গত পরশুদিন (২০ ডিসেম্বর ২০২১) ফেইসবুকে “শুভ সকাল বগুড়া” শীর্ষক একটি লেখা পোস্টাইলে সেখানে একটি শব্দ ব্যবহার করেছিলাম ‘কিডাল্ট’, যেটা দিয়ে আমি বুঝিয়েছিলাম যে প্রতিটা বুড়োর (বুড়ো বলতে বয়ষ্ক লোক) ভিতরে একটি শিশু লুকিয়ে থাকে। কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাঁর “মাই হার্ট লিপস আপ” নামক কবিতায় একটি চরণ লিখেছিলেন যে “The child is father of the man” যেটির অনুবাদ কবি গোলাম মোস্তফা করেছিলেন এভাবে: “ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে।”
কিন্তু কিডাল্ট (kid+adult=kiddult) তত্ত্বটি হচ্ছে এর ঠিক বিপরীত। ওয়ার্ডসওয়ার্থ বোঝাতে চেয়েছিলেন জীববিজ্ঞানের ধর্মানুযায়ী যে শিশুটি এখন ছোট সে শিশুটি একদিন প্রাকৃতিক নিয়মে বড় হবে, এবং সে সন্তান উৎপাদনে সক্ষম হবে, এবং সে অর্থে আজকের প্রতিটা শিশু ভবিষ্যতের বাবা বা মা।
কিন্তু কিডাল্ট বলছে যে প্রতিটা বাবা-মা বা বয়ষ্ক লোকের মনের ভিতরে শিশুটা জাগরুক থাকে, যেটা কবি জসীমউদ্দিনের ভাষায় বলতে হয় “মোর শিশুকাল লুকায়েছে হায়।”
তবে কিডাল্ট শব্দটির একটি তত্ত্ব হিসেবে আমি পরিচিতি পাই বহু বছর আগে পড়া (সম্ভবত মধ্য নব্বই দশকে) একজন প্রথম শ্রেণির মার্কিনী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপকের একটি দীর্ঘ রচনায়। অধ্যাপকের নাম মনে নেই, দীর্ঘদিন আগের পড়া। আর্টিকেলের নামও মনে নেই। তবে লেখাটি পড়তে নিয়েছিলাম বন্ধুবর এবং তৎকালে আমার চবির (রাষ্ট্রবিজ্ঞানের) সহকর্মী অধ্যাপক মাহফুজুল হক চৌধুরীর কাছ থেকে, যে এখন চিটাগাং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্টির মাননীয় উপাচার্য, এবং আশা করছি এ লেখাটি তার চোখে পড়বে, এবং সে হয়তো মনে করিয়ে দিতে পারবে কোন লেখাটি এটি ছিল।
লেখাটি মূলত ছিল বিশ্বব্যাপী কর্পোরেট ইন্ডাস্ট্রির ব্যাপক উদ্বোধনের সমালোচনা। লেখক বলতে চেয়েছেন যে কীভাবে বহুমুখি আর্ন্তজাতিক অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশমান ধারাকে আরো বেশি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য এবং এর থেকে আরো বেশী মুনাফা লোটার জন্য এক ধরনের কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে ক্রেতাবর্গের পকেট খালি করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। পন্ডিত অধ্যাপকের বর্ণনায় কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করার উদাহরণস্বরূপ—আমার যতটুকু মনে পড়ে—এরকম ছিল যে এই পদ্ধতির (কৃত্রিম চাহিদার সৃষ্টি) ভিত্তিমূল ছিল যে buy one, get one free কনসেপ্টটি। তিনি বলতে চেয়েছেন যে ‘বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি’র আসল লক্ষ্য হলো ক্রেতার ভিতরে সুপ্তিমগন শিশুটিকে জাগিয়ে দেওয়া। একজন শিশু কী চায়? সে কখনো একটা কলা বা একটা মিষ্টি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে না। সে খেতে পারুক না পারুক, তার মায়ের কাছে আবদার ধরে তার দু’হাতে দুটো কলা কিংবা দু ‘হাতে দুটো মিষ্টি দিতে হবে। অর্থাৎ তার প্রয়োজনের তুলনায় তার প্রাপ্তির মধ্যে বেশী জিনিষ থাকতে হবে। এই তত্ত্বটিই—বয়ষ্ক লোকের মনে নিদ্রাতুর লোভী শিশুটিকে জাগিয়ে দেওয়া—মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে পণ্য বিপননের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী সাফল্য নিয়ে এসেছে মাল্টি-ন্যাশন্যাল কর্রপোরেট ইনডাস্ট্রিগুলো। মানুষ ‘বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি’তে থেমে থাকে না, সে ‘বাই টু, গেট টু ফ্রি’ বা ’বাই থ্রি, গেট থ্রি ফ্রি’তে লাফ মারতে চায়। এজন্য সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বিশ্বব্যাপী যখন উচ্চবিত্তের শ্রেণিকে