৮ এপ্রিল ১৯৬৬ । দুপুরবেলা। যথাসম্ভব দেড় কি পৌনে ২টা বাজে। পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুুর রব বগা মিয়ার বাসায় এলেন বঙ্গবন্ধু। উদ্দেশ্য- ৬ দফার প্রচারণা জনসভায় যোগ দেবেন, তার আগে দুপুরের জলখাবার। যতটুকু দেখেছি ও জেনেছি ছয় দফাকে স্বাধীনতার সিঁড়ি ভাবতেন জাতির জনক। বলতেন, ‘ছয় দফায় যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড় পাঁচ কোটি শোষিত-বঞ্চিত আদম সন্তানের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নাই।
অধিকার আদায়ের এ চিন্তা থেকেই ৬ দফার আন্দোলন দেশব্যাপী প্রচার করতে শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। সেই ধারাবাহিকতায় পাবনায় (টাউন হল) সমাবেশ করতে আসা। চাচার বাসায় আসছেন বিধায় জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে দেখতে গেলাম। বিশেষ সাক্ষাতের সুযোগ হলো। বগা চাচা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মী এম মনসুর আলী, এম এইচ কামারুজ্জামানসহ অন্য নেতাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবসুলভ আদরের ‘তুই’ সম্বোধন করে বেশকিছু দিকনির্দেশনা দিলেন। সর্বশেষ বললেন, ‘মাঠে (সভাস্থল) আয়।’ উপস্থিত জেলা ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ আকবর মজিদ, শফিকুল আজিজ মুকুল, আবদুস ছাত্তার লালুদেরও বললেন- অধমকে যেন সভাস্থলে নিয়ে যায়।
সদ্য এসএসসি পাস করেছি, পরিচয়ে তখনো কলেজের তকমা পাইনি। রাজনীতির কতটুকুইবা বুঝি? কিন্তু ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি দীর্ঘদেহী এই মানুষটির স্নেহামাখা ‘মাঠে আয়’ স্বরে কী যেন লুকিয়ে ছিল। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম- কেউ না নিলেও একা একা জনসভায় যাব। কিন্তু সেটি আর করতে হলো না। সবার সঙ্গেই টাউন হলে গেলাম। বঙ্গবন্ধু ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা শুনলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম, মনের অজান্তেই মুগ্ধ শ্রোতা থেকে গগনবিদারী স্নোগানদাতা হয়ে গেছি। মাধ্যমিকেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুপ্রাণিত ছিলাম। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে আমি যেন তাঁর ছাত্রলীগের অন্যতম সক্রিয় কর্মী। সেই সক্রিয় প্রবেশ কিছুক্ষণ আগেই বঙ্গবন্ধুর ‘মাঠে আয়’ নির্দেশের মধ্য দিয়ে ঘটল। মূলত রাজনীতিতে আমার সক্রিয় ভাবটা ওই মুহূর্ত থেকেই। এরপর আর পেছনে তাকাইনি। তাকাতে হয়নি। কয়েক মিনিটের সাক্ষাতে পিতা মুজিব যেভাবে রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন; সেটাই যে আমাকে এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্রলীগের জিএস, অবিভক্ত পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে ছয় বছর দায়িত্ব পালনে উৎসাহ জুগিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
