নাটোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম

পাকিস্তান শাসনামল থেকেই  বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এবং পরবর্তীকালে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত  যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুর্ণগঠনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন, পদস্পর্শ করেছেন বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি নগর বন্দর। তাঁর ছোয়ায় পাক হানাদারদের ধ্বংসযজ্ঞ শহর নগর জনপদে আবারো প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরে উঠেছে। পাক হানাদার আর তার দোসরদের সীমাহীন অত্যাচারের যন্ত্রণা মুহুর্তেই লাঘব হয়ে গেছে। তাঁকে এক নজর দেখার জন্য উদ্বেলিত লাখ লাখ জনতা মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে জনসভাস্থলে হাজির হয়েছেন।

উত্তরবঙ্গের ছোট একটি জনপদ নাটোর। রাজা, মহারাজা, জমিদার, কবি সাহিত্যিকদের স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে নাটোরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিতেও ধন্য হয়েছে নাটোর। ছোট জনপদ বলে বঙ্গবন্ধু এই জেলাকে কখনোই অবহেলা করেনি। বলা যায় নাটোর জেলার প্রতি তাঁর একটু অন্য রকমের টান ছিল।  তাঁর শাসনামলে (১৯৭২-১৯৭৫)  নাটোর সমৃদ্ধ হয়েছে উত্তরা গণভবনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে।

জীবনানন্দ দাসের বহুল খ্যাত বনলতা সেনের কবিতার শহর নাটোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেশ কয়েকবার সফরে এসেছেন। নাটোরে  তিনি এসেছেন রাজনৈতিক সফরে যার মধ্যে বেশীর ভাগই সাংগঠনিক এবং নির্বাচনী কাজে। আবার ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফরেও এসেছেন, রাত্রি যাপন করেছেন উত্তরা গণ ভবনে। আনন্দ বেদনার স্মৃতি হয়ে তাঁর সফরের বৃত্তান্ত আজো নাটোরবাসীর হ্নদয়ে গভীর রেখাপাত করে রেখেছে।

অবিভক্ত বাংলায় ১৯৪৬ সালের বালুরঘাট উপনির্বাচনে নির্বাচনী প্রচারণায় যুক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নির্বাচনী প্রচারণার কাজে বালুরঘাট যাবার পথে নাটোর এসেছিলেন। শুধু তাই নয় সিংড়ার তাজপুর গ্রামে গেছেন। চলনবিলের মানুষের সাথে হ্নদ্যতা গড়ে তুলেছেন।
১৯৫৩ সালের ২৬ জানুয়ারি তারিখে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কাজে নাটোর আসেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নাটোর রেল স্টেশনে সম্বর্ধনা দেয়া হয়। পুলিশের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “ On 26.1.53 at about 07.30 hrs. Mr. Shurawardy and his party left Santaher for Natore and reached Natore at about 09.30 hrs. They were received at the station by Koma Mia Muktear, Ishaque, Israil, Ayub Ali and about 30 persons shouting slogans Pakistan Zindabad, Quad-e- Pakistan Zindabad, Sk. Mujibur Rahman Zindabad etc. The Party left the station for dakbanglow.”

আওয়ামী মুসলিম লীগের রাজনীতি থেকেই বঙ্গবন্ধু নাটোরের রাজনীতিবিদদের  অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ( কাচু উদ্দিন নাটোর নর্থ, আবুল কাসেম খন্দকার নাটোর সাউথ ইস্ট) ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ( প্রাদেশিক সদস্য  শংকর গোবিন্দ চৌধুরী, আশরাফুল ইসলাম, আবদুস সালাম) এবং ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ( এ্যাড মো. ছাইফুল ইসলাম, আশরাফুল ইসলাম, এ্যাড মো. রফিক উদ্দিন সরকার)  নাটোর থেকে যাঁরা বিজয়ী হয়েছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত কাছের এবং প্রিয়পাত্র ছিলেন।

এজন্য আমরা দেখি পাকিস্তান শাসনামলের রাজনীতিতে  নাটোরের স্থানীয় রাজনীতিকেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গুরুত্বের সাথে দেখেছেন। ১৯৬৪ সালে নাটোরের মহকুমা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান অতিথি হয়েছেন। ১৯৬৪ সালের ৮ মে তারিখে নাটোর মহকুমা আওয়ামী লীগের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।  শুধু তিনি একাই নন, ওই সময়ের আওয়ামী লীগের খ্যাতনামা নেতাদেরকেও তিনি নাটোরে উপস্থিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও সম্মেলনে আরো যারা ছিলেন  মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, মতিয়ার রহমান, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, কামরুজ্জামান এম, এন, এ।

