যেতে যেতে আমার অশান্ত মন কিছুটা শান্ত হলে পিতার মনের জায়গা দখল করে নিলো বিচারকের মন। যিনি এই কাজটা করেছেন তিনি পুত্রস্নেহের জন্য কাজটা করলেও কাজটাতো অনৈতিক আর অবৈধ ছিলো। হৃদয় এবং মস্তিষ্কের মধ্যে বিরাট লড়াই শুরু হলো। কখনো পিতা জেতেন, কখনো বিচারক জেতেন। কিন্তু আমার মনের ভিতরে জানি, আমি সবচেয়ে খুশি হতাম, যদি হারানো বেল্টটা খোঁজার জন্য আমি তৎপর না হতাম।
=শেষ=
৬ সেপ্টেম্বর ২০২১