পাবনার সেই ৮ এপ্রিল ১৯৬৬’র পর বেশ কয়েকবার নাতিদীর্ঘ সময় বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে। যতবার দেখা হয়েছে ততবারই তার কাছ থেকে নতুন কিছু শিখেছি। বঙ্গবন্ধু চলে গেছেন ৪৪ বছর আগে। দীর্ঘ এ সময়ে স্বৈরশাসন, বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসন এবং ওয়ান-ইলেভেন এসেছে। রাজনৈতিক জীবনেও অনেক উত্থান-পতন দেখেছি, কত কিছু শিখেছি; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে থাকার সেই মুহূর্তগুলো ভুলতে পারিনি। জীবদ্দশায় পারবও না। এগুলো আমার কাছে জীবন চলার ‘ফুয়েল’। সেই ‘ফুয়েল’ আজও আমাকে শক্তি জোগায়। শক্তি দেয় এ কারণে যে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আজও বাংলাদেশসহ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ ধারণ করে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের উন্নয়নে যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে সেই স্বপ্ন আজ বাস্তবায়িত হচ্ছে। সাত দশকে পা দেওয়া আওয়ামী লীগের হাত ধরে দেশ উঠেছে উন্নয়নের মহাসড়কে, পৌঁছেছে স্বল্প উন্নয়নের দেশ থেকে উন্নয়নশীলে। ইতিহাস সেরা প্রকল্প পদ্মা সেতু হচ্ছে, দুর্বারগতিতে মেট্রোরেলসহ বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, শেখ হাসিনার হাত ধরে অনেকটাই এগিয়ে গেছে দেশ। এখন উচিত- দল-মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের সেই উন্নয়নকে সর্বাঙ্গীণ দৃষ্টিকোণ থেকে এগিয়ে নেওয়া। শেখ হাসিনার পতাকাতলে সমাবেত হওয়া।
স্বাধীনতার পর কয়েকবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্মুখ সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল আমার। যার একটি ঘটনা আজও আমাকে অনুপ্রেরণা দেয়। সালটা ১৯৭২, ফেব্রুয়ারি মাস। বন্যাকবলিত মানুষকে বাঁচাতে পাবনার কাশিনাথপুর/নগরবাড়ীতে ‘মুজিব বাঁধ’ উদ্বোধন করতে আসেন জাতির জনক। আমি তখন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। যথারীতি জনসভার আয়োজন হলো। স্বাগত বক্তব্যের দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। বক্তৃতা দিলাম। ডায়াস থেকে যখন মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েছি ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধু আমার হাত ধরে ফেললেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাঁড়িয়ে গিয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমু দিয়ে বললেন- ‘তুই তো ভালো বলিস’। বঙ্গবন্ধুর বুকে লেপ্টে আছি; কী বলব কী বলা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না। মুহূর্তের জন্য হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম জাতির জনকের দিকে। পরে দুই-একটি কথা বলে স্টেজের সাইডে গেলাম। পরে এই ভেবে উৎসাহী হলাম যে, মাত্র ১৮ মিনিট বক্ততৃায় যিনি সাত কোটি মানুষকে এক সুতায় গেঁথেছিলেন, লাখ লাখ মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছেন; সেই মানুষটি যখন আমার ভাষণের প্রশংসা করলেন, তখন সেটা নিঃসন্দেহে ছোট ব্যাপার নয়।
বঙ্গবন্ধুকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদানের মধ্য দিয়ে যথারীতি অনুষ্ঠান শেষ হলো। বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে উঠতে যাচ্ছেন, এমন মুহূর্তে আমার কাছে জানতে চাইলেন- ঢাকা যাব কিনা? আগে-পাছে চিন্তা না করে রাজি হয়ে গেলাম। প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার ভ্রমণের সুযোগ হলো, তাও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। ঢাকায় হেলিকপ্টার থামল পুরনো বিমানবন্দর তেজগাঁওয়ে। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে ডাকলেন বঙ্গবন্ধু। নির্দেশ দিলেন- ‘ওকে (আমাকে) বাসায় নিয়ে খেতে দাও, তারপর খরচ দিয়ে পাবনা পাঠিয়ে দিও’।