সম্মেলনের বিস্তারিত না জানা গেলেও এটুকু জানা যায় স্থানীয় সিনেমা হলে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সম্মেলনে  নাটোর মহকুমা আওয়ামী লীগের সম্পাদক জনাব আশরাফুল ইসলাম রিপোর্ট পেশ করেন। সম্মেলন শেষে বিকেলে নাটোরে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন  নাটোর মহকুমা আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব কামচুদ্দিনের (অন্যত্র লেখা আছে কাবু উদ্দিন)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান  নাটোরে অনুষ্ঠিত জনসভায় বক্তব্য প্রদানকালে  পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের হীন মানসিকতার পরিচয় তুলে ধরেন। বিশাল এই জনসভায় আওয়ামী লীগ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেন, “ দেশকে বিশৃংখলা, বিভ্রান্তি, স্বার্থপরতা এবং অব্যবস্থার দিকে ঠেলিয়া দেওয়া হইতেছে।” তিনি আরো বলেন ,“ অকল্পনীয় দুর্যোগের মধ্য দিয়া জাতির দিনগুলি অতিবাহিত হইতেছে। ইহা শুধু জনসাধারণকে নিরাশ করিবে না, জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন করিবে।”

১৯৬৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাটোর মহকুমা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে যোগ দেয়ায় বিষয়টি গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্ব পেয়েছিল। সম্মেলন উপলক্ষে দৈনিক ইত্তেফাক গণবিরোধীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান শীর্ষক শিরোনামে পত্রিকায় যে বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল, পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরছি- “ নাটোর, ৯ই মে- গতকল্য  এখানে আওয়ামী লীগ কর্মী সম্মেলন এবং প্রাদেশিক নেতৃবৃন্দের আগমন উপলক্ষে প্রদেশের সুদুরবর্তী এই নাটোর মহকুমার জনসাধারণের মধ্যে অভূতপূর্ব প্রাণচাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হয়। জনগণের অধিকার পুন:প্রতিষ্ঠার জন্য নেতৃবৃন্দ সংগ্রামের যে আহবান জানাইয়াছেন বিগত ছয় বৎসরের রাজনৈতিক স্তব্ধতা সত্ত্বেও এই এলাকার জনসাধারণ তাহাতে সাড়া দিয়া রাজনৈতিক জীবনে নূতন গতি সঞ্চার করিয়াছে।”

১৯৬৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগমনকে কেন্দ্র করে নাটোরে সাজ সাজ রব পরিলক্ষিত হয়। দূর দূরান্ত থেকে জনগণ নাটোরের জনসভায় যোগ দেন। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় আরো লেখা হয়, “  সুদূর পল্লী হইতে জনসাধারণ দলে দলে আসিয়া জনসভায় যোগদান করেন এবং সভা আরম্ভ হওয়ার অল্পক্ষণের মধ্যেই সমগ্র পার্কটি পূর্ণ হইয়া যায় এবং বহু লোক পার্শ্ববর্তী রাস্তায় দাঁড়াইয়া অধীর আগ্রহে বক্তৃতা শ্রবণ করিতে থাকে।”

১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবারো নাটোর এসেছিলেন এবং জনসভা করেছিলেন। এই জনসভাটিও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের রাজনীতিতে তখন উত্তাল আবহাওয়া ছিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের। নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন আইয়ুব খান এবং মিস ফাতেমা জিন্নাহ। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলীয় প্রার্থী হিসেবে মিস ফাতিমা জিন্নাহকে সমর্থন করেন। নির্বাচনী প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে মিস ফাতিমা জিন্নাহ মাত্র কয়েকদিনের সফরে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম জনসভা করার পর ১৯৬৪ সালের ১৯ অক্টোবর তারিখে তিনি রাজশাহী আসেন । নাটোরের রাজনীতির অবস্থান গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধু  এখানেও একটি জনসভা করেন। যা ওই সময়কার রাজনীতিতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

১৯৬৪ সালের ২০ অক্টোবর  (মঙ্গলবার)  সকাল ১০.০০টায় বিরোধীদলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মিস ফাতেমা জিন্নাহকে সাথে করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজশাহী থেকে মোটরযোগে নাটোর যাত্রা করেন এবং নাটোরে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করেন। নাটোর রেলস্টেশনে অনুষ্ঠিত জনসভায় সভাপতিত্ব করেন মওলানা ভাসানী। বক্তৃতা করেন জেনারেল আজম খান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব আখতারুদ্দীন আহমদ, জনাব আবদুল বাকী বালুচ, মওলবী ফরিদ আহমদ, জাতীয় পরিষদের ডেপুটি স্পীকার জনাব আবুল কাসেম প্রমুখ। জনসভার বিবরণ দিয়ে ২১ অক্টোবর ১৯৬৪ তারিখের দৈনিক আজাদ পত্রিকার শিরোনাম- “খাইবারগিরি হইতে চট্টলের সাগর সৈকত পর্য্যন্ত যে জন – জোয়ার আসিয়াছে উহা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হউন/ ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের প্রতি মাদাওে মিল্লাতের চ্যালেঞ্জ/ নাটোরের বিরাট জনসভায় নেতৃবৃন্দ কর্ত্তৃক আসন্ন নির্বাচনের গুরুত্ব বর্ণনা।” নাটোরের ওই জনসভায় প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সম্পাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বক্তব্য রাখেন। তিনি জনসভায় সম্মিলিত বিরোধী দল প্রার্থী মিস ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দেন। এছাড়াও বক্তৃতায় তিনি উল্লেখ করেন, “ বর্তমান শাসক গোষ্ঠীর হাতে জনসাধারণ অত্যাচারিত নির্যাতিত না হইলে  এবং মৌলিক অধিকার হইতে তাহাদের বঞ্চিত করা না হইলে মাদারে মিল্লাত এই বৃদ্ধ বয়সে রাজনীতিতে নামিতেন না।”

বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয় দফা দাবি ও তার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছয় দফা দাবি ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। যাকে আমরা ব্রিটিশ ইতিহাসের ম্যাগনাকার্টা ও অধিকার বিল, ফরাসি বিপ্লবের সাম্য স্বাধীনতা এবং আমেরিকার গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের বিকাশ যেভাবে ঘটেছিল তার সাথে তুলনা করতে পারি। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে রাজনৈতিকভাবে ছয় দফা দাবিকে একটি সাংগঠনিক রূপ দেয়া এবং একটি গণ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সারা দেশ জুড়ে ছয় দফার প্রচার শুরু করেন। ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসে  তিনি উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় যেমন পাবনা বগুড়া দিনাজপুর রংপুর রাজশাহীতে জনসভা করেন। ১৯৬৬ সালের ১১ এপ্রিল তারিখে রাজশাহীতে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু পাবনা থেকে রাজশাহী যাবার পথে নাটোরবাসীকেও ছয় দফার পক্ষে  আহবান জানিয়েছিলেন। নাটোরবাসীর পক্ষ থেকে শ্রমিক নেতারা সেদিন বঙ্গবন্ধুকে মানপত্র দিয়েছিল। ১৯৬৬ সালের ১৩ এপ্রিল তারিখের পত্রিকায়  এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশিত সংবাদে উল্লেখ করা হয়:

“…পাবনা হইতে রাজশাহী গমনের পথে নাটোরে নেতৃবৃন্দকে বিপুলভাবে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। পথের ওপর মনোরমভাবে সজ্জিত তোরণে দন্ডায়মান উৎসুক জনতা নেতৃবৃন্দকে দেখবার জন্য অপেক্ষা করিতে থাকে। শ্রমিকদের পক্ষ হইতে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রদত্ত মানপত্রে ছয়দফা বাস্তবায়নের মুত্যুপণ সংগ্রামের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। মানপত্রের জবাবে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সভাপতি শ্রমিক প্রতি ত্যাগ স্বীকারের আহবান জানাইয়া বলেন যে, এই ত্যাগই তাঁহাদিগকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌছাইয়া দিবে ।

নাটোরে ছয় দফার পক্ষে গণ জাগরণ দেখা যায়। নাটোরের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সভা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৬ সালের ৮ মে তারিখে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় নাটোরে ছয় দফার পক্ষে কৃষক সমাবেশের  আয়োজন করে তাতে বঙ্গবন্ধুকে আমন্ত্রণ জানানো হবে বলে উল্লেখ করা হয়। এই উপলক্ষে বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা জনাব আইয়ুব উল্লাকে চেয়ারম্যান করে একটি শক্তিশালী অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৬৬ সালের ৮ মে তারিখের পত্রিকার রিপোর্টে  বলা হয়:     “ নাটোর, ৬ই মে। অদ্য এখান হইতে ১৩ মাইল দূরে সিংড়া নামক  স্থানে চলনবিল এলাকার এক বিরাট কৃষক সমাবেশে শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ৬-দফা দাবীর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। সমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বিভিন্ন কৃষক নেতা বলেন যে, পাটের ন্যায্যমূল্যে এবং বিশ্ববাজারে পূর্ব পাকিস্তানী সম্পদের চাহিদা বৃদ্ধি করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন একান্ত অপরিহার্য হইয়া উঠিয়াছে।