ডিঙ্গিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং উচ্চ-নিম্নবিত্তের ক্রেতাশ্রেণি ব্যাপক হারে বিপনন জগতে প্রবেশ করল, তখন দেখা গেল কৃত্রিম চাহিদাটাই ক্রমান্বয়ে—ক্রমান্বয়ে নয় আসলে, খুব দ্রুতই বলা যায়—মৌলিক চাহিদায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে। অধ্যাপক সাহেব আরো বললেন যে ‘বাই ওয়ান, গেট ওয়ান ফ্রি’ যদি শুধু কৃত্রিম চাহিদাই সৃষ্টি করতো, তা হলে এটা কোন কার্যকর অর্থনীতি হতো না, এবং এটার আবেদন ঐখানেই শেষ হয়ে যেত। তিনি বলছেন, বরঞ্চ এটার কার্যকারিতা এখানে যে ‘বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি’টার দ্বিতীয় শার্টটা কৃত্রিম চাহিদা না হয়ে মৌলিক চাহিদায় পরিণত হয়, এবং এই পর্যায়ন্তরটাই হচ্ছে এই অর্থনীতির ব্যাপক সাফল্য বা শানে নজুল। প্রতিটা দ্বিতীয় শার্ট একটি মৌলিক চাহিদায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে। যেমন, উদাহরণস্বরূপ, আমার দু’টো মোবাইল, চারটা সিম, আমার স্ত্রীরও দুটো মোবাইল চারটা সিম। কোন দরকার ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয় মোবাইলটা থাকবে না, এটা আমি চিন্তাও করতে পারি না। অর্থাৎ, আমি বা আমার মতো কোটি কোটি মানুষ মনে করছে যে দ্বিতীয় মোবাইলটা প্রথম মোবাইলটির মতোই মৌলিক চাহিদার অন্তর্গত। দ্বিতীয় মোবাইলটা যে আমার অপ্রয়োজনীয় খরচ সেটা আর আমার চোখেই পড়ছে না। এভাবে আমরা যদি মোবাইল ছাড়িয়ে, শাড়ি, গহনা, লেহেঙ্গা, শার্ট, স্যুট, আসবাবপত্র, গাড়ি, বাড়ি বা এগুলো সাজানোর জন্য ক্রয়কৃত অতিরিক্ত পণ্যগুলির কথা চিন্তা করি, তা হলে দেখব যে পুরো পুঁজিবাদী বিশ্বটাই জিকিরে নেমেছে কীভাবে গান্ধীজির কৃচ্ছতাসাধনের বিপরীতে মানুষের কর্মপ্রবাহকে ধাবিত করা যায়। গান্ধীজি ফেমাসলি বলেছিলেন , জীবনের সার্থকতা হচ্ছে ‘হাউ মেনি থিংস ক্যান ইউ গো উইদাউট’ অর্থাৎ, কত কম জিনিষ নিয়ে জীবন চালানো যায়, আর কিডাল্ট তত্ত্ব বলছে, কত বেশি জিনিষ জীবন চালাতে গিয়ে প্রয়োজন। জিনিষটার মধ্যে শিশুকে মন ভোলানোর মতো একটা কৌশল কার্যকর। যেমন বগুড়ায় যে হোটেলে আমরা আছি, সেখানে ব্রেকফাস্ট কম্পলিমেন্ট্রি। আমরাও খুশি মনে নাস্তা করছি, এটা ওটা খাচ্ছি, শিশুতোষ আহ্লাদে মন ভরে আছে। আসলে কি কম্পলিমেন্ট্রি? দামটা কি রুম ভাড়ার সঙ্গে নিয়ে নেওয়া হচ্ছে না?
এটাও পরিষ্কার যে কিডাল্ট তত্ত্ব সবচেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল বেগবান অর্থনীতি যেখানে একটি ভোগবাদী শ্রেণি তৈরি করতে পারছে সেখানেই। বাংলাদেশ এখন এই রেঞ্জের মধ্যে ঢুকছে বলে অর্থনীতিবিদেরা মতামত দিয়েছেন। এবং এই ভোগবাদী সমাজের মধ্যে ‘কিডাল্ট’ -কে, অর্থাৎ বুড়োর মধ্যে শিশুকে সর্বত্র জাগরুক রাখছে দু’টো প্রক্রিয়া: একটি হচ্ছে সহজলভ্য ব্যাংক ঋণ (যার ছোট সংস্করণ হচ্ছে প্লাস্টিক লোন বা ক্রেডিট কার্ড-এর ফাঁস) আরেকটি হচ্ছে রিয়েল স্টেইটের আহ্বান। খুব সিরিয়াসলি দেখলে ক্ষুদ্র ঋণের প্রলোভনও কিডাল্ট তত্ত্বের অর্ন্তগত বলে আমার মনে হয়।
মোটামুটি অর্থটা দাঁড়ায় এই যে কিডাল্ট তত্ত্বের লক্ষ্য হলো আপনার পকেটে যে টাকা আসছে সে টাকা থেকেই আপনাকে ঋণগ্রস্থ লোক হিসেবে পরিণত করা। আবার এই তত্ত্ব এইটাও স্বীকার করে যে মানুষ তার স্পেকুলেটিভ (অভিলাষী) চারিত্রের জন্য ঋণগস্থ হবেই।
পারস্য কবি ওমর খৈয়াম উঁকি মারছেন আমার লেখায়, কান্তিচন্দ্র ঘোষের অনুবাদে, “নগদ যা পাও হাত পেতে নাও/ বাকির খাতা শূন্য থাক/ দূরের বাদ্য শুনে সে কি লাভ / মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।”
এই মাঝখানের ফাঁকটা পূরণে ব্যস্ত কিডাল্ট তত্ত্বের ধারানুযায়ী অনুসৃত অর্থনীতি। অর্থাৎ, কার্পে ডিয়েম—একটি ল্যাতিন উক্তি, যার ইংরেজি seize the day.
=শেষ=
২২ ডিসেম্বর ২০২১
হোটেল লা ভিলা, বগুড়া