১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সাংগঠনিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আরেকবার পাবনা আসেন বঙ্গবন্ধু। জনসভার আয়োজন তখন স্টেডিয়ামে। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে সেবারও বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ হলো। বক্তৃতা শেষে বঙ্গবন্ধু ঠিক আগের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরেন। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন, আমি যেন ভবিষ্যতে আরও উন্নতি করি।
এজন্য বলি- ১৫ আগস্ট আমার কাছে শোক দিবস তো বটেই, সেই সঙ্গে এক বিদনাবিধূর হৃদয় ভাঙার দিন। এ শোক এক দিনের নয়, অনন্তের। এ শোক শুধু বাঙালির নয়, গোটা বিশ্ববাসীর। ১৬ আগস্ট হত্যাকান্ডের সংবাদ শুনে সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ডেট (Willy Brandt) তো বলেই ফেললেন- ‘শেখ মুজিবকে হত্যার পর বাঙালি জাতিকে আর বিশ্বাস করা যায় না।’ ফিদেল কাস্ট্রো লিখলেন- ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে’। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে, আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘তোমরা আমারই দেওয়া ট্যাংক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি’।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বভাব নেতা। কী শৈশব, কৈশোর কিংবা মত্ত যৌবন- সবখানেই এক কালজয়ী মহাপুরুষ ছিলেন তিনি। ইতিহাসের বাঁকঘোরানো রাজনীতিবিদ ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বঞ্চনা, অধিকার থেকে যে জাতিকে তিনি একাত্তরে স্বাধীনতা এনে দিলেন; সেই জাতিই যে তাঁকে পাঁচ বছরের জীবন নিয়ে নেবে- সেটা কি জানতেন!
কী হয়েছিল সেই ভোরে? অন্যান্য দিনের মতোই রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ১৪ আগস্ট রাত ৮টা নাগাদ বাড়িতে (ধানমন্ডি ৩২ নম্বর) ফেরেন। খাওয়া-দাওয়া শেষে ঘুমোতে যান রাত ১২টার দিকে। বাড়ির নিচতলার একটি কক্ষে কর্মরত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী এ এফ এম মুহিতুল ইসলাম। যিনি রাত ৩টা নাগাদ ঘুমাতে যান। বঙ্গবন্ধু মামলার এজাহারে মোহিতুল উল্লেখ করেন, কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম তা খেয়াল নেই। হঠাৎ টেলিফোন মিস্ত্রি আমাকে উঠিয়ে জাগিয়ে তুলে বলেন, প্রেসিডেন্ট সাহেব আপনাকে ডাকছেন। সময় তখন ভোর সাড়ে ৪টা কী ৫টা। চারদিকে আকাশ ফর্সা হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু ফোনে আমাকে বললেন, সেরনিয়াতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। আমি জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করলাম। অনেক চেষ্টার পরও লাইন পাচ্ছিলাম না। তারপর গণভবন এক্সচেঞ্জে লাইন লাগানোর চেষ্টা করলাম। বঙ্গবন্ধু ওপর থেকে নিচে নেমে এলেন। আমার কাছে জানতে চাইলেন পুলিশ কন্ট্রোল রুমে কেউ ফোন ধরছে না কেন? আমি ফোন ধরে হ্যালো হ্যালো বলে চিৎকার করছিলাম। বঙ্গবন্ধু আমার হাত থেকে রিসিভার নিয়ে বললেন আমি প্রেসিডেন্ট বলছি। এ সময় দক্ষিণ দিকের জানালা দিয়ে একঝাঁক গুলি এসে ওই কক্ষের দেয়ালে লাগল। তখন অন্য ফোনে চিফ সিকিউরিটি মহিউদ্দিন কথা বলার চেষ্টা করছিলেন। গুলির তা-বে কাঁচের আঘাতে আমার ডান হাত দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। জানালা দিয়ে আসা অনর্গল গুলি থেকে বাঁচতে বঙ্গবন্ধু শুয়ে পড়লেন। আমিও শুয়ে পড়ি।