এই কৃষক সভায় গৃহীত প্রস্তাবে শেখ মুজিবের উপর আরোপিত সকল প্রকার হয়রানিমূলক ব্যবস্থা রহিত করার দাবী জানান হয়। নাটোর মহকুমা আওয়ামী লীগ সেক্রেটারী জনাব আশরাফুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই কৃষক সভায় অনতিবিলম্বে লেভী প্রথার বিলোপ ও খাদ্যসহ বিভিন্ন দ্রব্যেও মূল্য হ্রাস করার দাবী জানান হয়। আগামী মাসে এখঅনে কৃষক কনফারেন্সে শেখ মুজিবকে প্রধঅন অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হইয়াছে। এই উপলক্ষে বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা জনাব আইয়ুব উল্লাকে চেয়ারম্যান করিয়া একটি শক্তিশালী অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করা হইয়াছে।”
২.
উত্তরবঙ্গ বললেই একসময় চোখের সামনে ভেসে ওঠে বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা ইত্যাদি। দারিদ্র্য –পীড়িত কৃষক, দিনমজুরদের অগ্রিম মজুরি বিক্রি সবই ছিল দারিদ্র্যের ঘন কুয়াশার চাদরে লুকোচুরি খেলার মতো। উত্তরবঙ্গ সফরে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এগুলো স্বচোখে দেখেছেন। ফলে উত্তরজনপদের দু:খ দুর্দশা মোচন তথা নাটোরবাসীর দুর্দশা লাঘবের জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই ১৯৭২ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি তারিখে  নাটোরের দিঘাপাতিয়া গভর্ণর হাউজকে  উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষণা করেন। এভাবেই তিনি নাটোরের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নের সূচনা শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে (১৯৭২-৭৫) উত্তরবঙ্গে এলেই তিনি সময় সুযোগ বুঝে নাটোরে আসতেন এবং উত্তরা গণভবনে অবস্থান করতেন।
উত্তরা গণভবন প্রাঙ্গণকে সুশোভিত করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বহস্তে  হৈমন্তী ফুল এবং আম সহ নারিকেল গাছের চারা রোপণ করেন।
১৯৭৩ সালের ৯ জানুয়ারি তারিখে বঙ্গবন্ধু নাটোরের হরিশপুরে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। জনপ্রিয় লোক সঙ্গীত গম্ভীরা গানের কলা কুশলীরা বঙ্গবন্ধুকে নাটোরে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হন। সঙ্গীত শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মাথায় মাথাল পরিয়ে দেন। ওই অনুষ্ঠানের ছবি ও স্মারক আজ নাটোরের ইতিহাসের স্মৃতি হয়ে আছে।
১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে নওগাঁ, চাপাইনবাবগঞ্জ, গাইবান্ধা ও নীলফামারী সফরের জন্য উত্তরা গণভবনে এসেছিলেন। হঠাৎ এ সময়েই অর্থাৎ ১৯৭৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাবনার জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ আবদুর রব বগা মিয়া সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। সংবাদ পেয়ে তৎক্ষনাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাটোর  উত্তরা গণভবন থেকে পাবনা চলে যান।
উন্নয়ন ও গণমাধ্যম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এজন্য তিনি ১৯৭২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তিনি টেলিভিশনকে সরকারিভাবে অধিগ্রহণ করেন । উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাটোরে বাংলাদেশ টেলিভিশন উপকেন্দ্র স্থাপনের নির্দেশ দেন। এর ফলে নাটোরে দেশের প্রথম টেলিভিশন উপকেন্দ্র স্থাপিত হয় এবং ১৯৭৪ সালে সম্প্রচারের কাজ শুরু হয়। শুরুতে নাটোর কেন্দ্র থেকে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৯টা পযন্ত দুই ঘন্টার নিজস্ব অনুষ্ঠান প্রচারিত হতে থাকে। বিনোদনের জগতেও নাটোর গুরুত্ব পেতে থাকে। ১৯৭৩ সালের  জুলাই মাসে উত্তরবঙ্গের বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সিরাজগঞ্জ কুড়িগ্রাম চলনবিল সহ উত্তরবঙ্গের বন্যা পরিস্থিতি অবলোকন করে  নাটোর উত্তরা গণ ভবনে আসেন। বন্যা নিয়ন্ত্রন এবং  দুস্থপীড়িতদের সাহাযার্থে জনগণকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।  ১৯৭৩ সালের ১লা জুলাই উত্তরা গণভবনে  আইন শৃঙ্খলা ও বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে এক উচ্চ পর্যায়ের মিটিং করেন।

এই দিন বঙ্গবন্ধু নাটোর উত্তরা গণভবনে নব নির্বাচিত রাকসু এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাত দেন এবং তাদেরকেও দেশ সেবায় ঝাপিয়ে পড়ার আহবান জানান। নাটোর উত্তরা গণভবনকে কেন্দ্র করেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তরবঙ্গের রাজনীতি, অর্থনীতি কর্মকান্ড পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট র্দুভাগ্য জনক ভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের পর থেকে সারা বাংলাদেশের মতো নাটোর বাসীও সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে।

লেখক : ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম, প্রো ভাইস চ্যান্সেলর, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা ।

উত্তরবঙ্গের ছোট একটি জনপদ নাটোরনাটোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানবনলতা সেনের কবিতার শহর নাটোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
Comments (0)
Add Comment