কিছুক্ষণ পর সাময়িকভাবে গুলি বন্ধ হলে বঙ্গবন্ধু ওঠে দাঁড়ান। ওপর থেকে কাজের ছেলে সেলিম ওরফে আবদুল বঙ্গবন্ধুর পাঞ্জাবি ও চশমা নিয়ে আসে। সেগুলো পরে বঙ্গবন্ধু বারান্দায় দাঁড়ান। বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে বলেন- আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি এত গুলি চলছে তোমরা কী কর? এ সময় শেখ কামাল বলল, ‘আর্মি ও পুলিশ ভাই আপনারা আমার সঙ্গে আসুন। কালো পোশাক পরা একদল লোক এসে শেখ কামালের সামনে দাঁড়াল। আমি (মোহিতুল) ও ডিএসপি নূরুল ইসলাম খান শেখ কামালের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। নূরুল ইসলাম পেছন দিক থেকে টান দিয়ে আমাকে তার অফিস কক্ষে নিয়ে গেল। আমি ওখান থেকে উঁকি দিয়ে বাইরে দেখতে চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি গুলির শব্দ শুনলাম। এ সময় শেখ কামাল গুলি খেয়ে আমার পায়ের কাছে এসে পড়লেন। কামাল ভাই চিৎকার করে বললেন, আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল, ভাই ওদেরকে বলেন।’
মোহিতুল ইসলাম এজাহারে বলেন, ‘আক্রমণকারীদের মধ্যে কালো পোশাকধারী ও খাকি পোশাকধারী ছিল। এ সময় আবার আমরা গুলির শব্দ শোনার পর দেখি ডিএসপি নূরুল ইসলাম খানের পায়ে গুলি লেগেছে। তখন আমি বুঝতে পারলাম আক্রমণকারীরা আর্মির লোক। হত্যাকান্ডের জন্যই তারা এসেছে। নূরুল ইসলাম যখন আমাদের রুম থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তখন মেজর বজলুল হুদা এসে আমার চুল টেনে ধরল। বজলুল হুদা আমাদের নিচে নিয়ে গিয়ে লাইনে দাঁড় করাল। কিছুক্ষণ পর নিচে থেকে আমরা বঙ্গবন্ধুর উচ্চকণ্ঠ শুনলাম। বিকট শব্দে গুলি চলার শব্দ শুনতে পেলাম আমরা। শুনতে পেলাম মেয়েদের আর্তচিৎকার, আহাজারি। এরই মধ্যে শেখ রাসেল ও কাজের মেয়ে রুমাকে নিচে নিয়ে আসা হয়। রাসেল আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমাকে মারবে না তো।’ আমি বললাম, ‘না তোমাকে কিছু বলবে না।’ আমার ধারণা ছিল অতটুকু বাচ্চাকে তারা কিছু বলবে না। কিছুক্ষণ পর রাসেলকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে রুমের মধ্যে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরপর মেজর বজলুল হুদা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা মেজর ফারুককে বলে, ‘অল আর ফিনিশড’।
সত্যিই কি ফিনিশড? না, বরং বঙ্গবন্ধুর দেহ চলে গেছে ঠিকই। কিন্তু তাঁর নীতি-আদর্শ উজ্জীবিত হয়েছে নতুন মোড়কে, নতুন উদ্যমে।
স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে ফিরে আসি। দলীয় কোন্দলের জেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলে কোহিনুরসহ ৭ ছাত্রলীগ নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয় ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল। মাহবুব উদ্দিন বীর বিক্রম ছিলেন তখন ঢাকার পুলিশ সুপার। হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে তিনি দেখলেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান নিজে এই হত্যাকা- ঘটিয়েছেন। বিষয়টি তিনি (মাহবুব উদ্দিন) তৎকালীন অতিরিক্ত আইজিপি (এসবি) ই এ চৌধুরীকে অবহিত করলে তাৎক্ষণিক তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে জানানো হয়। বঙ্গবন্ধু তখন মস্কোতে চিকিৎসাধীন। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ এই সহচর (মনসুর আলী) সাহসিকতার সঙ্গে পুরো পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন। সিনিয়র কেবিনেট কলিগের সঙ্গে পরামর্শ করে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের উদ্যোগ নেন তিনি।
যে পরিকল্পনা, সেই কাজ। হত্যার পরদিনই (৫ এপ্রিল) শফিউল আলম প্রধানকে গ্রেফতার করা হয় ঢাকা কলেজের বিপরীতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচে ‘সীতারাম মিষ্টান্ন ভান্ডার’ থেকে। পর্যায়ক্রমে অন্য আসামিরাও গ্রেফতার হয়। সে সময় পাবনা জেলা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আমিই প্রথম বিবৃতি দিয়ে এই সাহসী পদক্ষেপের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাই। পরে রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নুরুল ইসলাম ঠা-ু ও সাধারণ সম্পাদক মফিজ উদ্দিনও আমার পথে হাঁটে। প্রধানকে গ্রেফতারে অভিনন্দন জানানোয় মনিরুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ পাবনা জেলা ছাত্রলীগের কমিটিকে বিলুপ্ত করে; যা পরদনি ‘দৈনিক বাংলার বাণী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। চিকিৎসা শেষে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলে তাকে সব ঘটনা জানানো হয়। পুরো বিষয়টি জানার পর ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেফতারের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সিনিয়র মন্ত্রীদের সাধুবাদ জানান বঙ্গবন্ধু। শুধু তাই নয়, সে সময় প্রধানের মুক্তির দাবিতে অনশনরত ছাত্রলীগ কর্মীদের আধা ঘণ্টার মধ্যে অনশন ভাঙার নির্দেশ দেন। অনশন না ভাঙলে গ্রেফতারের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি। বাধ্য হয়ে তারা অনশন ভাঙেন। অবশ্য জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দ-প্রাপ্ত এই শফিউল আলমকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তার পরবর্তী রাজনৈতিক জীবন তো সবারই জানা।
এদিকে আমার জেলা ছাত্রলীগ কমিটি বিলুপ্ত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে ক্ষুব্ধ ছিলাম। বিষয়টি সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রায় এক মাস পর অর্থাৎ চুয়াত্তরের মে মাসে প্রথম সপ্তাহে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ পেলাম। যাতে সহায়তা করলেন শ্রদ্ধেয় এম মনসুর আলী। বঙ্গবন্ধু সেদিন রমনা পার্কের গেট ও বেইলি রোডের মুখে অবস্থিত রাষ্ট্রীয় ভবন ‘সুগন্ধা’য় অবস্থান করছিলেন। আমরা সেখানে সকাল ৯টায় পৌঁছি। তোফায়েল আহমেদ তখন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব। বলে রাখা ভালো, দেশে তখন তথাকথিত মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ চলছিল। সেই দুর্ভিক্ষকে ঘিরে জাহাজযোগে দেশ-বিদেশ থেকে ত্রাণ আসছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেকে ত্রাণ নিয়ে আসা দুটি জাহাজ ডুবে যাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। এটা আন্দাজ করতে পেরেই তোফায়েল আহমেদ সেদিন কথা না বলার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আমরাও চলে আসতে উদ্যত হই। ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধু আমাদের ডাক দেন। তিনি তখন বারান্দায় থাকা বেতের চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন।
যাই হোক, আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে এগিয়ে গেলাম। তিনি আমাদের দেখে প্রথমেই বলেন- ‘ষড়যন্ত্র আর ষড়যন্ত্র। আমার মনটা খুবই খারাপ, পিএল ৪৮০’র অধীনে চট্টগ্রাম অভিমুখে আগমনরত দুটি গমভর্তি জাহাজ একই সময়ে ভারতের বোম্বাই উপকূলে সমুদ্রগর্ভে ডুবে গেছে। আমি কি এই ষড়যন্ত্র বুঝি না? দেশের উত্তরাঞ্চলে খাদ্য সংকট চলছে, এই সময় একত্রে দুটি জাহাজডুবি আমার সরকারকে বিপদের সম্মুখীন করা।’ অত্যন্ত আবেগতাড়িত হলেন বঙ্গবন্ধু। একজন বীর দেশপ্রেমিকের কণ্ঠে এ কথা শুনে আমরা আমাদের অভিযোগ থেকে দূরে থাকব বলে সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো নিজ কর্মীদের বুঝতে পারেন, তিনি ছাড়লেন না। আসার মূল কারণ জানতে চাইলেন। পরে কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার খবরটি তাকে সবিস্তারে জানাই। বঙ্গবন্ধু রাগান্বিত কণ্ঠে বলে উঠলেন- ‘ছাত্রলীগ কার?’ হতবিহ্বল অবস্থায় বললাম, আপনার। তিনি আমাদের বললেন- তোরা পাবনায় ফিরে যা এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম কর। আমি দেখব কে তোদের বিরত করে? বলা বাহুল্য, এরপর আমাদের জেলা ছাত্রলীগের কার্যক্রমে আর কোনো বাধা আসেনি। সেই ধারাবাহিকতায় পাবনা জেলা যুবলীগের সভাপতিও হয়েছিলাম আমি।
১৯৭৫ সালের জুন মাসে বাকশাল গঠন হয়। উদ্দেশ্য ছিল- দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা। বলা যায় আর্থ-সামাজিক মুক্তিই ছিল এর উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে প্রথমে বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটি ও পরে জেলা গভর্নরসহ জেলা কমিটিগুলো গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ¯ন্ডেœহধন্য হওয়ায় তিনি আমাকেও এর সদস্য করেন। পদায়ন করেন পাবনা জেলা বাকশালের যুগ্ম-সম্পাদক হিসেবে। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন এখানকার সাধারণ সম্পাদক। বঙ্গবন্ধু স্বহস্তে প্রণয়ন করেছিলেন এই কমিটির তালিকা, পরে বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর মুখে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক আমার নামটি লেখার গল্প শুনেছিলাম। এর চেয়ে বড় পাওয়া কী হতে পারে?
কমিটি গঠনের পর জেলা বাকশালের সম্পাদক ও ৫ যুগ্ম-সম্পাদক মিলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি তখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসায়। জাতির জনকের স্বভাব ড্রেসকোড ‘হাফ শাটর্’ ও ‘লুঙ্গি’ পরেছিলেন। এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুকে আমার শেষ দেখা। এই সাক্ষাতের দুই মাস পরই যে তিনি চলে যাবেন কে জানত তা? যাই হোক, ভবনে ঢুকে বঙ্গবন্ধুকে সালাম দিলাম। বাকশাল কমিটিতে স্থান দেওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। তিনি আমাদের নানা দিকনির্দেশনা দিলেন। চলে আসব, ঠিক এই মুহূর্তে ডাকলেন বঙ্গবন্ধু। বললেন, ‘কীরে, আমার সঙ্গে তো ছবি না তুলে কেউ যায় না; তোরা কেন যাস’। তাৎক্ষণিক ক্যামেরাম্যান ডাকলেন। ফটোবন্দী হলাম রাজনীতির কবির সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে নেওয়া সেই ছবি আজও আমি আগলে রাখছি। তার কাছ থেকে পাওয়া সর্বশেষ স্মৃতিচিহ্ন যে এটাই!
১৫ আগস্ট মোশতাক চক্রের বুলেটে বঙ্গবন্ধু পরিবার শহীদ হলে আমি ও পাবনা আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। বিশাল এক মিছিল নিয়ে জেলা শহর প্রদক্ষিণ করি। আমি, বেবি ইসলাম, রফিকুল ইসলাম বকুল, ফজলুল হক মন্টু, আবুল কালাম আযাদ, রেজাউল রহিম লালের নেতৃত্বে অস্ত্র সংগ্রহ করে জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তুলি। সকাল ৮টা-সাড়ে ৮টার দিকে পাবনার জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার পিবি মিত্র আমাদের কোনো অ্যাকশনে যেতে বারণ করলেন। তিনি জানালেন, তিন বাহিনীসহ বিডিআর প্রধান ও রক্ষীবাহিনী ইতিমধ্যে মোশতাক সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করেছে। তোমাদের উচিত- আত্মগোপনে চলে যাওয়া। বিষয়টি অনুধাবন করলাম। শহর ছেড়েছিলামও, কিন্তু ২০ আগস্ট খুনি মোশতাকের তৎসময়ের অনুগত বিপথগামী কিছু সেনা ও পুলিশ সদস্যের হাতে গ্রেফতার হই। সামরিক আইনের ৭ ধারায় (সন্দেহভাজন) হিসেবে ডিএসপি মো. শামসুদ্দিন আমাকে গ্রেফতার করে, গ্রেফতারকারী সেই কর্মকর্তা ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা ব্যাচ (১৯৭৩) থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত।
গ্রেফতারের পর জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমদিকে কোনো এক গভীর রাতে জেলখানা থেকে চোখ বেঁধে বালুর ট্রাকে করে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় নতুন উদ্যমে নির্যাতন। সেই নির্যাতনকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ডিএসপি কংশধর তরফদার। ছিলেন পাকিস্তান-ফেরত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল এএলএম ফজলুর রহমানও। ফজলুর রহমান আমাকে একের পর এক বুটের লাথি মারতে থাকেন, আর বলতে থাকেন, ‘এই ব্যাটা তোর বঙ্গবল্টু কোথায়?’ এও বলা হয়- তোরা শেখ মুজিব হত্যার প্রতিবাদ করেছিলি, মিছিল করেছিলি? তোদের গুলি করে মারা হবে। ভেবেই নিয়েছিলাম, জীবন চলে যাবে। যে দেশে জাতির পিতা সপরিবারে নিহত হন, সে আমি আর এমন কী! কিন্তু পরক্ষণেই দেখলাম, আমাদের আবারও গাড়িতে ওঠানো হচ্ছে। পরে সেনা ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিয়ে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় পুনরায় কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
জেল থেকে বের হয়ে পরিবারের সব সদস্যের আর্থিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে আমিও দুর্বল হয়ে যাই। ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলি বর্ণাঢ্য এক রাজনৈতিক জীবন। কষ্ট হলো তখন, যখন দেখলাম বঙ্গবন্ধুকে গালি দিয়ে আমাকে নির্যাতন করা সেই ফজলুর রহমানই বিজিবি প্রধান (ফেব্রুয়ারি ২০০০-জুলাই ২০০১) হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন করা বাংলাদেশে বসে রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন তিনি।
আগস্ট এলেই দুঃসহ স্মৃতি ভেসে ওঠে মানসপটে। বারবার স্মৃতি খুঁজে ফিরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাটানো সেই নাতিদীর্ঘ সময়গুলো। কিছুটা আশ্বস্ত হই এই ভেবে যে, প্রিয় নেতা, ঘাতক জল্লাদরা আপনাকে হত্যা করেছে ঠিকই, কিন্তু বাঙালি জাতির হৃদয়ের আসন থেকে আপনাকে কি সরাতে পেরেছে? পারেনি। আপনি অমর-অক্ষয়-অবিনশ্বর। ছড়া-কবিতা-গান, শিল্প-কাব্য-সাহিত্য, চিন্তা-চেতনা-আদর্শ, পরিবার-সমাজ এমনকি রাষ্ট্র- বঙ্গবন্ধু, কোথায় নেই আপনি?
নির্ভীক এ বিশ্বনেতসহ তাঁর পরিবার ও ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ নিহত সব শহীদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: সাহাবুদ্দিন চুপ্পু – বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য ও সাবেক দুদক কমিশনার ।